হু হু করে বাড়ছে মানসিক অসুখে আক্রান্ত! কোন চরম পরিণতির দিকে এগোচ্ছে ভারত
Mental Health: জীবনসংগ্রামে হেরে গিয়ে ভারতে আত্মঘাতী হওয়ার সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ।
মন নিয়ে ভারতে সেই প্রাচীনকাল থেকে ধর্মীয় পরিসরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু অতীতের সেই মহান শিক্ষা জনজীবনে সেভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এর কারণও বহুমাত্রিক। এই মুহূর্তে ঠিক কতজন ভারতীয় নাগরিক মানসিক উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন, সেই সংখ্যাটা জানলে চোখ কপালে উঠবে। শুধু ভারতই নয়, পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য সাধারণ মানুষ মানসিক উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন। এদিকে মানসিক এই সঙ্কট থেকে উদ্ধারের পথ দেখাতে নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক সাইক্লিয়াটিস্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতে প্রতি এক হাজার নাগরিক পিছু রয়েছেন মোটে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।
বলাবাহুল্য, ভারতের পরিস্থিতি অতীব সঙ্গীন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, ভারতে ৫ কোটিরও বেশি নাগরিক উদ্বেগজনিত নানা ধরনের মানসিক অসুখের শিকার। এছাড়া ভারতের ৩ কোটিরও বেশি মানুষ মনের দুশ্চিন্তার ফলে নানা ধরনের জটিল অসুখের শিকার।
উদ্বেগজনক বিষয় হল এই যে, সারা পৃথিবীর ভিতর ভারতের নাগরিকরা উত্তরোত্তর নানা মানসিক সমস্যায় জর্জরিত। এই সমস্যা গত ২০২০ সালের পর থেকে ক্রমশই বেড়ে চলেছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: আজকের ভারতেও বহাল লজ্জার দাসপ্রথা! শিউরে উঠতে হবে বাস্তব জানলে
হতাশা কিংবা উদ্বেগের নিরিখে সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেশের যে রাজ্যগুলিতে সেই রাজ্যগুলির মধ্য রয়েছে কেরল, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, মনিপুরের মতো উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গেও পরিস্থিতি তথৈবচ।
সমীক্ষায় এও দেখা গিয়েছে, ভারতে মহিলাদের তুলনায় পুরুষেরা মানসিক দুশ্চিন্তা কিংবা হতাশায় বেশি বেশি করে ভুগছেন। ৩ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন আর ৩ শতাংশ মহিলা এক্ষেত্রে একই সমস্যার শিকার।
এদিকে ভারতীয় সমাজে মানসিক সমস্যাগুলো এখনও তেমন পাত্তা পায়নি। বিষয়টা অবহেলিত থেকে গিয়েছে। এর ফলে সমস্যা ক্রমশ জটিলতর হচ্ছে। আর এর কুপ্রভাব পড়তে চলেছে ভারতীয় অর্থনীতিতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র পরিসংখ্যান অনুসারে, মানসিক ব্যাধিজনিত উদ্বেগ, হতাশা ভারতে উত্তরোত্তরভাবে যে্ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বিপুল পরিমাণ টাকার আর্থিক ক্ষতি হতে চলছে। এই আর্থিক পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ০৩ ট্রিলিয়ন ডলার বলে অনুমানসাপেক্ষ।
মানসিক যে উদ্বেগ কিংবা হতাশায় ভুগছেন অসংখ্য মানুষ এর কারণ কেবল আর্থিক সংকটই নয়। শৈশব কিংবা কৈশোরে যৌননিগ্রহের শিকার হওয়ার ফলে একাংশ মানসিক হতাশা কিংবা দুশ্চিন্তার শিকার। স্বেচ্ছসেবীদের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, শৈশব-কৈশোরে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ৮ শতাংশের বেশি মেয়ে এবং ৫ শতাংশের বেশি ছেলে মানসিক উদ্বেগজনিত অসুখ কিংবা তীব্র হতাশার শিকার। এর জেরে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
