মহিলাদের খেলা থেকে কেন রূপান্তরকামীদের নিষিদ্ধ করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প?
Donald Trump Bans Trans Athletes: তাহলে রূপান্তরকামী ক্রীড়াবিদরা কি খেলাধুলো থেকে বাদ পড়ে গেলেন? নাকি ট্রাম্প প্রশাসন ট্রান্সজেন্ডার ক্রীড়াবিদদের জন্য আলাদা বিভাগের কথা ভাবছে?
শাসকই ঠিক করে কে কী খাবে, কে কী পরবে, কে কতটা ধর্মাচারণ কীভাবে করবে। কে কতখানি প্রতিবাদ করবে আর কতখানি স্তাবকতা— সবটাই ঠিক করে দেয় ক্ষমতায় থাকা শাসক। শুধু ভাষা-পোশাক-খাবার নয়, মানুষের যৌন পছন্দ, যৌন পরিচয়ও ঠিক করে দেয় শাসকই। যেমন দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! তিনি ঠিক করে দিয়েছেন, কোন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষ খেলাধুলো করবে, কারা করবে না। ট্রান্সজেন্ডার খেলোয়াড়দের মহিলাদের খেলাধুলোয় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার আদেশে সই করে দিয়েছেন ট্রাম্প। আদেশের শিরোনাম 'কিপিং মেন আউট অফ উইমেন স্পোর্টস'। অর্থাৎ ট্রাম্প বিশ্বাস করছেন, সেক্স ও জেন্ডার আসলে একই। জন্মের সময় কেউ যে নির্ধারিত লিঙ্গ নিয়ে জন্মাচ্ছে সেটি তার বায়োলজিক্যাল সেক্স। কিন্তু জেন্ডার সামাজিক, সমাজে নির্দিষ্ট লিঙ্গ পরিচয়ের জন্য কোনও মানুষের সঙ্গে কী কী বৈষম্য করা হয় তা জেন্ডার চর্চার গুরুত্বপূর্ণ দিক। ট্রাম্প এত সূক্ষ্ম ফারাকের, এত সংবেদনশীলতার ধারও ধারেন না। তিনি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্প বলছেন, "এই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে, মহিলাদের খেলাধুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধের অবসান হলো।" আইননির্মাতাদের পাশাপাশি বহু মহিলা ক্রীড়াবিদও এই নিষেধাজ্ঞারকে সমর্থন করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে আলজেরিয়ার কুস্তিগীর ইমানে খালিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। তিনি ছিলেন রূপান্তরকামী, আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শারীরিকভাবে একজন মহিলা। তখন ব্যাপক তর্ক ওঠে, কীভাবে রূপান্তরকামী মহিলা জন্মগতভাবে একজন মহিলার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন?
আরও পড়ুন- এক ঘুষিতেই রক্তারক্তি! মহিলাদের অলিম্পিক বক্সিংয়ে ইমানে খেলিফ সত্যিই পুরুষ?
ট্রাম্প বরাবরই প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। এই নতুন আইনে লেখা আছে, যে সমস্ত স্কুল ট্রান্সজেন্ডার অ্যাথলিটদের প্রতিযোগিতায় নামার অনুমতি দেবে, সেই স্কুলগুলিকে শাস্তি দেবে শিক্ষা বিভাগ। এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে সেই স্কুল সরকারের কোনও সাহায্যই পাবে না। ২০২৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে হতে চলেছে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক। তার আগে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিকে সতর্ক করে দিয়েছেন ট্রাম্প যাতে এই সংক্রান্ত নিয়ম বদলে নেয় আইওসি। লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক গেমসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করছেন এমন ট্রান্সজেন্ডার অলিম্পিক ক্রীড়াবিদদের ভিসা প্রত্যাখ্যান করবেন ট্রাম্প। বলেছেন, "পুরুষরা পরিচয় ভাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করলে এবং নিজেকে মহিলা হিসাবে নিজেকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলে সমস্ত ভিসা আবেদন বাতিল করে দেওয়া হবে।”
