তালিবানদের অত্যাচার, লাগাতার ভূমিকম্পের মার! আর কত সহ্য করবে আফগানিস্তান?
Afghanistan earthquakes: আফগানিস্তানের বাসিন্দাদের কাছে সবটাই যেন রদেভূ। যেমন করে বারবার দেশে ফিরে আসে ভয়াবহ তালিবান শাসন, তেমন করেই বারবার ফিরে ফিরে আসে সর্বক্ষয়ী ভূমিকম্প।
আফগানিস্তানের বাসিন্দাদের জীবনে স্বস্তি বা একফোঁটা শান্তি বড় দূরতর দ্বীপ। বরং সবসময় তাড়া করে ফেরে এক মৃত্যুভয়। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্যদিকে প্রকৃতির রোষ। দু'য়ের মাঝে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত আফগানিস্তানের মানুষের। একদিকে ঝুলছে 'জুজু' তালিবান শাসনের খাঁড়া, যখন তখন নেমে আসতে পারে গুলি, বোমা, বন্দুক- রাজদণ্ড। অন্যদিকে ভয়াবহ ভূমিকম্প এসে এক রাতে কেড়ে নিল আড়াই হাজার প্রাণ। একবার নয়, বারবার এমনটাই ঘটে এসেছে আফগানিস্তানের সঙ্গে, বারবার ঘটে।
আফগানিস্তানের বাসিন্দাদের কাছে যেমন করে বারবার দেশে ফিরে আসে ভয়াবহ তালিবান শাসন, তেমন করেই বারবার ফিরে ফিরে আসে সর্বক্ষয়ী ভূমিকম্প। গত মার্চ মাসেই ভূমিকম্পে ছাড়খার হয়ে গিয়েছিল আফগানিস্তান। তার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের ভূমিকম্প। খনার বচনে আছে, 'রাজা যদি পাপমতি প্রবঞ্চক হয়, রাজপাপে দেশময় বহে মৃত্যুভয়।' আফগানিস্তান যেন তার ফলাফলই ভুগছে বারবার। ২০২১ সালে অগস্টের দিকে হঠাৎ করেই সরে যেতে থাকে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী। ওই বছরেরই ১৫ অগস্ট আফগানিস্তানের দখল নেয় ফের তালিবান। নব্বই দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে ভয়াল রূপ ধারণ করেছিল তালিবানদের অত্যাচার। এই শাসনে নমনীয়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তালিবান যে আছে তালিবানেই, তা প্রমাণ হতে বেশি দেরি হয়নি। এর মধ্যেই আবার গোদের উপর বিষফোঁড়া এই ভূমিকম্পের ফাঁড়া।
আরও পড়ুন: তালিবান শাসনের দু’বছর পূর্তি! কেমন আছেন আফগানিস্তানের মেয়েরা?
আফগানিস্তান এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। শুধু তালিবান শাসন বলে নয়, বারংবার ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রকোপে পড়তে হয়েছে আফগানিস্তানবাসীকে। সেই ৮১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আফগানিস্তান ও সংলগ্ন এলাকায় বারবার ভূমিকম্প হয়েছে। হাজার হাজার প্রাণ গিয়েছে। সাম্প্রতিকতম ভূমিকম্পের বলি অন্তত আড়াই হাজার। শনিবার সকাল ১১টার দিকে প্রথম ভূমিকম্পটি অনুভূত হয় আফগানিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের হেরাত প্রদেশে । ভূমিকম্পটির উৎসস্থল ছিল হেরাত থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬.৩। এরপর পাঁচটি ‘আফটার শক’ অনুভূত হয় কিছুক্ষণে এত মারাত্মক ভূমিকম্প আর হয়নি বলেই দাবি করছে সে দেশে ক্ষমতায় থাকা তালিবান সরকার।
একের পর এক কম্পন, কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অংশ। ধুলোয় মিশে গিয়েছে বারোটি গ্রাম। ভূমিকম্পের জেরে বিদ্যুৎ ও টেলিফোন পরিষেবা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে হেরাত-সহ আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা। উদ্ধারকাজে নামে সে দেশের বিপর্যয় মোকাবিলা দল। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মিলতে থাকে একের পর এক নিথর দেহ। একে একে সেই সংখ্যাটা ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায় আড়াই হাজার। ভূমিকম্পের দু-দিন বাদেও বেড়েই চলেছে মৃতের সংখ্যা। জখম তার চেয়েও বেশি। এক লহমায় যেন মাটিতে মিশে গিয়েছে আস্ত একটা দেশের বড় অংশ।

