সিকিম, সিটং অনেক হল! এই শীতে হাতের নাগালেই রয়েছে 'ভারতের স্কটল্যান্ড'

সন্ধ্যার পরে হোমস্টের বারান্দায় ফায়ারপ্লেসের পাশে জড়ো হয়ে বসে থাকার সময়ে বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে একটানা চলা ঝিঁঝির কোরাস আপনাকে জীবনের রোজনামচা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির পাহাড় বলতে হয় দার্জিলিং নাহলে সিকিমের নাম প্রথম মনে পড়ে। হালফিলে বিজনবাড়ি, চটকপুর, সিটংয়ের মতো জায়গায় বাঙালি নিজের আনাগোনা বাড়ালেও দক্ষিণ ভারতের পাহাড় বাঙালির গন্তব্যের লিস্টে একটু নিচের দিকে জায়গা পায়। যদিও তামিলনাড়ুর উটি অথবা বর্তমানে কেরলের মুন্নারে বাঙালি নিজের জুতোর ধুলো দিতে শুরু করেছে তবুও দক্ষিণ ভারতের বহু হিলস্টেশন যাওয়ার আগে বহুবার ভাবতে হয়। আসলে এই হিলস্টেশন সম্বন্ধে নিজস্ব ধারণায় দক্ষিণ ভারত সম্পর্কে এক বাঁধাধরা ছকে তৈরি হয়ে যায়। তাই এই গন্তব্যগুলির প্রতি এক অনীহা প্রকাশ পায়। অনীহা সরিয়ে একটু সাহস জোগাড় করে পা বাড়ালেই কিন্তু বাঙালির জন্য অপেক্ষা করে থাকবে একের পর এক দৃষ্টিনন্দন স্থান। তাদের মধ্যেই অন্যতম ভারতের স্কটল্যান্ড নামে পরিচিত কর্ণাটকে অবস্থিত কুর্গ। 

কফি বাগান এবং জঙ্গলে ঘেরা হলেও পাহাড় হিসাবে কুর্গ নেহাতই ছোটো। কুর্গের প্রধান সৌন্দর্য লুকিয়ে রয়েছে তার সরল সবুজ প্রকৃতির মধ্যে। তাই তাকে শুধু পাহাড় না বলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতায় অবস্থিত জঙ্গল বলা যেতে পারে। কুর্গে যাওয়ার আদর্শ সময় শীতকাল। নভেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে কুর্গের মনোরম পরিবেশের কারণে এবং কফির ফলের প্রক্রিয়াকরণ দেখতে অনেক পর্যটক ভিড় জমান। কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু, মাইসোর অথবা ম্যাঙ্গালুরু থেকে গাড়ি অথবা বাসে করে কুর্গে পৌঁছনো যায়। বেঙ্গালুরু থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, মাইসোর এবং ম্যাঙ্গালুরু থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরত্ব শুনে পিছিয়ে এলে কিন্তু এক অতীব দৃষ্টিনন্দন রাস্তায় যাত্রা করার সৌভাগ্য থেকে আপনাকে বঞ্চিত হতে হবে। কুর্গের প্রধান শহর মাদিকেরী যদিও কুর্গের রূপের কিছুটা ঝলক দেখাতে পারে কিন্তু প্রকৃতির আরও কাছাকাছি থাকতে গেলে প্রধান শহর ছেড়ে একটু দূরে আপনাকে থাকতে হবে।

কুর্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় বহু কফি বাগানকে কেন্দ্র করে একাধিক হোমস্টে গড়ে উঠেছে। এই হোমস্টেগুলোতে সব ব্যবস্থা হোটেলের মতো না হলেও এখানকার বাড়িতে তৈরি স্থানীয় খাবার এবং সবুজের ঢেউ কোনও এক জাদুবলে আপনাকে সবকিছু ভুলিয়ে রাখতে পারে। সকাল থেকে রাত অবধি প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের খেলা চলতে থাকে। সকালের আলো ফুটলেও রোদ ওঠার আগে মেঘলা আকাশ এবং বর্ষাকালের সকালের মতো ঝিরঝিরে হাওয়া রোদ ওঠার পরে অদৃশ্য হয়। তখন দেখা যাবে সবুজ এবং কমলা রঙের ঢেউয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে দূরের পাহাড়ের চূড়া। হোমস্টের আশেপাশে পায়ে হেঁটে দেখে নেওয়া যেতে পারে অসংখ্য কফি, গোলমরিচ, কমলালেবু, প্যাশন ফ্রুট এবং বহু ফুলের গাছ। সন্ধ্যার পরে হোমস্টের বারান্দায় ফায়ারপ্লেসের পাশে জড়ো হয়ে বসে থাকার সময়ে বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে একটানা চলা ঝিঁঝির কোরাস আপনাকে জীবনের রোজনামচা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্য নিয়েই কুর্গে গেলেও শুধু হোটেল অথবা হোমস্টেতে আটকে না থেকে আরও অনেক জায়গায় গিয়েও প্রকৃতিকে একটু অন্যভাবে উপভোগ করা যায়।

