ভারতীয় প্রতিরক্ষায় নয়া ইতিহাস! যে কঠোর প্রশিক্ষণ পেরিয়ে প্রথম স্নাতক হলেন মহিলারা
Women Cadet of National Defence Academy: সকল ক্যাডেটের মতো মেয়েরাও প্রথমে NDA-র নাপিতের হাতে চুল কাটে। সব ক্যাডেটকে একই রকম ইউনিফর্ম দেওয়া হয়, যাতে ব্যাজ না দেখলে ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না।
এই প্রথমবার ন্যাশনাল ডিফেন্স আকাডেমি থেকে স্নাতক হলেন ১৭ জন মহিলা ক্যাডেট। NDA-এর ১৪৮তম ব্যাচে ৩০০ জন পুরুষ ক্যাডেটের পাশাপাশি ছিলেন ১৭ জন মহিলা ক্যাডেটও। ৩০ মে পুনের খড়গবাসলাতে, প্যারেড গ্রাউন্ডে রচিত হয় এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট NDA পরীক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিল। এরপর ২০২২ সালে শুরু হয় প্রথম মহিলা ব্যাচের প্রশিক্ষণ, যারা এই বছর তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে স্নাতক হলেন। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে ক্যাডেটদের। গত তিন বছর ধরে কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এই মেয়েরা। রক্ত-ঘাম এক করে এই তরুণীদের ড্রিল রুটিন, ক্রস-কান্ট্রি দৌড় ভবিষ্যতে অসংখ্য তরুণীদের অনুপ্রাণিত করবে বলেই আশা।
উত্তরপ্রদেশ, কেরল, রাজস্থান, পঞ্জাব, দিল্লি প্রভৃতি রাজ্য থেকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য এসেছিলেন এই তরুণীরা। তাদের মধ্যে কেউ সশস্ত্র বাহিনীর কর্মীর সন্তান, কেউ শিক্ষক বা সরকারি কর্মচারীর কন্যা। অভিভাবকেরা মেয়েদের পাসিং আউট প্যারেড দেখার জন্য উপস্থিত ছিলেন NDA-তে।
প্যারেডে উপস্থিত হন অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার বৈষ্ণবী তোকেকার, যিনি এই ১৭ জন ক্যাডেটের প্রশিক্ষণের অন্যতম দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার। তিনি জানাচ্ছেন, অভিভাবকদের থেকে কোনও অংশেই কম গর্বিত নন তিনি। উইং কমান্ডার তোকেকার হলেন NDA-র প্রথম মহিলা ডিভিশনাল অফিসার, যিনি মেয়েদের ভর্তি ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এতকাল ধরে যে প্রশিক্ষণকেন্দ্র একটি পুরুষপ্রধান কাঠামো ছিল, সেখানে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলি অন্যান্য অফিসারদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে পরিবর্তন করেন তিনি। ছেলেদের মতোই প্রশিক্ষণ পেয়েছে মেয়েরা, কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে, বিশেষ করে শারীরিক শক্তির নিবিড় প্রয়োজন যেখানে।
আরও পড়ুন- কর্নেল সোফিয়া কুরেশি: একতা ও সম্প্রীতির প্রশ্নে অপারেশন সিঁদুরের মাস্টারস্ট্রোক
তোকেকার বলেন, “যখন একটি মেয়ে, ছেলের সঙ্গে একই প্রশিক্ষণ নেয়, তখনই সে বুঝে যায় যে এই মেয়েটি তার মতনই একজন অফিসার হবে, এবং একদিন তারা একসঙ্গেই যুদ্ধক্ষেত্রে থাকবে। তখন ছেলেদের সব দ্বিধা কেটে যায়।” বর্তমানে আকাডেমিতে ১২৬ জন মহিলা রয়েছে, যারা বিভিন্ন স্কোয়াড্রনে ভাগ হয়ে আছেন। পরবর্তী ব্যাচ ডিসেম্বর মাসে উত্তীর্ণ হবে।
২০২২ সালে যখন মেয়েরা NDA-তে যোগ দেন, তখন তাদের ‘গার্ল ক্যাডেট’ বলা হতো। কিন্তু প্রথম টার্ম থেকে ষষ্ঠ টার্মে উঠতে উঠতে তাদের পরিচয় 'গার্ল'-এ আবদ্ধ ছিল না। “একজন ক্যাডেটের কোনও লিঙ্গ পরিচয় নেই। তারা ছেলেদের সমান এবং অসাধারণ প্রথম ব্যাচ হয়ে উঠেছে,” বলেন তোকেকার।
