রণক্লান্ত দামাল মেয়েদের শুশ্রূষার আলো হরিণী মুরলী
Harini Murali: তিনটি মহিলা প্রিমিয়ার লিগ মরশুম ধরে রয়াল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু শিবিরেও তিনি একইভাবে ছিলেন মেরুদণ্ডের মতো। ২০২৪ সালে আরসিবি যখন শিরোপা তুলল, আলো জ্বলে উঠেছিল স্মৃতি, রেনুকা, এলিস-পেরির উপর।
মাসটা অক্টোবর। ভারত-ইংল্যান্ডের সেই মহিলা ক্রিকেট ম্যাচ। স্কোরবোর্ড বলেছিল চার রানের পরাজয়ের কথা। দলের জয় হয়নি। তবে সেই দিন দলের এক অদৃশ্য শক্তির জন্মদিন। সেই অদৃশ্য শক্তির চোখে প্রতিটি মুহূর্তে ছিল শিক্ষা।
কোনো বিকট উল্লাস তাঁর নেই, তবু তাঁর উপস্থিতি দলের ধমনি-শিরায় স্পষ্ট। তিনি টিম ডাক্তার হরিণী মুরলী। দলের পরাজয়কে যেমন তিনি নেন শান্তভাবে, তেমনই জয়কেও দেখেন আলো ছায়ার জটিলতায়।
মাঠে ক্রিকেটাররা ছক্কা হাঁকান, উইকেট নেন, রেকর্ড গড়েন। গ্যালারির চোখ, ক্যামেরার শাটার, মন্তব্যকারীদের বিশ্লেষণ সবকিছুই থাকে তাঁদের কেন্দ্র করে। কিন্তু যাঁরা খেলোয়াড়দের পাশে থাকেন, চোটে ব্যথায় হাত রাখেন, ক্লান্ত শরীর-মনকে শান্ত রাখেন তাঁরা থাকেন নেপথ্যে। ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলের ২০২৫ সালের ওডিআই বিশ্বকাপ জয়ের গল্পেও তেমনই এক চরিত্র হরিণী মুরলী।
হরিণীর জন্ম চেন্নাইতে। ডাক্তার পরিবারের মেয়ে। এমবিবিএস শেষ করেন সাভেতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এমবিবিএস শেষ করার পর বড় প্রশ্ন চিকিৎসা করবেন, না খেলাধুলার ময়দানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রয়োগ শিখবেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সায়েন্সে উচ্চশিক্ষার সময়। মানবদেহ শুধু জীববিদ্যার বিষয় নয়, মন, ধৈর্য, চাপ সবকিছু মিলেই একজন অ্যাথলিট। এই উপলব্ধিই তাঁকে টেনে আনে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলে।
আরও পড়ুন
ফুটবল শুধু ফুটবল নয়, প্রতিরোধের ভাষালিপিও বটে
হরিণীর কাজ শুধু ব্যথার জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধা নয়। দলের প্রতিটি সফর, দীর্ঘ পথ, ঘন ঘন ম্যাচ-খেলোয়াড়দের শরীর-মনকে ক্ষয় করে। ব্যাটার হোক বা বোলার প্রতিটি অ্যাথলিটের ভরসার জায়গা তিনি। কার কতখানি বিশ্রাম দরকার, কার শরীর ক্লান্তির কোন স্তরে পৌঁছচ্ছে, কে মানসিক চাপে ভেঙে পড়ছে হরিণীর নরম কিন্তু স্পষ্ট পর্যবেক্ষণই কিছুই নজর এড়ায় না।
তিনটি মহিলা প্রিমিয়ার লিগ মরশুম ধরে রয়াল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু শিবিরেও তিনি একইভাবে ছিলেন মেরুদণ্ডের মতো। ২০২৪ সালে আরসিবি যখন শিরোপা তুলল, আলো জ্বলে উঠেছিল স্মৃতি, রেনুকা, এলিস-পেরির উপর। কিন্তু দলের অন্দরমহলে স্পষ্ট ছিল জয় মানে শুধু স্কোরকার্ড নয়, সুস্থ দেহ, প্রশান্ত মনে সংযুক্ত দলগত পথচলাটাই জয় আর সেই জয়ের চাবিকাঠি হরিণী।
বিশ্বকাপের দিনগুলির কথায় ফিরে যাই। ফাইনালের আগের সন্ধ্যা। হেড কোচ অমল মুজুমদারের এক সরল বাক্য, "এবারও ফল ভালো হবে।” হয়ত কারও কাছে এটি সাধারণ অনুপ্রেরণা। কিন্তু হরিণীর কাছে সেটিই ছিল দলের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে রাখা নীরব প্রদীপ।
আরও পড়ুন
শুধু ক্রিকেট নয়, খেলা ঘুরছে ফুটবল মাঠেও, নেপথ্যে অভীষ্টারা
যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স করার সময় তিনি দেখেছেন খেলোয়াড়দের যত্নের পদ্ধতি ও পরিপক্বতার ভিন্ন মানচিত্র। সেখানে স্পোর্টস সায়েন্সের কাঠামো সুসংগঠিত। অন্যদিকে, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বহুদিন কোচই সবকিছু সামলাতেন। চোট, অসুস্থতা, প্রশিক্ষণ। কিন্তু ধীরে ধীরে ভারতও বদলেছে। এখন ফিজিও, স্ট্রেংথ ও কন্ডিশনিং কোচ, স্পোর্টস সাইকোলজিস্টরা দলের সঙ্গে কাজ করছেন। কোভিড-১৯ অতিমারি যেন এই রূপান্তরকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
খেলোয়াড়রা এখন নিজেদের শরীর সম্পর্কে সচেতন। চোট লুকিয়ে খেলার সেই পুরনো বীরগাথার জায়গায় এসেছে নিজের শরীর ও মনের প্রতি দায়িত্ববোধের নৈতিকতা।
হরিণীর গল্প তাই শুধু একজন ক্রীড়া চিকিৎসকের নয়, এক ‘মৌন নেতৃত্বের’ কাহিনি। যে নেতৃত্ব চিৎকার করে না, জয়গান দাবি করে না, কিন্তু দলের মেরুদণ্ডকে দৃঢ় করে তোলে। তাঁর কাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো খেলোয়াড়দের সাফল্য কেবল ফিটনেস বা দক্ষতার উপর নির্ভর করে না। ভালো ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা, সমর্থন, মানসিক প্রস্তুতিই জয়ের বাস্তব ভিত্তি। হরিণী মুরলী তা প্রমাণ করেছেন।
তবে, শুধু একা হরিণী নন। এরকম শত শত হরিণী মুরলী আছেন। শুধু ক্রিকেটে নয়, বিভিন্ন খেলায়,তবে মঞ্চের বাইরে। সাফল্য গুলো তাদেরও। বলা হয় স্বাস্থ্যই সম্পদ। আর আর অদৃশ্য শক্তিরা সেই সেই সম্পদের রক্ষাকর্তা।
Whatsapp