২০২২ সালের জুন মাসে এমনই ভয়াবহ ভূমিকম্প এসেছিল আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের একাধিক অংশে। যা কেড়েছিল প্রায় ১ হাজারটি প্রাণ। রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্ট বলছে, এ বারের ভূমিকম্পে ভেঙে পড়েছে অন্তত ৪৬৫টি বাড়ি। ক্ষতি হয়েছে আরও অন্তত ১৫০ বাড়়িঘরের। রবিবার, তালিবান সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রকের মুখপাত্র আবদুল ওয়াহিদ রায়ান, এই ভূমিকম্পকে আফগানিস্তানে গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্প বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জরুরি সাহায্যের জন্য আহ্বানও জানিয়েছেন।
জানা গিয়েছে, এই হেরাত এলাকাটি নাকি অত্যন্ত দুর্গম। সে কারণে ওই এলাকায় উদ্ধারকাজ চালানোও ছিল বেশ কঠিন কাজ। স্থানীয় সংবাদ সংস্থার খবর, শনিবার রাতে পরে পর ধসে যেতে থাকে একের পর এক বাড়ি। বেলচা, কোদাল দিয়ে বাসিন্দারাই ধ্বংসস্তূপ ঠেলে প্রিয়জনদের খুঁজতে থাকেন। প্রবল ঠান্ডা মাথায় উপরে ছাদ নেই, ঠান্ডা রুখবার জন্য প্রয়োজনীয় কম্বলটুকুও নেই তাঁদের কাছে। প্রথম ভূমিকম্পের ধাক্কাতেই ভাঙতে শুরু করে ঘরবাড়ি। বহু মানুষ চাপা পড়েন ধ্বংসস্তূপের নিচে। বহু পরিবারের কোনও খবর নেই। বাড়ির মানুষটি কাজ থেকে ফিরে দেখেছেন, ঘরবাড়ি, এমনকী কাছের মানুষদের পর্যন্ত চিহ্নটুকু নেই। সব যেন একলহমায় বালিতে পরিণত হয়ে গিয়েছে।
হেরাতে ঠিক কী পরিস্থিতি, সে ব্যাপারে এখনও ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। কারণ গোটা জায়গাটাই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। যতটুকু জানা গিয়েছে, রাস্তায় রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। স্থানীয় সংস্থাগুলিকে যত দ্রুত সম্ভব ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত এলাকায় পৌঁছনোর নির্দেশ দিয়েছে তালিবান সরকার। গৃহহীনদের আশ্রয়ের বন্দোবস্তের পাশাপাশি খাবার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ধনবানদের কাছ থেকে সহায়তাও চেয়েছে তালিবানেরা।
শুধুই কি রাজপাপে প্রকৃতির রোষ? কেন বারবার ভূমিকম্পের মুখে পড়ে আফগানিস্তান? আজ থেকে নয়, সেই আটশো খ্রিস্টাব্দ থেকেই বারবার ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে আফগানিস্তানের। আর সবকটিই বেশ তীব্র। যাতে প্রাণ গিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। রেকর্ড বলছে, সেই আটশো খ্রিস্টাব্দ থেকে অন্তত পক্ষে বার চল্লিশেক ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে আফগানিস্তান ও তার সংলগ্ন এলাকায়। আর সেই সব কটি ভূমিকম্পেরই তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে চার-পাঁচের উপরে। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ভূমিকম্পপ্রবণ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান। আফগানিস্তান এমন ফল্টলাইনের উপর অবস্থান করছে, যেখানে এসে মিলেছে ভারতীয় ও ইউরেশিয়ান প্লেটগুলি। কাকে বলে এই ফল্ট লাইন? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যেখানে এসে পৃথিবীপৃষ্ঠের টেকটোনিক প্লেটগুলি নড়াচড়া করে, সেগুলিই ফল্ট লাইন। আর প্লেটের সংঘর্ষে ফাটল ধরে সেই ফল্টলাইনগুলিতে। যার ফলে আফগানিস্তানের মতো এলাকাগুলি কেঁপে ওঠে একের পর এক ভূমিকম্পে।

২০২২ সালের জুন মাসের ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৯। ২০১৫ সালে হিন্দুকুশে মারাত্মক ভূমিকম্প কেড়েছিল ৩৯৯টি প্রাণ, সেটির তীব্রতা ছিল ৭.৫। এর আগেও ২০০২ সালে হিন্দুকুশে আরেকটি ভূমিকম্প প্রাণ কেড়েছিল ১,১০০ জনের। ১৯৯৮ সালে উত্তর উত্তর আফগানিস্তানের তাখার এবং বাদাখশান প্রদেশে ভূমিকম্পে মৃত্য হয়েছিল ৪ হাজার মানুষের। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল শতাধিক গ্রাম, ঘরবাড়ি, গৃহহীন হয়ে পড়েন ৪৫ হাজার মানুষ। ১৯৯৮ সালেও একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। এ ছাড়া ছোটখাটো ভূমিকম্প তো লেগেই থাকে আফগানিস্তানে বছরভর। আর এই তালিকা বোধহয় প্রত্যাশার চেয়েও বেশি লম্বা। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, জাপান এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির তুলনাতেও অনেক বেশি ভূমিকম্প হয় আফগানিস্তানে। আর এ দেশে ঝুঁকি আরও বেশি কারণ এখানকার বেশিরভাগ ঘরবাড়িই ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নয়। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হয় এখানে। তারপর বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষিত দলেরও অভাব রয়েছে সেখানে। ফলে বেশিরভাগ সময়েই সাহায্যও পৌঁছয় না সময়মতো। তার উপর আবার আফগানিস্তানের ভূখণ্ডও বেশ দুর্গম, আবহাওয়াও। সেটাও ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার আরও একটা বড় কারণ।
আরও পড়ুন: ৪২ জন শিশু সহ শতাধিক মৃত্যু! প্রতি বর্ষায় কেন ভেসে যাচ্ছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান?
পরিকাঠামো নেই, নেই বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, মানুষের প্রাণের দাম তো কোনওদিনই ছিল না আফগানিস্তানে। যবে থেকে তালিবানেরা ফের ক্ষমতায় এসেছে সে দেশে, সেদিন থেকে আরও দুরবস্থা আফগানিস্তানবাসীর। নেই শিক্ষার অধিকার, কথা বলার স্বাধীনতা। কোনও মতে শ্বাসটুকু নিয়ে বেঁচে রয়েছেন আফগানিস্তানবাসী। তার উপর আবার ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ বিপর্যয়! আর কত সহ্য করবেন বাসিন্দারা? কবে শেষ হবে এই অভিশাপের দিন? সেটাই বোধহয় একমাত্র প্রশ্ন, যা আফগানিস্তানের বাতাস জুড়ে দীর্ঘশ্বাসের মতো ঘুরে বেড়ায় কেবল।

Whatsapp
