গাজায় মৃতদেহ সরাতে বুলডোজার ব্যবহার করল ইজরায়েল? সামনে এল যে তথ্য
Israel Bulldozes Palestinian Bodies: রাস্তার পাশে একের পর এক চাপা পড়া দেহ, কবরের কোনো চিহ্ন নেই, নাম নেই, কোনো তালিকাভুক্ত পরিচয়ও নেই। পশুপাখি এসে মৃতদেহ খাচ্ছে, এমন দৃশ্যও বহু ভিডিওতে দেখা গিয়েছে।
গাজার উত্তরাংশে জিকিম সীমান্তপথ। এখানে খাদ্য, ওষুধ কিংবা সামান্য ত্রাণ নিতেও মানুষ প্রতিদিন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ছুটতেন। যুদ্ধের কারণে চারদিকে তখনও ধ্বংসস্তূপ, বাজারে খাবার নেই, ঘরে শিশুরা না খেতে পেয়ে কাঁদছে। এই অসহায় মুহূর্তে ত্রাণের গাড়ি দেখলেই ভিড় জমে যেত হাজার মানুষের। কিন্তু সেই যাত্রাপথই হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর ফাঁদ। বহু মানুষ গোলাগুলিতে নিহত হন, বহু দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় রাস্তায়, উল্টে পড়ে থাকা ট্রাকের পাশে বা ভগ্নপ্রায় বহুতলের কোনো কোণে।
সিএনএন-এর সাম্প্রতিক এক দীর্ঘ অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন উঠে এসেছে, যারা গুলিতে মারা গিয়েছে তাদের পরিবারের কাছে কোনো খবরই পৌঁছায়নি। অধিকাংশ দেহই সঠিক ভাবে কবর দেওয়া হয়নি। বহু সময় দেহগুলি রাস্তার উপর পড়ে থেকেছে দিনের পর দিন। পরে বুলডোজার দিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, কোথাও আংশিক মাটিচাপা, কোথাও সম্পূর্ণভাবে অচিহ্নিত কবরের মতো মাটির নিচে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ভিডিও, স্যাটেলাইট ছবি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান এবং প্রাক্তন ইজরায়েলি সেনাদের মতামত নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।
ত্রাণ নিয়ে যাওয়া এক গাড়ির চালক সিএনএন-কে বলেন,
প্রতিবার ওই রাস্তা দিয়ে গেলেই দেহ পড়ে থাকতে দেখতাম। কখনও দেখেছি বুলডোজার দেহ ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। জানালা বন্ধ করে রাখতাম, নইলে সহ্য করা যেত না।
আরও পড়ুন
১৯৬৭ থেকে ২০২৫! যেভাবে গাজায় বারবার নিশানা করা হচ্ছে সাংবাদিকদের
অন্য এক চালক জানিয়েছেন, জুলাই মাসে পুরো এলাকা যেন মৃত্যু উপত্যকা হয়ে উঠেছিল। তাঁর কথায়,
যেখানে তাকানো যায়, দেহ। আমরা এগোতে পারতাম না, উদ্ধার দলও পারেনি।
তথ্য অনুযায়ী, শুধু জিকিম নয়, গাজার অন্যান্য এলাকাতেও একই চিত্র ছিল। রাস্তার পাশে একের পর এক চাপা পড়া দেহ, কবরের কোনো চিহ্ন নেই, নাম নেই, কোনো তালিকাভুক্ত পরিচয়ও নেই। পশুপাখি এসে মৃতদেহ খাচ্ছে, এমন দৃশ্যও বহু ভিডিওতে দেখা গিয়েছে। গাজার সিভিল-ডিফেন্স কর্মীরা জানান, তাঁরা যখনই কোনো মৃতদেহ উদ্ধার করতে যেতেন, পরিস্থিতি এত বিপজ্জনক থাকত যে অনেক দেহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হত না। তিনি বলেন,
আমরা যা পেয়েছি, তা সম্পূর্ণ শেষ অবস্থায়। কারো বাবা, কারো ছেলে কিন্তু কারোর চেনার উপায় নেই।
প্রতিবেদনটইতে দু’জন প্রাক্তন ইজরায়েলি সেনার সাক্ষাৎকারও রয়েছে। তারা মুখ না দেখিয়ে ক্যামেরায় বলেন, তাঁদের ইউনিটেও মৃতদেহ ব্যবস্থাপনার কোনো প্রটোকল ছিল না। বরং প্রায়ই বলা হত, “রাস্তা পরিষ্কার করতে হবে” এবং তাতেই বুলডোজার দিয়ে দেহ সরিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হত। কোনো পরিচয় সংরক্ষণের প্রচেষ্টাই নাকি ছিল না। পরিবারের কাছে দেহ হস্তান্তরের প্রশ্নই ওঠেনি।
২০২৪ সালে নেটজারিম করিডোরে এমনই এক ঘটনায় নয়জন অসশস্ত্র ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন এক প্রাক্তন সেনা। তাদের দেহ দু'দিন রাস্তায় পড়ে থাকে, পরে বুলডোজার দিয়ে মাটির নিচে চাপা দেওয়া হয়। তিনি বলেন,
কুকুর এসে দেহের অংশ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের কেউ ছবি তুলতে দেয়নি।
এই ঘটনাগুলি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন কি না, এ প্রশ্ন উঠেছে জোরালোভাবে। আইনজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ হলেও মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বাধ্যতামূলক। মৃতদেহ শনাক্ত করা, পরিবারের কাছে খবর পৌঁছানো এবং ঠিকমতো কবর দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যতামূলক নিয়ম। যদি দেহ অচিহ্নিত কবরের নিচে চাপা পড়ে বা বিকৃত হয়ে যায়, সেটাই মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয়।
আরও পড়ুন
৪৪ দিনে প্রায় ৪৯৭ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন! এখনও কেন অশান্ত গাজা?
গাজার বহু পরিবার আজও আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ত্রাণ নিতে বেরিয়ে অনেকেরই স্বজন আর বাড়ি ফিরে আসেনি। কেউ জানে না তারা আদৌ বেঁচে আছে কি না। হয়ত তারা কোনো অচিহ্নিত কবরের নিচে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে। এই অজানা সত্যের ভার তাদের পরিবারের মানুষদের প্রতিদিনই কষ্ট দিচ্ছে। পুরো শহরটি যেন হারানো নামের আর্তনাদে ডুবে আছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, কীভাবে এতগুলো দেহ অচিহ্নিত ভাবে মাটির নিচে চাপা পড়ল, কেন সঠিকভাবে সৎকার করা হলো না, এসব প্রশ্নের স্বাধীন তদন্ত অত্যন্ত জরুরি। মৃতদের পরিচয় জানা, ঠিকভাবে কবর দেওয়া, আর যারা দায়ী তাদের বিচার করা— এসব দাবি এখন আন্তর্জাতিকভাবে আরও জোরালো হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন হলো, যারা শুধু ত্রাণ নিতে গিয়েছিল, তাদের উপর কেন গুলি চলল? কেন তাদের এমনভাবে অচিহ্নিতভাবে কবর দেওয়া হলো? নিখোঁজদের পরিবারের কাছে কি কখনও তাদের প্রিয়জনের খবর পৌঁছাবে? তারা কি কোনোদিন জানতে পারবে তাদের প্রিয় মানুষটি শেষ মুহূর্তে কোথায় ছিল, কীভাবে প্রাণ হারাল? গাজার আকাশে প্রতিদিনই ধুলো আর ধোঁয়ার সঙ্গে ভেসে বেড়ায় এই প্রশ্নগুলি।

Whatsapp
