কেন পুতিনের ভারত আসা নিয়ে এত আলোচনা?
Putin in India: ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক বহু দশকের পুরনো। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত রাশিয়ান সরঞ্জামভিত্তিক। সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে বহু ধরনের অস্ত্রই রাশিয়ার প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে উজবেকিস্তানের সামরকন্দে অনুষ্ঠিত শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও-র শীর্ষ সম্মেলনে এক দৃশ্য বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
This is not an era of war
অর্থাৎ,
এটা যুদ্ধের যুগ নয়
আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এ রকম স্পষ্ট মন্তব্য বিরল। তাই বিশ্বজুড়ে অনেকে তখন মনে করেছিলেন, মোদি বিশ্বের সামনে শান্তির বার্তা তুলে ধরলেন। ভারত হয়ত আন্তর্জাতিক সংঘাত থামাতে একটি নৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে চাইছে, এমন ধারণাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিন বছর পর সেই মন্তব্য ঘিরে আবার নতুন প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কি শান্তির যুগ ফিরেছিল? নাকি তা ছিল কেবলই একটি কূটনৈতিক বার্তা, যা বাস্তবতার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া আজ কঠিন?
মোদি যখন এসব কথা বলছিলেন, ঠিক সেই সময় ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন জারি ছিল। পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া যুদ্ধ থামানোর কোনো ইঙ্গিত ছিল না। পুতিনের সামনে দাঁড়িয়ে মোদির মন্তব্যকে কেউ কেউ সাহসী কূটনীতি বলেছিলেন। কিন্তু সেই যুদ্ধ পরে আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। ইউক্রেনের শহর ভয়াবহভাবে ধ্বংস হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। আন্তর্জাতিক মহল শান্তির আহ্বান জানালেও যুদ্ধ থামেনি, বরং আরও বেড়েছে। আজ তিন বছর পর সেই যুদ্ধ এখনও চলছে।
আরও পড়ুন
ইউক্রেনে ভয়াবহ রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার! রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে ভয়ঙ্কর অভিযোগ তুলল আমেরিকা
ইউক্রেন যুদ্ধের পরই খুব বেশি সময় পেরোয়নি, ২০২৩ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয় আরও একটি ভয়াবহ সংঘাত, ইজরায়েলের গাজায় হামলা। ইজরায়েলের লাগাতার বোমাবর্ষণে গাজা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু, খাদ্য ও ওষুধের সংকট, হাসপাতাল ধ্বংস, শিশুদের অনাহারে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। যুদ্ধের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব রাষ্ট্রনেতারা শান্তির আহ্বান জানালেও যুদ্ধ থামার লক্ষণ নেই।
গাজা বা ইউক্রেন ছাড়াও বিশ্বের আরও বেশ কিছু জায়গায় সম্প্রতি যুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। মায়ানমারে সামরিক জান্তার দমন-পীড়ন আজ গৃহযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, সুদান, কঙ্গো— কোথাও সংঘাত কমছে না। সীমান্ত বিরোধ, বিদ্রোহ দমন, আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাব বিস্তার সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ যেন এক নতুন বাস্তব পরিস্থিতি। এমন পরিস্থিতিতে মোদির মন্তব্য “এটা যুদ্ধের যুগ নয়”, আজ যেন উল্টোভাবে প্রমাণ করছে যে আমরা আবারও যুদ্ধের যুগেই ফিরে গিয়েছি। মোদি যে এর বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন তাও নয়।
ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক বহু দশকের পুরনো। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত রাশিয়ান সরঞ্জামভিত্তিক। সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে বহু ধরনের অস্ত্রই রাশিয়ার প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। ঠান্ডা যুদ্ধের পর যেভাবে দু'দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে, তাতে অনেকেই মনে করেন, মোদির মন্তব্য রাশিয়ার কাছে বাস্তবে কোনো অর্থ বহন করে না। কারণ রাশিয়ার রাজনৈতিক শক্তি, আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং ক্ষমতার ভিত্তিই যুদ্ধ, সামরিক আগ্রাসন ও ভূ-রাজনৈতিক চাপ তৈরির কৌশলের উপর দাঁড়িয়ে। চেচনিয়া, সিরিয়া কিংবা ইউক্রেন সর্বত্রই রাশিয়া যুদ্ধকে ব্যবহার করেছে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে। এসব বিবেচনায় সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে দেশ যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের প্রভাব বজায় রাখে, সেই দেশকে 'যুদ্ধ নয়' বার্তা দেওয়া কতটা যথাযথ ছিল? এখন সেই নেতাই ভারত সফরে।
ভারতের বিদেশনীতি একসময় বেশ স্পষ্ট ছিল। নন-অ্যালায়ন্ড বা নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে ভারত বিশ্বের বড় শক্তিগুলির সঙ্গে জোটবদ্ধ না হয়ে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছিল। মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন ও শান্তির পক্ষে নৈতিক নেতৃত্ব ছিল ভারতের পরিচয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আগের মতো স্থির নেই বলে বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন। কখনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা, কখনও রাশিয়ার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক, আবার কখনও চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত— সব মিলিয়ে ভারত এখন বিভ্রান্তির মধ্যে আছে বলেই অনেকে ব্যাখ্যা করেন।
আরও পড়ুন
ট্রাম্প-পুতিন-আম্বানি, ত্রয়ীর মধ্যে মিলটা কোথায়?
বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্তির কথা বলা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ যে কোনো দেশের অর্থনীতি, মানবাধিকার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু শুধুমাত্র শান্তির কথা বললেই শান্তি আসে না। সমালোচকরা বলছেন, যুদ্ধ থামাতে প্রয়োজন শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অবস্থান, স্পষ্ট নীতি, মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস, এবং একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি। কিন্তু যদি বাস্তবতা এড়িয়ে কেবল রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হয়, তাহলে তা অনেক সময় ‘কূটনৈতিক অস্পষ্টতা’ তৈরি করে বলেও মনে করছেন তাঁরা। কিছু বিশ্লেষক আবার বলছেন, বহু দেশ ভারতের অবস্থান বুঝতে পারছে না, ফলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের নেতৃত্বের দাবি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
মোদির মন্তব্য, নিঃসন্দেহে একটি নৈতিক বার্তা। কিন্তু তিন বছরের আন্তর্জাতিক বাস্তবতা প্রমাণ করছে যে যুদ্ধ ও সংঘাত আজ আরও বেড়েছে। পরাশক্তিগুলি নিজেদের প্রভাব বিস্তারে আরও আগ্রাসী। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে এশিয়া সর্বত্র অস্থিরতা বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে শুধু শান্তির আহ্বান দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয় না। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের প্রয়োজন আরও স্পষ্ট ও শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি, আধুনিক প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি, আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে দৃঢ় কূটনৈতিক অবস্থান এবং বিশ্বমঞ্চে একটি বাস্তবসম্মত নেতৃত্ব। তা শান্তি অস্বীকার করে আসবে না; বরং দেশের স্থায়ী অবস্থানের মাধ্যমেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বলে মনে করিয়ে দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

Whatsapp
