অভিজিৎ, দেবাংশু বনাম সায়ন, তমলুকে কতটা কঠিন হতে চলেছে বামেদের লড়াই?
Lok Sabha Election 2024: বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে ১৬ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। সেখানে তমলুক কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়েছে সায়নের নাম।
একদিকে তাঁর প্রতিপক্ষ দুঁদে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। চাকরিপ্রার্থীদের 'মসিহা', গোটা রাজ্যের কাছে সততার প্রতীক তিনি। সদ্য বিচারপতির দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। স্বয়ং শুভেন্দু অধিকারী তাঁর রথের সারথী। আর অন্য দিকে, তৃণমূলের তরুণতম নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্য। ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় মুখ। মুখে কথার খই ফোটে। আসন্ন লোকসভা ভোটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র তমলুক। স্বাভাবিক ভাবেই সেই তমলুক কেন্দ্রে বামেরা কাকে প্রার্থী করতে চলেছে, সেদিকেই ছিল সকলের চোখ। বৃহস্পতিবার বামেদের প্রার্থীতালিকা সামনে আসতে দেখা গেল, তমলুকের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে আইনজীবী সায়ন ব্যানার্জিকেই বেছে নিল দল।
যারা অভিযোগ করতেন, সিপিএম প্রবীণ-সর্বস্ব দল, সেখানে তরুণদের তেমন জায়গা নেই। বিগত কয়েক বছরে কার্যত প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, তারুণ্যের কোনও অভাব নেই দলে। সমস্ত নবীনদের হাতেই এখন সংগঠনের ভার। গত কয়েক বছরে একাধিক নতুন মুখ উঠে এসেছে সামনের সারিতে। সায়নও তাঁদের মধ্যেই একজন। ভালো বক্তা। বামেদের অধিকাংশ আন্দোলনেই একবারে প্রথম সারিতেই দেখা গিয়েছে তাঁকে। হাইকোর্টের দুঁদে আইনজীবী হিসেবে ইতিমধ্যেই নাম ছড়িয়েছে তাঁর। প্রায়শই সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিতর্কসভায় দেখা যায় তাঁকে। সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন ইস্যুতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা গেছে সায়নকে। বাম ব্রিগেডের সেই তরুণ নেতাই এবার তমলুকে লড়তে চলেছেন তৃণমূলের দেবাংশু ও বিজেপির অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। যদিও বিজেপির তরফে এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি, তবে কানাঘুষো যা শোনা যাচ্ছে, তাতে তমলুকে লড়তে চলেছেন অভিজিৎই।
আরও পড়ুন: দেবাংশু না অভিজিৎ, তমলুকে ভোটের লড়াইয়ে এগিয়ে কে?
নিয়োগ-দুর্নীতি থেকে শুরু করে কয়লা, রেশন থেকে গোরুপাচার, একাধিক দুর্নীতিতে ফেঁসে তৃণমূলের একাধিক নেতা। সেসব নিয়ে প্রকাশ্যে বারবারই সোচ্চার হয়েছেন বাম নেতা তথা আইনজীবী সায়ন ব্যানার্জি। কলকাতা হাইকোর্টের উকিল সায়ন। আর সেই হাইকোর্টেরই প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু রাজনীতির নাগরদোলা এমনই যে ২০২৪ লোকসভা ভোটে প্রতিপক্ষ এবার আইনজীবী-বিচারপতি জুটি। তমলুকের বিজেপি এবং বাম প্রার্থী দু'জনেই আইনের লোক। অন্তত এতদিন অভিজিৎ তা-ই ছিলেন। এদিকে আবার দেবাংশু ও সায়ন- দু'জনেই সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ। ফেসবুক জুড়ে দেবাংশুর যে বিরাট সংখ্যক সমর্থন রয়েছে, সেদিকে কিন্তু পিছিয়ে নেই সায়নও। সম্প্রতি আবার বিয়ে করেছেন সায়ন। কুচবিহারের মেয়ের গলায় মালা দিয়েছেন তিনি। ফেসবুক খুললেই সেসব ছবি চোখে পড়ে এখনও। সদ্যবিবাহিত এই বাম নেতারও ফেসবুকে ভক্তসংখ্যা নেহাৎ মন্দ নয়। প্রায়শই বামমঞ্চে ঝোড়ো বক্তৃতা দিতেও দেখা যায় তরুণ এই বামনেতাকে। যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ ফোকাসে আসতে দেখা গিয়েছিল তরুণ বামনেতা তথা আইনজীবীকে।
সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে তৃণমূলপ্রার্থী দেবাংশু দাবি করেছেন, বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ যতই দুঁদে বিচারপতি হোন না কেন, রাজনীতির ময়দানে দেবাংশু তাঁর থেকে অনেকটাই প্রবীণ তথা সিনিয়র। তা সেই কথা তো সায়নের ক্ষেত্রেও খাটে। দেখতে দেখতে রাজনীতির অঙ্গনে কম দিন হল না তাঁরও। একসময় সহকর্মী ছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও সায়ন ব্যানার্জি। অভিজিতের বিজেপি-যোগের আগে মধ্যিখানে গুঞ্জন উঠেছিল, বামে যোগ দিতে পারেন প্রাক্তন বিচারপতি। অভিজিৎবাবু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় সায়নকে বলতে শোনা গিয়েছিল, অভিজিৎবাবু বামে যোগ দিলে তিনি নাকি দল ছাড়তেন। দিন কয়েক আগেও প্রাক্তন বিচারপতিকে 'সুবিধাবাদী' বলে তোপ দাগতে দেখা গিয়েছিল সায়নকে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করে ১৬ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। সেখানে তমলুক কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়েছে সায়নের নাম। প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় রাজ্যের