ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রণে বড় ফাঁকফোকর! কাশির সিরাপ খেয়ে ১৪ জন শিশুর মৃত্যু

India Faces Another Cough Syrup Tragedy: মধ্যপ্রদেশের এই ঘটনার পর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। তামিলনাড়ুর কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে।

সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওড়া জেলায় ১৪ জন শিশুর কাশির সিরাপ খেয়ে মৃত্যু হয়েছে। তাদের সবার শরীরে বৃক্ক বিকলতা (কিডনি ফেল) দেখা দেয়। তদন্তে জানা গেছে, ওই সিরাপে ডাইইথিলিন গ্লাইকল (DEG) নামে এক বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান ছিল, যা শরীরের পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর।

সিরাপটির নাম ছিল ‘কোল্ডরিফ' (Coldrif)। এটি তৈরি করেছিল তামিলনাড়ুর শ্রীসান ফার্মাটিক্যালস (Sresan Pharmaceuticals)। সরকারি একটি পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই সিরাপে ডাইইথিলিন গ্লাইকল (DEG)-এর পরিমাণ অনুমোদিত সীমার (০.১%) অনেক বেশি— প্রায় ৪৮.৬%।

এমন ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও কয়েকবার কাশির সিরাপের বিষক্রিয়ায় শিশুদের মৃত্যু হয়েছে। ২০২২ সালে গাম্বিয়া ও উজবেকিস্তানে ভারতীয় তৈরি কাশির সিরাপের কারণে শতাধিক শিশু মারা যায়। ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে একইভাবে বিষাক্ত সিরাপে ১৭টি শিশু প্রাণ হারায়। এমনকি ১৯৯৮ সালেও গুরগাঁওয়ে কাশির সিরাপ খেয়ে মারা যায় ৩৩ জন শিশু। প্রতিবার তদন্তে একই জিনিস ধরা পড়েছে— উৎপাদনের সময় নিরাপত্তার মান বজায় রাখা হয়নি।

আরও পড়ুন

যত্রতত্র ফেলেন, কমোডে ফ্লাশ করেন? মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে আসলে যা করা উচিত

ডাইইথিলিন গ্লাইকল কী?

ডাইইথিলিন গ্লাইকল বা DEG এক ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক। সাধারণত এটি শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু কখনও কখনও ওষুধ তৈরির সময় খরচ বাঁচাতে এটি ব্যবহার করা হয়। ওষুধ তৈরিতে ডাইইথিলিন গ্লাইকল ব্যবহার করলে তা শরীরে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে— বমি, পেটব্যথা, মাথা ঘোরা, মূত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া, এমনকি বৃক্ক সম্পূর্ণ বিকল হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শিশুরা বেশি বিপদে থাকে, কারণ তাদের শরীর এতটা পরিমাণ ডাইইথিলিন গ্লাইকল সহ্য করতে পারে না।

সাধারণত কাশির সিরাপে প্রোপাইলিন গ্লাইকল নামে একধরনের দ্রাবক ব্যবহার করা হয়। এটি ওষুধের উপাদানগুলিকে একসঙ্গে মেশাতে সাহায্য করে। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রোপাইলিন গ্লাইকল দু-রকমের হয়— ১) ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রেড (যা ওষুধে ব্যবহারের জন্য নিরাপদ), ২) ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড (যা শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয় এবং এতে DEG মিশে থাকতে পারে)। অনেক সময় কোম্পানিগুলো খরচ বাঁচাতে বা অসতর্কতার কারণে এটি ব্যবহার করে ফেলে।

ভারতের ওষুধ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু খামতি রয়েছে—

কাঁচামাল পরীক্ষা হয় না: প্রোপাইলিন গ্লাইকলের মতো উপাদান আমদানি হয় বিদেশ থেকে, কিন্তু বন্দরে তার গুণমান পরীক্ষা করা হয় না।

অনেক ছোট কোম্পানির কাছে পরীক্ষার যন্ত্র নেই: গ্যাস ক্রোম্যাটোগ্রাফি যন্ত্র ছাড়া ডাইইথিলিন গ্লাইকল ধরা সম্ভব নয়।

ওষুধ বিক্রিতে নজরদারি কম: প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অনেক সময় কাশির সিরাপ বিক্রি হয়, যা শিশুদের জন্য বিপজ্জনক।

রেকর্ড সংরক্ষণে অবহেলা: উৎপাদন ও পরীক্ষা সংক্রান্ত নথি অনেক কোম্পানি সঠিকভাবে রাখে না।

আরও পড়ুন

সফট ড্রিংকস না কি বিষ? নিজের অজান্তেই মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছেন

মধ্যপ্রদেশের এই ঘটনার পর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। তামিলনাড়ুর কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ সরকার রাজ্যের তিনজন ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে। কোল্ডরিফ সিরাপ বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নতুন নিয়ম চালু করতে চলেছে। এতে হু (WHO)-এর গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (GMP) অনুসারে মান বজায় রাখা বাধ্যতামূলক হবে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সব ছোট কোম্পানিকেও এই মানদণ্ডে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

একই ভুল বারবার ঘটছে, আর তার মাশুল দিতে হচ্ছে নিরীহ শিশুদের। যদি সরকার, কোম্পানি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এমন মৃত্যুর মিছিল আবারও দেখা যাবে। ওষুধ মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য— কিন্তু নজরদারি না থাকলে সেটাই হতে পারে মৃত্যুর কারণ।

More Articles