তিনি জানান, ১০ মিটার উঁচু থেকে ঝাঁপ দেওয়ার প্রশিক্ষণের সময়ের একটি ঘটনা তাঁর গায়ে কাঁটা দেয়। “এই ঝাঁপ দেওয়া হয় পুরো আকাডেমির সামনে। অনেক ক্যাডেটই ভয়ে ঝাঁপ দিতে পারে না, কিন্তু এই মেয়েরা সে ভয় পায়নি। ১৭ জনই একে একে এসে নির্দ্ধিধায় ঝাঁপ দিয়েছে। পুরো আকাডেমি স্তব্ধ হয়ে গেছিল।”
১৪ কিমি ক্রস দৌড়েও উত্তীর্ণ হয়েছে মেয়েরা। তোকেকার আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, “অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে বা ক্লান্তিতে পড়ে যায়, কিন্তু প্রতিটি মেয়ে দৌড় শেষ করেছে। পড়ে গিয়েও উঠে দাঁড়িয়ে আবার দৌড়েছে। আমরা তাদের বলেছিলাম, পাঁচ ঘণ্টা লাগলেও চলবে, কিন্তু হেঁটে বা দৌড়ে নিজেই ফিরে আসবে এবং তারা তাই করেছে। আমাদের অনেক গর্বিত করেছে তারা।”
উল্লেখ্য, সকল ক্যাডেটের মতো মেয়েরাও প্রথমে NDA-র নাপিতের হাতে চুল কাটে। সব ক্যাডেটকে একই রকম ইউনিফর্ম দেওয়া হয়, যাতে ব্যাজ না দেখলে ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না। প্রথমে মেয়েদের আলাদা কোয়ার্টারে রাখা হলেও পরে ছেলেদেরই সঙ্গে বিভিন্ন স্কোয়াড্রনে ভাগ করে দেওয়া হয়। এতেই পরিচয় পায় সংস্থার সমদর্শীতা। তবে মেয়েদের কক্ষগুলো স্কোয়াড্রনের মধ্যে আলাদা একটি অংশে রাখা হয়েছে এবং তাদের জন্য ব্যবস্থা রয়েছে আলাদা বাথরুমের।
আরও পড়ুন- বায়ুসেনার মহিলা পাইলট পাকিস্তানে আটক? ভুয়ো তথ্য ভেঙে সত্যি এল প্রকাশ্যে
ক্যাডেটরা যখন আকাডেমিতে যোগ দেয়, তখন তারা কেবল ১৬, ১৭ বা ১৮ বছরের কিশোরী, একেবারে ‘সামরিক নেতৃত্বের আঁতুরঘর’-এ ছিল তারা। ১৭ জনের মধ্যে ১১ জন নিয়োগও পেয়েছেন। সম্পূর্ণটাই পারফরমেন্সের ভিত্তিতে, লিঙ্গের ভিত্তিতে নয়। 'ফ্লাইং পিন' পেয়েছেন এক মহিলা ক্যাডেট। তিনি কঠিন ক্যাম্প, যেমন ক্যাম্প রোভার ও টোরনা-তেও অংশ নিয়েছেন, অনেক সময় ছেলেদের আগেই পৌঁছে গেছেন। প্রশিক্ষণ চলাকালীনই এক মহিলা ক্যাডেট তাঁর বাবাকে হারান। মাত্র ১৭ বছর বয়সে সেই খবর শুনে তিনি ভেঙে পড়েন, কিন্তু মন শক্ত করে কঠোর প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান।
এমনই অনেক কঠিন পরিস্থিতি মধ্যে দিয়ে গেছে তাদের এই যাত্রা। যেমন এক বাবা নিজের মেয়েকে NDA-তে পাঠাতে ঋণ নিয়েছিলেন। যদিও প্রশিক্ষণ ও থাকার সম্পূর্ণ খরচ NDA বহন করে, কিন্তু যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ পরিবারটির পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিলনা। উইং কমান্ডার তোকেকার ও অন্যান্য অফিসাররা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন পরে টাকা ফেরত দিলেই চলবে। কিন্তু বাবা তাতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, “এটাই আমার দেশের জন্য অবদান, কারণ আমার মেয়ে দেশের সেবা করবে। দয়া করে এটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবেন না।”
এই সাফল্য ভারতীয় সামরিকবাহিনীতে লিঙ্গ সমতার এক বড় পদক্ষেপ। নারীসমাজের বীরত্ব, শক্তি ও দৃঢ়তার স্তম্ভ এই ১৭ জন মহিলা ক্যাডেট।