ডাক্তারবাবুরা জানিয়েছেন, মানসিক উদ্বেগে ভোগার ফলে যে সমস্যাগুলি দেখা দেয় এর অন্তর্গত মনের অস্থিরতা থেকে শুরু করে রক্তচাপ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ভারতে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন যে সমস্ত নাগরিক তাঁদের মধ্যেও উদ্বেগজনিত অসুখের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। ম্যাকিনসের একটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গিয়েছে, ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মস্থলের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাখ কোবিন্দও এই গুরুতর সমস্যা নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করেছিলেন 'ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ফর মেন্টাল হেলথ'-এ। এব্যাপারে 'ম্যাকিনসে হেলথ ইন্সটিটিউট'-এর তরফে যে সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে তাতে দেখা গিয়েছে, অফিস-কাছারিতে চাকরি-বাকরি করছেন এমন প্রতি ১০জনের মধ্যে ৪জনই বিরক্তি, উদ্বেগ এবং হতাশার শিকার। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপের কারণেই দেখা দিয়েছে এই পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতির হাত থেকে কীভাবে নিস্তার মিলবে সেব্যাপারে এ-পর্যন্ত কোনও দিশাও নেই। তবে ভবিষ্যতের দিনগুলিতে পরিস্থিতি সহজ হিসেবে স্বভাবতই আরও অবনমন হওয়ার আশঙ্কা দুয়ে দুয়ে চারের অঙ্কের মতো।
আরেকটি ব্যাপারে উদ্বেগজনক একারণে যে হতাশাগ্রস্ত মহিলা কর্মীর সংখ্যা পুরুষ কর্মীর তুলনায় অনেকটাই বেশি। ম্যাকিনসে 'এমপ্লয়ি মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড বার্ন আউট: এ টাইম টু আউট অ্যাক্ট' শীর্ষক যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে তাতে এও দেখা গিয়েছে, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হওয়ার অনেকক্ষেত্রেই মহিলা কর্মীরা চাকরি থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। এছাড়া কর্মরত মহিলাদের ক্ষেত্রে্ আরেকটি সমস্যা হলো তাঁরা আগ্রাসনেরও শিকার হচ্ছেন অফিস-কাছারিতে।
২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে এপর্যন্ত ভারতে কর্মক্ষেত্রে উদ্বেগজনিত অসুখ-বিসুখের হার অনেকটাই বেড়েছে। এও জানা গিয়েছে, প্রতি সাতজন ভারতীয়ের মধ্যে একজনই উদ্বেগজনিত অসুখের শিকার। ২০০০ সালের পর বর্তমানে এই সংখ্যাটা দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে।
একই তথ্য ধরা পড়েছে 'দ্য ল্যানসেট'-এর সমীক্ষাতেও। ভারতে কাজের বাজারে অফিস-কাছারিগুলিতে কাজের স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অবনমন হলেও সেসম্পর্কে মহিলাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ জানিয়ে কোনও লাভ হবে না। ২৪ শতাংশ মহিলা অবহেলিত অথবা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়লেও বিষয়টি চেপে যাচ্ছেন।
শুধুমাত্র ভারতই নয়, বিশ্বের অন্য দেশগুলিতে এই একই ব্যাপার। এক্ষেত্রে অভিযোগ দায়ের করে কোনও লাভ হবে না বলে মনে করছেন আবিশ্ব ৩১ শতাংশ মহিলা। ফলে ঘনঘন চাকরি বদল করার কৌশল নিয়েছেন এই মহিলা কর্মীরা।
মানসিক উদ্বেগজনিক সমস্যা দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে্ বাড়ছে। ভারতের পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। জীবনসংগ্রামে হেরে গিয়ে ভারতে আত্মঘাতী হওয়ার সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ। 'ডিজিটাল মেন্টাল হেলখ ইনিসিয়েটিভ ইন ইন্ডিয়া' নামে একটি গবেষণাবল্ধ সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতে প্রতি ৪০ সেকেন্ড অন্তর একজন ব্যক্তি আত্মঘাতী হচ্ছেন।