আরও পড়ুন- দিঘা-পুরী-দার্জিলিং নয়, বাঙালির মনে জায়গা পাকা করছে চটকপুর

নিস্বর্গধাম

মাদিকেরী বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরত্বে কুশলনগরে রয়েছে নিস্বর্গধাম। নাম শুনে আশ্রম মনে হলেও একে প্রকৃতির আশ্রম বলা চলে। কাবেরী নদীর প্রবাহের মধ্যে তৈরি হওয়া একটি ব-দ্বীপ এলাকার নাম নিস্বর্গধাম। কিছুটা উঁচু নিচু পাহাড়ি পথে হেঁটে, নদীর উপর সাঁকো পার হয়ে অল্প ঘুরে জঙ্গল, পাখি দেখার আদর্শ স্থান এই অঞ্চল। পুরো এলাকা পায়ে হেঁটে ঘুরতে ঘণ্টা খানেকের বেশি সময় লাগবে। তাই আশেপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে এই অঞ্চলে গেলে কিছুটা সময় হাতে নিয়ে চলা বাঞ্ছনীয়।

দুবারে এলিফ্যান্ট ক্যাম্প

উচ্চারণের ভুলে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের কোনও প্রকল্পের নাম মনে হলেও বাস্তবে আমাদের রাজ্যের সরকারের সঙ্গে এই ক্যাম্পের কোনও যোগাযোগ নেই। মাদিকেরী থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ক্যাম্প। নদীর পাশে জঙ্গলের মধ্যে হাতি দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে এই এলাকায় যাওয়া যেতে পারে। যদিও মানুষের এই এলাকায় প্রবেশের সময় নির্ধারণ করা রয়েছে এবং সেই সময়ে হাতিদের নির্দিষ্ট বেষ্টনীর মধ্যে রাখা হয়। সকাল আটটা থেকে সাড়ে এগারোটা এবং বিকেল চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে মাথাপিছু একশো টাকার টিকিটের বিনিময়ে এই এলাকায় প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। প্রথমে নৌকোয় চেপে নদী পার করে তারপর হাঁটা পথে ক্যাম্পে পৌঁছনো যায়। যদিও এই ক্যাম্পে সকালে আসা বেশি সুবিধাজনক কারণ বেশি সময় অতিবাহিত করা যায়। সকালে খাবার খাওয়ানোর সঙ্গে হাতিদের স্নান করানো হয়। বিকেলে বেস্টনীর মধ্যে হাতিদের দেখলে অনেকটা খাঁচা ছাড়া চিড়িয়াখানায় ভ্রমণ মনে হতে পারে। ক্যাম্প থেকে ফেরার সময়ে নৌকো করেই ফিরতে হয়। নৌকোর জন্য কোনও অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হয় না।

মণ্ডলপট্টি

কুর্গের অন্যতম জনপ্রিয় এলাকার নাম মণ্ডলপট্টি। মণ্ডলপট্টি যাওয়ার জন্য জিপ ভাড়া নিতে হয়। মাদিকেরী থেকে কিছু দূরেই মণ্ডলপট্টি যাওয়ার জন্য জিপ স্ট্যান্ড রয়েছে। সেখান থেকে শেয়ার অথবা পুরো গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ১৭ কিলোমিটার যেতে হয়। পুরো গাড়ির ভাড়া ২৫০০ টাকার আশেপাশে পড়ে এবং শেয়ারে মাথাপিছু ৫০০-৬০০ টাকা ভাড়া হতে পারে। গাড়ি থামার পরে হেঁটে বেশ কিছুটা চড়াই পার করলে এক অদ্ভুত দৃশ্য! চূড়া থেকে চারিদিকে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে ঘুরে কুর্গের অপূর্ব রূপ দেখতে পাওয়া যায়। জিপ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে চূড়ায় পৌঁছনোর পথ ক্লান্তিকর হলেও আশেপাশের দৃশ্য সেই ক্লান্তি ভুলিয়ে দিতে পারে। যদিও মণ্ডলপট্টি যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার। জিপ গাড়ির রাস্তায় শেষ চার কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। তাই পাহাড়ে উঠে শরীর খারাপের প্রবণতা থাকলে অগ্রিম সচেতনতা অবলম্বন করে যাওয়া উচিত।

