কে কাকে টাকা দিয়েছে গোপনই, তবু ইলেক্টোরাল বন্ডের যে তথ্যে ঝড়
Electoral Bonds Data: তবে শেষপর্যন্ত সামনে এসেই গেল ইলেক্টোরাল বন্ডের সেই বিস্ফোরক তথ্য। আর সেই বন্ডের মাধ্যমে অনুদানের সেইসব অঙ্ক দেখে চোখ কপালে ওঠারই জোগার।
লোকসভা ভোটের মুখে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে কেন্দ্র সরকার। তাদের ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প বেআইনি বলে দাগিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। চাওয়া হয়েছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার তরফে ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় নথিও। তারপরে টালবাহানা করে জুনের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আদালতের কাছে সময় চেয়েছিল বটে এসবিআই। তবে সে প্রচেষ্টা সফল হয়নি। যে কোনও সময় ঘোষণা হয়ে যেতে পারে ভোটের দিনক্ষণ। জুন মাসে তো মন্ত্রিসভাই গঠন হয়ে যাওয়ার কথা। সেসময় আর নথি প্রকাশ করে হবেটাই বা কী! গত সোমবারই সুপ্রিম কোর্টের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, ১৫ মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে নির্বাচনী বন্ডের তথ্য। পাশাপাশি এসবিআইকে শীর্ষ আদালত জানায়, একদিনের মধ্যেই কমিশনের হাতে তুলে দিতে ওই সংক্রান্ত নথি। এরপর আর কালবিলম্ব করেনি স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। নির্ধারিত সময়েই তা এসেছে নির্বাচন কমিশনের হাতে, এবং তা প্রকাশিত হয়েছে তাদের ওয়েবসাইটে। যার ফল স্বরূপ দেশবাসীর হাতে হাতে ঘুরছে এখন ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনীতিক অনুদানের অঙ্ক-রা।
সিএএ বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে আরও নানা 'শাক' দিয়েই 'মাছ' ঢাকার চেষ্টা করেছে বিজেপি সরকার। তবে শেষপর্যন্ত সামনে এসেই গেল ইলেক্টোরাল বন্ডের সেই বিস্ফোরক তথ্য। আর সেই বন্ডের মাধ্যমে অনুদানের সেইসব অঙ্ক দেখে চোখ কপালে ওঠারই জোগার। কয়েক লক্ষ বা কয়েক কোটি নয়, কার্যত হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে এই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প রয়েছে। সেখানে রয়েছে একাধিক ছোটো-বড় সংস্থার নাম। তার মধ্যে কিছু চেনা, কিছু অচেনা। শুক্রবারের মধ্যেই এই তথ্য় প্রকাশ্যে আনার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট । তার একদিন আগেই তথ্য প্রকাশ্যে এল। মোট দু’টি নথি জমা দেওয়া হয়েছে । ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইটে দু'টি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ৩২৭ পাতার একটি নথিতে যেসব কোম্পানি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক অনুদান দিয়েছেন, তাদের নাম, অনুদানের পরিমাণ ও অনুদানের তারিখ রয়েছে। ৩২৭ পাতার অন্য তালিকায় রয়েছে রাজনৈতিক দলের নাম, যারা অনুদান পেয়েছে। সেই অনুদানের তারিখ ও অনুদানের পরিমাণ। তবে কোন সংস্থা বা ব্যাক্তি কোন দলকে অনুদান দিয়েছে, তা খুঁজে বের করার উপায় নেই এসবিআইয়ের তথ্য থেকে।
আরও পড়ুন: ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে সাধারণ জনগণের কিছুই এসে যায় না
