চাকা ঘুরছে? মীনাক্ষি-সৃজন-কলতানদের ব্রিগেড ইনসাফ দেবে রাজ্যকে?
CPIM Brigade : এই যে এক ঝাঁক যুব নেতৃত্বকে সিপিআই(এম) সামনে তুলে ধরেছে, তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়; মীনাক্ষী, ধ্রুবজ্যোতি, কলতান, প্রতিকূর, সৃজন, ময়ূখ প্রমুখকে।
বামপন্থী যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই এর আগে বেশ কয়েকবার ব্রিগেডে জন সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। ২০২৪-এর গোড়াতেই আবারও তাঁরা ওই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডেই জন সমাবেশের ডাক দিলেন তাঁদের দীর্ঘদিন ব্যাপী ইনসাফ যাত্রার শেষে। অতীতে বামপন্থী যুব সংগঠনের সমাবেশের ডাক, আর এখন সেই বামপন্থী যুব সংগঠনেরই ডাকা ব্রিগেডে সমাবেশের মধ্যে সবথেকে বড় ফারাক হলো, অতীতে যখন বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল, সেই সময় বামপন্থী যুব সংগঠন ব্রিগেডের জনসমাবেশ ডেকেছিল। আটের দশকের শেষের দিকে, নয়ের দশকের মধ্যবর্তী ভাগে, এমনকী সপ্তম বামফ্রন্টের আমলেও বামপন্থী যুব সংগঠন ব্রিগেডে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল।
কিন্তু বিগত প্রায় ১৩ বছর ধরে বামপন্থীরা এই রাজ্যে ক্ষমতায় নেই। এমনকী এই সময়ে,পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে রাজ্য বিধানসভা বা লোকসভায় কোনও প্রতিনিধিও নেই। মাত্র একটি পৌরসভা বামফ্রন্টের দখলে রয়েছে। এইরকম একটি অবস্থায় দীর্ঘদিন ব্যাপী ইনসাফ যাত্রার পর বামপন্থী যুব সংগঠনের ব্রিগেড সমাবেশ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক আবর্তে এক অন্যরকম পরিমণ্ডলের আভাস দিচ্ছে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বামপন্থীরা জনসংযোগের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিয়েছিলেন। তাঁদের বিভিন্ন সময়ের জাঠা কর্মসূচিগুলি সাময়িক সাফল্য পেলেও, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে যে ধরনের অবস্থা অতীতে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ছিল, এইসব জাঠা জাতীয় কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে বা তার আগে বা পরে, সেই ধরনের সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা বামপন্থীদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন- মীনাক্ষীকে ঘিরে বাম যুবদের উৎসাহের সীমা নেই, তবু অতীতই ভবিষ্যতের অন্তরায়
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বামপন্থী রাজনীতির প্রতি কতটা আকৃষ্ট হচ্ছে এবং সেই আকর্ষণ কতখানি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রাণচাঞ্চল্যের আভাস দিচ্ছে, তার কোনও পরিচয়ও এই জাঠা কর্মসূচির পর পর বামপন্থীদের মধ্যে সেভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি। এই সময়টাতে যেন এক নিস্তরঙ্গ পরম্পরা বামপন্থী রাজনীতির দস্তুর হয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। সিপিআই(এম)-এরই যখন এইরকম অবস্থা, তখন বামফ্রন্টভুক্ত অন্য বামপন্থী দলগুলির অবস্থা কী দাঁড়িয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। সে কথা আবার বেশি আলোচনারও দাবি রাখে না।
বিগত প্রায় দু' বছরে বামপন্থী রাজনীতিতে যে কর্মতৎপরতা এবং রাজনৈতিক চাঞ্চল্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তারই একটা প্রকাশ কিন্তু বামপন্থী যুব সংগঠনের এই ইনসাফ যাত্রা। দীর্ঘদিনব্যাপী এই ইনসাফ যাত্রার ভেতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সব ধরনের শাসকবিরোধী জনমানসকে একটা রাজনৈতিক মাত্রাবৃত্তের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার এই যে চেষ্টা তা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। ইনসাব যাত্রার কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে দেখা গেল নতুন উদ্যম। এই যে উদ্যম, সেটি কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চালচিত্রে খুব একটা মামুলি ব্যাপার নয়।
