কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের পকেট ফুলছে, বাংলার বেহাল দশা! কেন্দ্র-রাজ্য ডিএ-র এত কেন ফারাক?

Central State DA Difference : শুধু পশ্চিমবঙ্গেই কি এই সমস্যা? নাকি অন্যান্য রাজ্যের সরকারি কর্মীরাও একই সমস্যায় পড়েছেন?

“আমরা যা দিচ্ছি সেটাই দিন। আমাকে যদি ভালো না লাগে, আমার মাথা কেটে ফেলুন। কিন্তু এর বাইরে, আমি কিছু করতে পারব না।” এই কয়েকটি কথাই এখন বাংলার রাজ্য রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে। বক্তা? খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বাড়ানোর প্রসঙ্গে তাঁর এমন বক্তব্যই কার্যত আগুনে ঘি ঢেলেছে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে ডিএ নিয়ে তরজায় সরকারি কর্মীরা। কেন্দ্রীয় সরকারের মতো রাজ্য কেন ডিএ দিচ্ছে না, এমন দাবি বারংবার উঠেছে। রাজ্য সরকারের কর্মীদের একটা অংশ প্রায় ৪০ দিন ধরে ধর্নাও দিচ্ছেন। সেইসঙ্গে শুক্রবার, ১০ মার্চ ধর্মঘটের ডাকও দিয়েছেন তাঁরা। অবশ্য রাজ্য সরকার ‘ধর্মঘট’-এর ব্যাপারে প্রথম থেকেই কড়া। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। সেইসঙ্গে ডিএ নিয়েও অনড় প্রশাসন।

ডিএ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের এই বিরাট ব্যবধান অবশ্য আজকের নয়। বহু বছর ধরে এই বৈষম্য চলে আসছে। সেদিকে ঢোকার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক এই ডিএ আসলে কী? ডিএ বা ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স আসলে সরকারি কর্মীদের একটি বিশেষ সুবিধা। মূল বেতনের ওপর নির্দিষ্ট হারে একটি টাকা দেওয়া হয়, বর্ধিত ভাতা হিসেবে। যার যেরকম পদ, তিনি সেই পরিমাণে এই বর্ধিত ভাতা পান। বহুদিন ধরে চলা এই বিশেষ নিয়মের পরিবর্তন হয়নি। ঠিক সেভাবে কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের ডিএ-রও পার্থক্য রয়েছে।

এই ফারাকটা কেন?

রাজ্য আর কেন্দ্রীয় সরকার – এই দুটো একেবারেই এক নিয়মে চলে না। প্রশাসনিক দিক থেকে কাজের পরিস্থিতি, ধরনের মধ্যেও কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের স্পেকট্রাম তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই রাজ্যের তুলনায় সেখানকার কর্মীদের বর্ধিত ভাতা বা ডিএ-ও বেশি। এটা ফারাক থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যাটা রয়েছে ফারাকের পরিমাণে। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরা ৩৮ শতাংশ হারে ডিএ পান। সেখানে আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মীরা পেতেন মাত্র ৩ শতাংশ! সম্প্রতি আরও ৩ শতাংশ বাড়িয়ে মোট ৬ শতাংশ বর্ধিত ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তবুও কেন্দ্রের সঙ্গে পার্থক্যটা থেকে যাচ্ছে অন্তত ৩২ শতাংশ! এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন কর্মীরা। তার ওপর ফের একবার কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধির ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। আর এটাই আগুনে ঘি ঢেলেছে।

আন্দোলনরত সরকারি কর্মচারীদের দাবি, AICPI বা অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী, ষষ্ঠ বেতন কমিশনের নিয়ম মেনে ডিএ দিতে হবে। এদিকে রাজ্য সরকার এবং খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবভঙ্গি ও জবাব দেখে নিশ্চয়ই মনে হবে না, শীঘ্রই এর কোনও সুবিধা হবে। তাহলে একপ্রকার ঝুলেই থাকবে এই ডিএ সমস্যা? কিন্তু শুধু পশ্চিমবঙ্গেই কি এই সমস্যা? নাকি অন্যান্য রাজ্যের সরকারি কর্মীরাও একই সমস্যায় পড়েছেন?

পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, অন্যান্য রাজ্যের ডিএ-র হার যথেষ্ট বেশি। তাও পশ্চিমবঙ্গের থেকে কয়েক গুণ বেশি! মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশের সরকারি কর্মীরা যেমন ৩১ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পান। তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশের কর্মীরা পান ৩৪ শতাংশ। কেরলে এই পরিমাণ প্রায় ৩৬ শতাংশ! মোটামুটি বেশিভাগ রাজ্যেই ২৫ শতাংশের ওপর মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয় সরকারি কর্মীদের। সেখানে পশ্চিমবঙ্গ? মাত্র ৬ শতাংশ! আন্দোলন যে একেবারে অমূলক, তা তো বলা যাবে না।

ঠিক কতটা ফারাক?

ধরা যাক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনও এক গ্রুপ সি কর্মচারীর কথা। ২০১৬ সালে যদি প্রায় সাড়ে ২২ হাজার টাকার চাকরিতে ঢোকেন, তাহলে ২০২২-এ সেটা বেড়ে হয়েছে ২৭ হাজার ১০০ টাকা। এবার কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের ডিএ-র ফারাক অন্তত ৩২ শতাংশ। মানে মাসে প্রায় ৮৬৭২ টাকা কম পাচ্ছেন তিনি। বছর গেলে এই সংখ্যাটাই দাঁড়ায় এক লাখেরও ওপর! অথচ এটা তো তাঁর ন্যায্য পাওনা ছিল। ঠিক এরকমই অবস্থা বেশিরভাগ সরকারি কর্মীর। সমস্ত স্তরেই এমন অবস্থা চলছে।

সরকারের দাবি, অনেক দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে আর টাকা নেই। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, রাজ্য সরকারে তো কেন্দ্রের থেকে বেশি ছুটি দেওয়া যায়, তার বেলা? এটা আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত কথা, সেটা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই বলতে পারবেন। কিন্তু এখানেই একটা প্রশ্ন। পুজোর সময় প্রতিটা ক্লাবে টাকা দেওয়া, অজস্র অনুদান – সেই সময় তো টাকা ঠিকই থাকছে। তাহলে সরকারি কর্মীদের ডিএ বা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে কেন এমন ‘টাকার সমস্যা’? নাকি সবটাই সদিচ্ছার অভাব!

More Articles