অন্যতম চর্চিত নাম। তাঁর বিরুদ্ধে কতটা কঠিন হতে চলেছে সায়নের এই লড়াই। যদিও বিষয়টাকে একেবারেই সেভাবে নিচ্ছেন না আইনজীবী বামপ্রার্থী। তাঁর মতে, "বিচারপতির বিরুদ্ধে তো এজলাসের মধ্যে লড়াই হয়। বিচারপতিরা রাজনীতির ময়দানে নামেন নাকি। যাঁর কথা হচ্ছে তিনি প্রাক্তন বিচারপতি। উনি বিচারপতি হিসাবে যা সম্মান পাওয়ার পেয়েছেন। কিন্তু, আমি যা শুনেছি তা হচ্ছে উনি বিজেপির প্রার্থী হিসাবে উনি লড়াই করবেন। আমরা ওটা রাজনীতির ময়দানে বুঝে নেব। আমরা অনেকদিন থেকে রাজনীতি করছি, যাঁরা নবাগত তাঁদের চিন্তা হলেও হতে পারে।" কার্যত দেবাংশুর সুরেই তাল মিলিয়েছেন সায়নও। একই সঙ্গে প্রাক্তন বিচারপতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সায়ন। বলছেন, “একজন মানুষ যদি হঠাৎ ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে বলেন নারদার গোটাটাই হচ্ছে চক্রান্ত, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে। মানুষ নিজের ইমেজ নিজেই বানায়, নিজেই নষ্ট করে। তাতে আমাদের খুব একটা কিছু এসে যায় না। লড়াইটা রাজনৈতিকভাবে হবে।”
তবে দেবাংশুর সঙ্গে সুর মিললেও তাঁর লড়াইটা যে শুধু গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে নয়, সে কথাও এদিন পরিষ্কার করে দিয়েছেন সায়ন। জানিয়েছেন, এই গোটা পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-বিজেপির বিরুদ্ধেই তাঁদের লড়াই। দেবাংশুর বিরুদ্ধেও লড়াই হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই। একদিকে দেবাংশুর মতো তৃণমূলের অতি পরিচিত মুখ। তিনি যে ভালো কথা বলেন, তা বারবার প্রমাণ করেছেন দেবাংশু। বাক্য-বাণেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ওস্তাদ তিনি। সেদিক থেকে কম যান না সায়নও। তবে কি দেবাংশু ও সায়নের মতো তরুণের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্তত সোশ্যাল মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যমের লড়াইয়ে খানিকটা বিপাকে পড়তে হতে পারে প্রাক্তন বিচারপতিকে। এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন তমলুকে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সায়নের লড়াইটা বেশ কঠিন। তার কারণ, কেন্দ্রের নাম তমলুক। যেখানে গত কয়েক দশক ধরে রাজ করছে অধিকারী পরিবার।
আরও পড়ুন:যাদবপুরে সততা বনাম দুর্নীতি! সায়নী ঘোষের বিরুদ্ধে কতটা শক্তিশালী সৃজন ভট্টাচার্য?
শেষ লোকসভা ভোটে সেখানে বাম, কংগ্রেস এবং বিজেপিকে পিছনে ফেলে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটই নিজের দখলে রেখেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। সে বছর বিজেপির প্রার্থী সিদ্ধার্থশঙ্কর নস্কর পেয়েছিলেন মাত্র ৩৭ শতাংশ ভোট। এবার সেই শুভেন্দুই বিজেপিতে। ২০২১ বিধানসভা ভোটেও তমলুক ক্ষমতায় রেখেছিল তৃণমূলই। জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলপ্রার্থী সৌমেন কুমার মহাপাত্র। আপাতত সেখানকার সাংসদ শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দু। কিন্তু বর্তমানে তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব তাঁর বেড়েছে। দাদা শুভেন্দু অধিকারী গেরুয়া শিবিরের যাওয়ার পর থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে অধিকারী পরিবার। আর এই লোকসভার যুদ্ধে অভিজিতের রথের সারথী সেই শুভেন্দু খোদ। ইতিমধ্যেই পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক, নন্দীগ্রাম অভিজিৎবাবুকে হাত ধরে ঘুরিয়ে এনেছেন শুভেন্দু। আর শুভেন্দুর গড় ভেদ করা যে এত সহজ নয়, তা গত বিধানসভা ভোটেই ভালো মতো বোঝা হয়ে গিয়েছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নন্দীগ্রামে হারিয়ে রাজ্যের বিরোধীনেতার মুকুট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শুভেন্দু। সেই শুভেন্দুর সমর্থন যাঁর সঙ্গে, তমলুকে যে তাঁর ঝুলিতে অতিরিক্ত কিছু নম্বর রয়েইছে, তা তো আর অস্বীকার করার জো নেই।
সায়ন অবশ্য জয়ের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। তাঁর কথায়, “পার্টির আমাকে তমলুক থেকে লড়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। আমরা জেতার জন্য মাঠে নেমেছি। লড়ে জিতে, তবেই মাঠ ছাড়ব।” লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ এখনও ঘোষণা হয়নি। ইতিমধ্যেই বিজেপি-তৃণমূল ও বাম- তিন দলেরই প্রথম পর্যায়ের প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে ভোটের হাওয়া বাতাসে লাগতেই শুরু হয়ে গিয়েছে দলবদলুদের যাওয়া-আসা। এই পরিস্থিতিতে তমলুক যে বঙ্গ-রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এপিসেন্টার হয়ে উঠতে চলেছে, তাতে তো আর সন্দেহ নেই। দুঁদে আইনজীবী না জনপ্রিয় তৃণমূল যুবনেতা, নাকি সবাইকে ছাপিয়ে দুঁদে আইনজীবী, কে কাকে মাত দেবে, সেটাই এখন দেখার।