শাসকের নানা ধরনের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, বিশেষ করে বিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্রে, রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ব্যবহারের অভিযোগ এসব ঘিরে যে ধরনের একমুখী রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলতে শুরু করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থী যুব সংগঠনের সাম্প্রতিক কর্মসূচি নিঃসন্দেহে একটা দোলাচালের সৃষ্টি করেছে। বামপন্থী কর্মীদের মধ্যেও হতোদ্যম মানসিকতা লক্ষ্য করা গিয়েছে, রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে সেই ঝিমিয়ে পড়া ভাব কাটিয়ে উঠে মানুষকে আবার পথে নামানোর ক্ষেত্রে যুব সংগঠনের এই কর্মসূচি নিঃসন্দেহে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
রাজ্যের শাসক এবং কেন্দ্রের শাসক দুইয়ের যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সে সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের সামগ্রিক যে রাজনৈতিক ভূমিকা, তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে এক নতুন উদ্যম। বাম যুব সংগঠনের এই সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এবং ব্রিগেডের সমাবেশ ঘিরে তৎপরতার প্রতি ইঞ্চিতে টের পাওয়া যাচ্ছে সেই আঁচ। রাজনীতির ক্ষেত্রে স্থবিরতা কাটিয়ে বামপন্থী ছাত্র যুবদের প্রাণচঞ্চল্য যে কেবল বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করছে এমন নয়। পাশাপাশি রাজ্যের শাসক তৃণমূল এবং কেন্দ্রের শাসক বিজেপি- দুই রাজনৈতিক দলই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে বামপন্থীদের এই কর্মতৎপরতা এবং জনসংযোগের জন্য নিবিড় প্রচেষ্টাকে যথেষ্ট রাজনৈতিক গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছে।
তাই বামপন্থীদের যুব সংগঠনের ব্রিগেড সমাবেশের ঠিক আগে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে বাধা দেওয়া ইত্যাদি যে ধরনের ঘটনাক্রম রাজ্যে দেখা যাচ্ছে, সে ঘটনাগুলি যে বামপন্থী ছাত্র যুবদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মতৎপতা, ইনসাফ যাত্রা, ব্রিগেডের সমাবেশ ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণভাবে মিডিয়া এবং জনমানসের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা তা অনুমানকেও অসত্য বলা যায় না। ইনসাফ যাত্রা এবং ব্রিগেড সমাবেশ ঘিরে বামপন্থী যুব সংগঠনের যে কর্মকাণ্ড, মূলধারার গণমাধ্যম সেগুলিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। মূল ধারার গণমাধ্যমে বামপন্থী ছাত্র যুবদের এসব কর্মসূচি প্রথমদিকে খুব একটা প্রচারেও আসেনি। পরবর্তীকালেও নামকা ওয়াস্তে প্রচার করেই দায় সেরেছে মিডিয়া।
সামাজিক গণমাধ্যমে এই ধরনের কর্মসূচিগুলি প্রচার পেয়েছে, বামপন্থীদের নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়েও কর্মসূচি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিশেষ করে এই ইনসাফ যাত্রার মুখ হিসেবে বামপন্থীরা তাঁদের যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে যেভাবে তুলে ধরেছেন, তাঁকে ঘিরে সাধারণ মানুষের যে আগ্রহ, তৎপরতা, ভালোবাসা তৈরি হয়েছে সেটি আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমীকরণের ক্ষেত্রে যে প্রভাব ফেলবে না, একথা জোর দিয়ে এখনই বলা যায় না।
