দিল্লি দূষণ: প্রতিবাদ করতে গিয়ে কণ্ঠরোধ?

Delhi’s Air Pollution: গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, দিল্লির বাতাস আবারও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। সরকারী পরিসংখ্যান এটিকে 'খুব খারাপ' হিসাবে বর্ণনা করলেও কিন্তু আমরা সকলেই অস্বীকারের ভাষাটাও চিনি।

সকালে উঠে মোবাইল খুললেই, আজকাল গুগল আবহাওয়ার পূর্বাভাসের পরিবর্তে বাতাসের দূষণের মাত্রা দেখাচ্ছে, যার পোশাকি নাম— এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স। প্রতিদিনই দেখাচ্ছে কলকাতার দূষণের মাত্রা ভয়ঙ্কর। যদিও আমাদের খুব বেশি হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। তবুও কখনও কখনও মনে হচ্ছে দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে, নিশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে। কলকাতায় যখন এই রকম পরিস্থিতি, তখন দিল্লি থেকে খবর আসছে দিল্লির পরিবেশ আরও ভয়ানক। মানুষ রাস্তায় বেরোতে পারছে না, বাচ্চারা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না। অফিস আদালতের অবস্থাও তথৈবচ। প্রশাসন অর্থাৎ দিল্লির সরকারের তরফ থেকে জল ছেটানো হচ্ছে, যাতে দূষণকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেখানে যেখানে দূষণ মাপার যন্ত্র আছে, সেখানে বেশি চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে দূষণের মাত্রা কিছুটা হলেও কম দেখানো যায়; যেন ওই সংখ্যা দেখলে মানুষের অস্বস্তি কিছুটা কমে যাবে।

দিল্লির এই বায়ুদূষণ কিন্তু এই বছরে প্রথম অনুভব করা যাচ্ছে এমনটা নয়। গত ৫ থেকে ৭ বছর ধরে প্রত্যেক শীতেই দিল্লির মানুষ এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যে সময়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়ে তিনি অভিযোগ করতেন দিল্লির পার্শ্ববর্তী হরিয়ানা এবং পঞ্জাবে অতিরিক্ত খড় পোড়ানোকে দায়ী করতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল ধান কেটে নেওয়ার পরে, যে ধান গাছের খড় থাকে, তা পোড়ানোর জন্যেই দিল্লির আকাশ বাতাস এইরকম দূষিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে পঞ্জাবে যখন আম আদমি পার্টির সরকার হয়, তখন বিজেপি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিকেই আঙুল তোলা শুরু করে। আগে তো না হয় পঞ্জাবে এবং হরিয়ানায় বিজেপি’র সরকারের দিকে কেজরিওয়াল অভিযোগের আঙুল তুলতেন, এখন তাহলে কী বলবেন? দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি’র অন্যতম যে দু'টো প্রতিশ্রুতি ছিল; তার অন্যতম ছিল তাঁরা দিল্লিতে বায়ু দূষণ কমাবেন এবং যমুনাকে পরিশ্রুত করবেন। যথারীতি দু'টো প্রতিশ্রুতির একটাও তারা রাখতে সক্ষম হয়নি। উল্টে যমুনাকে পরিষ্কার দেখানোর উদ্দেশ্যে তারা নদীর পাশেই একটি বড় জলাশয় কেটে, পাইপ করে সেই জলাশয়ে পরিষ্কার জল ঢেলে তাতে প্রধানমন্ত্রীকে ছট পুজোর সময়ে সেইখানে স্নান করানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন। পরে তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে খবর হওয়ার পরে, বিষয়টি স্থগিত রাখা হয়। দিল্লি শহরের এই দূষণ প্রতি বছর বাড়ছে। দিল্লি শহরের প্রতিটি শিশু বিশেষজ্ঞ ইদানিং বলছেন, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ এখন স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বেশি দিন নেই এই রোগে ভারতের রাজধানীর প্রতিটি শিশু আক্রান্ত হবে।

আরও পড়ুন

ইতালিতে ভয়াবহ দূষণ ছড়ানো কারখানা এবার ভারতে?

এই অসম্ভব অবস্থার জন্য কে দায়ী, তা কিন্তু দিল্লির নাগরিকদের জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাঁরা চান একটা সুস্থ পরিবেশ, যেখানে সমস্ত শিশু একটু প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারবে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, দিল্লির বাতাস আবারও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। সরকারী পরিসংখ্যান এটিকে 'খুব খারাপ' হিসাবে বর্ণনা করলেও কিন্তু আমরা সকলেই অস্বীকারের ভাষাটাও চিনি। যতই সরকারের তরফ থেকে দূষণের মাত্রা কমিয়ে দেখানো হোক, বাচ্চাদের বাবা-মা এবং নাগরিকরা তাঁদের চোখ দিয়ে কিন্তু ধোঁয়াশা দেখতে পাচ্ছেন এবং তাঁদের ফুসফুসে অনুভব করতে পারছেন; যে বাতাস ফুসফুসে নিশ্বাস হিসেবে ঢুকছে তা তো সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