আবে/ অ্যাবি জলপ্রপাত

মাদিকেরী বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আবে জলপ্রপাত। মাথাপিছু দশ টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে এক জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। প্রবেশদ্বার থেকে সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নিচে নামলে এই জলপ্রপাতের কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। রেলিং ঘেরা দাঁড়ানোর বড় জায়গা ছাড়াও একটি স্বল্প উঁচু টাওয়ার থেকে এই জলপ্রপাত দেখা যায়।

আরও পড়ুন- দিঘা-মন্দারমণি ফেল! এই ‘গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন’-ই এখন বাংলার সেরা উইকেন্ড ট্যুরিস্ট স্পট

রাজা সিট 

দার্জিলিং গেলেই যেমন সূর্যোদয় দেখতে মানুষ টাইগার হিলে ভিড় জমান, তেমনই সূর্যাস্তের সময় মানুষ রাজা সিটে ভিড় জমান। কথিত আছে যে, কুর্গের স্থানীয় রাজা এখানেই বসে বিকেলের সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করতেন। মাদিকেরীর এক প্রান্তে অবস্থিত এই রাজা সিটে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর মতো একটা ছোটো পার্ক সহ সূর্যাস্ত দেখার জন্য আলাদা জায়গা নিয়েই তৈরি হয়েছে রাজা সিট। মাথাপিছু কুড়ি টাকা মূল্যের টিকিটের বিনিময়ে রাজা সিট এবং সংলগ্ন পার্কে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও নিরাশ হওয়ার দরকার নেই কারণ রাজা সিটের সামনে থেকেই কুর্গের বিস্তীর্ণ এলাকার শোভা দেখতে পাওয়া যায়।

মাদিকেরী ফোর্ট

মাদিকেরী শহরের এক প্রান্তে রয়েছে স্থানীয় রাজার কেল্লা যা পর্যটকদের কাছে মাদিকেরী ফোর্ট নামে পরিচিত। আকারে অথবা পরিকল্পনায় পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের যে কোনও কেল্লার কাছে এই কেল্লা নেহাতই শিশু এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের কারণে বর্তমানে আরও ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়েছে। তবুও স্থানীয় মানুষের ইতিহাস এবং অজানা বহু গল্প সম্বল করে আজও শহরের উপকণ্ঠে এই কেল্লা দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই কেল্লায় বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায় এবং কিছুক্ষণ কেল্লা, তার ভিতরের মন্দির এবং আশেপাশের মাঠে সময় কাটানো যায়।

নামদ্রোলিং মনেস্ট্রি

মাদিকেরী শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নামদ্রোলিং মনেস্ট্রি। দক্ষিণ ভারতে এক টুকরো তিব্বতের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে এই মনেস্ট্রিতেই। সকাল সাতটা থেকে এই মনেস্ট্রিতে বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায়। যদিও প্রধান উপাসনালয়ের আশেপাশে জুতো ছাড়া প্রবেশ করতে হয়। সেই ক্ষেত্রে জুতো পিছু তিন টাকার বিনিময়ে জুতো জমা রাখার ব্যবস্থা করা রয়েছে।

 এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কুর্গের বেশিরভাগ আকর্ষণীয় স্থান প্রধান শহর মাদিকেরী থেকে কুড়ি-তিরিশ কিলোমিটার দূরত্বে থাকলেও বেশিরভাগ স্থান বেঙ্গালুরু, মাইসোর অথবা ম্যাঙ্গালুরু থেকে কুর্গে যাওয়ার রাস্তার আশেপাশে অবস্থিত। তাই অতিরিক্ত সময় ব্যয় হওয়ার কোনও অবকাশ নেই। তবে কুর্গকে অনুভব করতে গেলে সময়ের দরকার। রুক্ষ শহর ছেড়ে যাওয়া পর্যটকদের চোখে সবুজের প্রলেপ দিতে কুর্গ বিন্দুমাত্র দেরি করে না। প্রকৃতির সব রঙ যেন দেখতে পাওয়া যায় এখানে। গাছের সবুজ, আকাশের নীল, কফির ফলের লাল, গোলমরিচের কালো, কমলালেবুর কমলা। তার সঙ্গে দেখা পাওয়া যায় চেনা, অচেনা নানা রকম পাখির। এই সব কিছুর সঙ্গে আনন্দ অনেক বেশি বাড়িয়ে দিতে পারে এই এলাকার স্থানীয় খাবার যার মধ্যে বিভিন্ন চকোলেট এবং স্থানীয় ওয়াইন অন্যতম। তাই পাহাড়ের নাম উঠলে বাঙালির গন্তব্য হতেই পারে ভারতের স্কটল্যান্ড নামে পরিচিত কুর্গ।

More Articles