একটা সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী নেত্রী হিসেবে লড়াকু, সহজ-সরল জীবনযাত্রা যে ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল, ঠিক একইভাবে মীনাক্ষীর লড়াকু মানসিকতা,পুলিশের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে তর্ক করা, কোনওরকম আপোষকামী মানসিকতার মধ্যে নিজেকে পরিচালিত না করা- এই বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁকে একটা ভিন্নমাত্রা ইতিমধ্যেই দিয়েছে। অতি সাধারণ মানুষ, যাঁর হয়তো কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আছেই, কেউ হয়তো বামপন্থী, কেউ বামপন্থী নন, বা বামপন্থী বিরোধী সরাসরি শাসক শিবিরের মানুষ, তাঁদের মধ্যেও মীনাক্ষীর ভিতরে সেকালের মমতাকে আবিষ্কার করবার প্রবণতা লক্ষ্য করবার বিষয়।
আরও পড়ুন- অপরাধ সিপিআইএম করা, তাই বাবা-মাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে: দীপঙ্কর দাস
এই যে এক ঝাঁক যুব নেতৃত্বকে সিপিআই(এম) সামনে তুলে ধরেছে, তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়; মীনাক্ষী, ধ্রুবজ্যোতি, কলতান, প্রতিকূর, সৃজন, ময়ূখ প্রমুখকে। এই যুবরা ইতিমধ্যেই, অতীতের 'কনভেনশনাল' বামপন্থী নেতাদের যে লড়াকু মানসিকতা, সেই মানসিকতার সঙ্গে সাধারণ জনমানসে তুলনীয় হতে শুরু করেছেন। শাসক তৃণমূলের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতীত সেভাবে লড়াকু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কিন্তু সাধারণ জনতা আজ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি। মূলত মমতার জনপ্রিয়তাকে অবলম্বন করেই মাত্র ২৭ বছর বয়সী রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের আজকের এই রাজনৈতিক সাফল্য।
অপরপক্ষে সিপিআই(এম)-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার দায়িত্বভার গ্রহণের পর মহম্মদ সেলিম তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনার ক্ষেত্রে যেভাবে একেবারে অনামি ছাত্র যুব নেতাদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে একটা বিশেষ জায়গায়, লড়াইয়ের কর্মসূচিতে তাঁদের স্থান করে দিয়েছেন, তা কিন্তু সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের জনমানসের মেজাজ।
বামপন্থী বা তাঁদের বিরোধী দক্ষিণপন্থী শিবির, এমনকী সাম্প্রদায়িক শিবিরের মধ্যেও লড়াকু মানসিকতার নতুন প্রজন্মের মুখের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বাঙালির একটা মেজাজ। সেলিম সেই মেজাজকে সম্মান এবং মর্যাদা জানিয়েই তাঁর দলের প্রবীণ, প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ছাত্র যুবদের যেভাবে রাজনীতির ময়দানে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন, তেমনটা কিন্তু বামপন্থী রাজনীতিতে অতীতে প্রমোদ দাশগুপ্তের প্রয়াণের পরে খুব একটা ঘটতে দেখা যায়নি। প্রমোদ দাশগুপ্ত যেভাবে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে তৈরি করেছিলেন, তার ফসলই কিন্তু ছিল ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকার। ৩৪ বছরে সইফুদ্দিন চৌধুরী, (যদিও তাঁর সঙ্গে সিপিআইএম দলের পরবর্তীতে সম্মানজনক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল) মহঃ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, এইরকম দু' চারজন হাতেগোনা ব্যক্তিত্ব ছাড়া,নতুন প্রজন্মের মানুষদের, ছাত্র যুবদের, বিশেষ করে কলকাতা শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলের বাইরে, মফসসল থেকে তুলে আনা, সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষদের, বামপন্থী রাজনীতির লড়াইয়ের ময়দানে একটা বিশেষ জায়গায় জায়গা করে দেওয়া এটা খুব একটা যে দেখতে পাওয়া গেছে ,এমন দাবি করতে পারা যায় না।
সেই দিক থেকেই বলতে হয়; ক্ষমতায় থাকাকালীন বামপন্থী যুব সংগঠনের ডাকে ব্রিগেডে সমাবেশ আর দীর্ঘদিন ক্ষমতার পরিবৃত্তের বাইরে থেকে, ঘরে বাইরে প্রচণ্ড রকমের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক চাপের ভেতরে বামপন্থী যুব সংগঠনের ডাকা এই সাম্প্রতিক ব্রিগেড সমাবেশ সব দিক থেকেই একটা ভিন্ন মাত্রা দাবি করে।