গত ৯ নভেম্বর দিল্লির ইন্ডিয়া গেট চত্বরে তাই বেশ কিছু মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন। তার মধ্যে যেমন ছিলেন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা, সাংবাদিকেরা, তেমনই ছিলেন সাধারণ নাগরিকেরা যাঁরা প্রতিনিয়ত এই দূষণের শিকার হচ্ছেন। কেউ কিন্তু সংগঠিত করেনি এই জমায়েত। সবাই নিজের বাঁচার তাগিদেই জড়ো হয়েছিলেন। দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে বারংবার প্রশ্ন করা হয়েছে কারা এই আন্দোলনের পিছনে আছে? এক স্বাধীন গবেষক এবং ৭ বছরের এক সন্তানের মা হিসেবে নম্রতা যাদব একটি ইংরেজি দৈনিকে লিখেছেন,

তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছে দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে; তিনি বলেছেন, তিনি বাঁচার তাগিদেই এসেছেন, কারও আহ্বানে আসেননি। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে একটাই আর্তি— ইন্ডিয়া গেট শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের স্থান, সেই জায়গাকে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে কেন ঘেরা? মানুষের সুস্থ বাতাস নেওয়ার জন্য অহিংস আন্দোলন করা কি অন্যায়? তা কি আইনত অপরাধ?

একদিকে নিশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে গলা টিপে ধরা হচ্ছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা ওই জমায়েতে দাঁড়িয়ে বলেন,

বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের রাজধানীতে মানুষকে এখন হাতে ওষুধ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে, যাতে একটু নিশ্বাস নিতে পারা যায়। এই বায়ুদূষণ এখন আর কেবল একটি পরিবেশগত সংকট নয়; এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা। তবুও, আমাদের দূষণ প্রতিক্রিয়ায় স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও কোনও কথা হয়না।

আরও পড়ুন

কপ ৩০-এর প্রতি আবেদন: বাসযোগ্য ভবিষ্যতের জন্য, বড় দূষণকারীদের তাড়িয়ে দিন

ইন্ডিয়া গেটে যে যে অভিভাবকরা গিয়েছিলেন এবং যা দাবি করেছিলেন তা কিন্তু কোনো বৈপ্লবিক দাবী নয়; এই দাবী কিন্তু অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। ওই সমাবেশ থেকে একটি স্বাধীন বায়ু গুণমান এবং জনস্বাস্থ্য কমিশনের দাবি উঠে এসেছিল যাঁদের হতে হবে স্বশাসিত। বিশেষজ্ঞ-নেতৃত্বাধীন ওই সংস্থা যেন সংসদের কাছে জবাবদিহি করে, কোনো রাজনৈতিক চক্রের কাছে যদি তাঁরা এই প্রশ্ন নিয়ে যায় তাহলে তার কোনো মূল্য থাকবে না। দাবী উঠেছে এমন একটি সংস্থা যা বিশুদ্ধ বায়ুর মান নির্ধারণ এবং প্রয়োগ করবে, স্বচ্ছতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করবে এবং সততার সাথে মানুষের কাছে সেই তথ্য পৌঁছে দেবে। ওই স্বশাসিত সংস্থা যেন সব সময়ে এই বায়ু দূষণের তথ্য রাখে এবং তা নাগরিক এবং গবেষক উভয়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়; কারণ যদি ওই তথ্য অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন এর সঙ্গে সেই জবাবদিহি করার মানসিকতাও অদৃশ্য হয়ে যায়।

যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির শেষ দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যদিও প্রসঙ্গ হয়ত আলাদা, কিন্তু একজন মানুষের বাঁচার আর্জি সেদিন একরকম ছিল আজও আছে আরেকরকম, কিন্তু বিষয়টা একই আছে।

“দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম!

দাদা, আমি যে সত্যি সত্যিই বাঁচতে চেয়েছিলাম!”

একজন মানুষ তো বাঁচতে ভালোবাসেন, তার চেয়ে বড় ভালবাসা তো কিছু হতে পারে না। জীবন তো সবচেয়ে বড় চাওয়া। সেই বাঁচার আর্তি নিয়ে বা দাবী নিয়ে কোনো মানুষ যদি পথে নামেন তার পরিণতি কী হতে পারে, তা সেদিন দিল্লির মানুষ দেখেছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে, শান্তিপূর্ণভাবে আসা ওই নাগরিকদের আটক করা হয় এবং পুলিশের আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে হয়, যা কখনোই কাম্য নয়। এই ধরনের কর্মকাণ্ড কেবল আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের উপর নয়; বরং রাষ্ট্রের উপর আস্থা নষ্ট করে। এতে শেষ বিচারে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশি, তা শুধু পরিবেশের জন্য নয়, গণতন্ত্রের জন্যেও।

 

More Articles