এসবিআইয়ের দেওয়া তথ্য ও নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া নথি অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মূল্যের ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছে ফিউচার গেমিং এবং হোটেল সার্ভিসেস পিআর নামে দু'টি সংস্থা। তারা ১,৩৬৮ কোটি টাকার বন্ড কেনে। তার পরেই রয়েছে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচারস লিমিটেড। তারা কিনেছে ৯৬৬ কোটি টাকার বন্ড। প্রায় ৪১০ কোটি টাকার অনুদান দিয়েছে কুইক সাপ্লাই চেইন প্রাইভেট লিমিটেড। বেদান্ত লিমিটেড দিয়েছে ৪০০ কোটি, হলদিয়া এনার্জি লিমিটেড কিনেছে ৩৭৭ কোটি টাকার বন্ড। ওই তালিকায় বন্ড কেনার হিসেবে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে ভারতী গ্রুপ। সে দিয়েছে ২৪৭ কোটি, তার পরে আছে এসেল মাইনিং অ্যান্ড ইন্ডস লিমিটেড, যারা কিনেছে ২২৪ কোটি টাকার বন্ড। ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড, কেভেনটার ফুডপার্ক ইনফ্রা লিমিটেড এবং মদনলাল লিমিটেড- এই তিনটি সংস্থাও রয়েছে দশ সর্বোচ্চ অনুদানকারীর তালিকায়।
বিজেপি, কংগ্রেস ছাড়াও অনুদানপ্রাপ্ত দলগুলির মধ্যে রয়েছে তৃণমূল, এএপি, সমাজবাদী পার্টি, এআইএডিএমকে, বিআরএস, শিবসেনা, টিডিপি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, ডিএমকে, জেডিএস, এনসিপি, জেডিইউ এবং আরজেডির মতো দলগুলি। ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কী কী পরিমাণে টাকা পেয়েছে সেই তথ্যই রয়েছে এখানে । ১ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের তথ্য দেওয়া হয়েছে এই নথিতে। আর সেখানে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রত্যাশা মতো সবচেয়ে বেশি অর্থ পেয়েছে বিজেপিই। বৃহস্পতিবার ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরে কমিশন আরও একবার নিজেদের স্বচ্ছতা প্রমাণ করেছে বলেই দাবি করা হয়েছে তাদের তরফে। এদিন কমিশনের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘ভারতের নির্বাচন কমিশন ধারাবাহিকভাবে এবং স্পষ্টভাবে প্রকাশ এবং স্বচ্ছতার পক্ষেই সায় দিয়েছে।’
আরও পড়ুন:ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক তহবিলে কোটি কোটি টাকা! কত পেল বিজেপি?
লোকসভা নির্বাচনের আগে ইলেক্টোরাল বন্ড ঘিরে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এই বন্ড চালুর পর থেকেই অনেকেই প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। সমাজকর্মী থেকে শুরু করে আইনজ্ঞদের অনেকেরই ধারণা ছিল, এই ব্যবস্থা চালু হলে রাজনীতি আরও বেশি করে অস্বচ্ছ হয়ে উঠবে। কালো টাকার লেনদেন আরও বাড়বে দেশের রাজনৈতিক আঙিনায়। এই বন্ড বাতিল করার দাবিতে শীর্ষ আদালতে জনস্বার্থ মামলা হয়। মামলার শুনানির সময় এসবিআইয়ের বন্ড সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে পাঠায় । সর্বোচ্চ আদলতে সেই তথ্য দিতে সমস্য়ার মুখে পড়ে দেশের অন্যতম সেরা ব্যাঙ্ক । শেষমেশ আদালত চূড়ান্ত সময়সীমা বেধে দিয়েছিল। ১২ মার্চ বিকেল ৫টার মধ্যেই ওই তথ্য জমা করার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। পাশাপাশি ১৫ মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকেও নিজের ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর সেই নির্ধারিত সময়ের আগেই তা শেষ হল। বিজেপি সরকারের এই ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতির প্রভাব কি পড়তে চলেছে আসন্ন লোকসভা ভোটে। এক লক্ষ থেকে এক কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড শয়ে শয়ে কিনেছে যেসব সংস্থা, তাদের আয়ের উৎসই বা কী? কেনই বা তারা রাজনৈতিক দলগুলিকে এত এত টাকা দিল? কোন উপকার বা সুবিধার বিনিময়ে এত কোটি কোটি টাকার অনুদান? লোকসভা ভোটের ঠিক আগে উঠে গিয়েছে এমনই একাধিক প্রশ্ন।