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, "আমেরিকা স্পষ্টতই 'রূপান্তরকামীদের নিয়ে পাগলামি'-কে সমর্থন করে না৷" প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, আমেরিকায় মানুষের দু'টিই যৌন পরিচয়। সরকারের খাতায় একজন মানুষের কেবল দু’টিই লিঙ্গ পরিচয় হতে পারে— হয় সেই ব্যক্তি পুরুষ অথবা তিনি স্ত্রী। অর্থাৎ সরকার যা যা পরিচয়পত্র দেয়, নথিপত্র দেয়, পাসপোর্ট, ভিসা এবং অন্য সব সরকারি নথিপত্রে পুরুষ এবং মহিলা— এই দু’টি লিঙ্গেরই উল্লেখ থাকবে। নির্দেশ অনুসারে, শারীরিক দিক থেকে যে মানুষ যে লিঙ্গের, সেটিরই উল্লেখ থাকবে সরকারি নথিতে, এর বাইরে যৌন পরিচয় নেই। উল্লেখ্য, সরকারি নথিতে রূপান্তরকামীদের জন্য পৃথক লিঙ্গপরিচয় নিয়ে নীতি চালু করেছিলেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় এসেই ওই নীতি বদলে ফেলতে উদ্যোগী হন।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, ‘‘আমরা মেয়েদের খেলাধুলোর ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে চাই। আমরা পুরুষদের মেয়েদেরকে মারধর কিংবা জখম করতে দেব না। এখন থেকে মেয়েদের খেলা শুধু মেয়েদেরই।’’ তাহলে রূপান্তরকামী ক্রীড়াবিদরা কি খেলাধুলো থেকে বাদ পড়ে গেলেন? নাকি ট্রাম্প প্রশাসন ট্রান্সজেন্ডার ক্রীড়াবিদদের জন্য আলাদা বিভাগের কথা ভাবছে? আলাদা বিভাগ সম্ভব না কারণ আমেরিকার প্রশাসনিক নীতিতে পুরুষ আর মহিলা বাদে কোনও লিঙ্গ পরিচয়ই নেই। তাহলে ধরে নেওয়া যায় ট্রান্সজেন্ডাররা বাদ। এর আগে একাধিক রিপাবলিকান শাসনে থাকা রাজ্যে রূপান্তরকামী ক্রীড়াবিদদের খেলায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। সেই সব আইনের বিরুদ্ধে লড়াইও হয়েছে। সুতরাং ট্রাম্পের এই নির্দেশও বিরোধিতার মুখে পড়বে বলেই বিশ্বাস রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
আরও পড়ুন- রূপান্তরকামী সন্তানকে নিয়ে গর্বিত বাবা, ভারতীয় অভিভাবকরা শিখবেন?
২০২০ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় অনুসারে, ট্রান্সজেন্ডারদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হচ্ছে লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের সামিল, যা আইনত নিষিদ্ধ। এই আইনেই কর্মসংস্থানে বৈষম্যকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনে শিক্ষায় লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যকে নিষিদ্ধ৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রান্সজেন্ডার ও মহিলাদের শনাক্ত করা কঠিন। কারণ এতে লিঙ্গ পরীক্ষা করতে হবে, 'বডি পুলিশিং' চলবে। একজন পড়ুয়াদের লিঙ্গ পরিচয় তাদের জেনেটিক মেকআপ, প্রজনন শারীর সংস্থান বা প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত টেস্টোস্টেরনের মাত্রার উপর নির্ভর করে যাচাই করা যেতে পারে। টেস্টোস্টেরন পরীক্ষা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিভিন্ন মানব শরীর কীভাবে হরমোন ব্যবহার করে তার পার্থক্য থাকে। ফলে কে পুরুষ আর নারী নয় তা যাচাই করার কোনও মাপকাঠি নেই তেমন।
একটি বিবৃতিতে, মানবাধিকার প্রচারণার সভাপতি কেলি রবিনসন বলেছেন, যে এই আদেশ যুবদের হেনস্থা এবং বৈষম্যের মুখোমুখি করছে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে যে শিশুদের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়, একজনের পোশাক বা চেহারা কেমন হবে সে সম্পর্কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকেই তোল্লাই দিচ্ছে এই আদেশ। তিনি বলছেন, অনেক শিশুই খেলাধুলোর ময়দানে নিজের জায়গা খুঁজে পায়, স্বতন্ত্র পরিচয় খুঁজে পায়। সেখানে এমন পক্ষপাতমূলক নীতি তাদের জীবনকে কঠিন করে তুলবে। উল্লেখ্য, ইউসিএলএ উইলিয়ামস ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ বছরের বেশি বয়সি জনসংখ্যার ১% এরও কম ট্রান্সজেন্ডার আছেন এবং এদের মধ্যে আবার খেলাধুলোয় আগ্রহীর সংখ্যা আরও কম।