ভারতে হু হু করে বাড়ছে ইভটিজিং! কতটা বিপন্ন মহিলারা
Eveteasing: সমীক্ষা বলছে, প্রতি ১০,০০০ ইভটিজিংয়ের ঘটনার মধ্যে মাত্র একটি ঘটনা পুলিশে নথিভুক্ত হচ্ছে।
নারীদের উদ্দেশে অশ্লীল কথাবার্তা বলা আদতে বিকৃতরুচির পরিচয়। এটা অপরাধ তো বটেই। কিন্তু এই অপরাধ নিরন্তরভাবেই ঘটে চলেছে। বন্ধ করা যাচ্ছে না যেমন, অন্যদিকে দোষীরা কলার উঁচিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভারতীয় সমাজে আজও মেয়েরা দুর্বল শ্রেণির অন্তর্গত। সকলেই জানেন ভারতীয় সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। এর ফলে মেয়েরা জীবনভর নানা ধরনের অপরাধের শিকার। যৌন হেনস্থা অথবা যৌনগন্ধী কটূ কথা বলা এর মধ্যে অন্যতম। মেয়েদের উদ্দেশে কেন পুরুষ সমাজের একাংশ কটূ কথা বলে? এ-সম্পর্কে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, ইভটিজিংয়ে অভ্যস্ত যেসব পুরুষ ওরা এই অনভিপ্রেত কাজ চালিয়ে বিকৃত আনন্দলাভ করছে। এছাড়া মেয়েদের প্ররোচিত করার জন্যেও ইভটিজিং করা হয়। কখনও স্রেফ মজা করার জন্যও মেয়েদের উদ্দেশে পুরুষরা কটূকাটব্য করেন।
ভারত ছাড়াও পৃথিবীর নানা প্রান্তেই মেয়েরা যৌন হেনস্থার শিকার। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এই সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে। শুধু ঘরের ভেতরে নয়, মেয়েরা কাজে বেরলেও প্রকাশ্য স্থানে তাঁদের উদ্দেশে বাজে কথা বলার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতেও ইভটিজারদের বাড়বাড়ন্ত। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপালে এই সমস্যা উদ্বেগজনক আকার নিয়েছে।
আরও পড়ুন: সীমান্তে নিঃশ্বাস ফেলছে চিনা ফৌজ! এই অভিনব নিরাপত্তা বলয়ই ভারতের হাতিয়ার
নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করছে যে-সমস্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি, তাদের মতে, শহরাঞ্চলের বাসিন্দা মেয়েরাই ব্যাপক হারে ইভটিজিংয়ের শিকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরা নালিশ ঠুকছেন না। বিষয়টা অগ্রাহ্য করছেন।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে কী হারে ইভটিজিং চলছে, এ-সম্পর্কে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। যেমন, রাজধানী দিল্লিতে রাস্তাঘাটে বেরিয়ে ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার হলেও পুলিশে নালিশ ঠুকছেন মোটে এক শতাংশ ক্ষেত্রে। দেশের অন্য শহরগুলির মধ্যে চেন্নাইতে ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে, মুম্বইতে ২ শতাংশ ক্ষেত্রে মহিলারা ইভটিজিংয়ের ঘটনাগুলি পুলিশকে জানাচ্ছেন। বাকিরা লোকলজ্জায় বিষয়টি চেপে যাচ্ছেন।
এ-ব্যাপারে উদ্বেগপ্রকাশ করেছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে প্রকাশ্য স্থানে মহিলাদের যৌন হেনস্থার ঘটনা বাড়ছে। ইভটিজিংয়ের শিকার মেয়েরা জানিয়েছেন, তাঁরা নালিশ ঠুকলে বিষয়টা জানাজানি হবে। পুলিশে টানাটানি করবে। এর চেয়ে সহ্য করে যাওয়াই ভালো।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে, পুলিশে যে ঘটনাগুলি নথিভুক্ত হয়েছে সেক্ষেত্রেও কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। ইভটিজিং প্রতিরোধে মহিলাদের সহায়তা করার জন্য সরকারের তরফে বেশ কিছু হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। কেন্দ্র ও দেশের রাজ্য সরকারগুলি যে হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছে, সেই হেল্পলাইন নম্বরগুলি সম্পর্কে অবগত নন অধিকাংশ মহিলাই। এর জেরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে রমরমিয়ে চলছে যৌন হেনস্থার ঘটনা।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র দেওয়া তথ্যানুসারে, ইভটিজিংয়ের নিরিখে প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য হরিয়ানা। এরপরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারী রাজ্য কেরল। কলকাতা শহরেও ঘরে-বাইরে মেয়েরা যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। বাসে, ট্রামে, মেট্রোয় মেয়েরা যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। ইভটিজিং প্রতিরোধে কলকাতা এবং বিধাননগর পুলিশ বিশেষ টিম গঠন করেছে। এক্ষেত্রেও সেই লোকলজ্জার নালিশ ঠুকছেন না অধিকাংশ মহিলা। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০,০০০ ইভটিজিংয়ের ঘটনার মধ্যে মাত্র একটি ঘটনা পুলিশে নথিভুক্ত হচ্ছে।
মনতাত্ত্বিকদের মতে, ছেলেরা মেয়েদের যৌনগন্ধী কটূ কথা বলে এটাই প্রমাণ করতে সমাজটা পরিচালনা করে ছেলেরা। মেয়েদের উদ্দেশে বাজে কথা বলাটা অভ্যাসে পরিণত করেছে যে পুরুষরা, তাদের মনে কোনও অনুতাপও নেই। কোন কোন পদ্ধতিতে নারীদের ইভটিজিং করা হয়, স্বেচ্ছাসেবীরা প্রকাশিত করেছে তার তালিকাও। যেমন, গান গেয়ে, বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে, হাত ধরে কিংবা জামাকাপড় ধরে টেনে, ইটপাটকেল ছুড়ে, বাজে কথা বলে এমনকী, চুল টেনেও। ইভটিজিং প্রতিরোধে সারা দেশে যে হেল্পলাইন নম্বর চালু হয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে প্রচারের অভাব রয়েছে। ইভটিজিংয়ের শিকার অধিকাংশ মহিলা হেল্পলাইন নম্বরগুলি সম্পর্কে জানেনই না।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে প্রকাশ্য স্থানে এবং বাসে, ট্রেনে, মেট্রোয় বিভিন্ন বয়সি মেয়েদের লক্ষ্য করে ইভটিজিংয়ের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এক্ষেত্রে মোটে ২ শতাংশ মহিলা পুলিশে অভিযোগ জানাতে পারছেন।
তবে ক্ষতি যা হওয়ার হচ্ছে। সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, যে-সমস্ত কলেজছাত্রী পথে-ঘাটে ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অশ্লীল কটূকাটব্যের শিকার ৯৮ শতাংশ মহিলার মনের শান্তি নষ্ট হচ্ছে। আদতে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইভটিজারদের মনস্তত্ত্বও খতিয়ে দেখা হয়েছে নানা গবেষণায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, যে-সমস্ত পুরুষ মেয়েদের উদ্দেশে কটূকথা বলে, তারা হতাশ অথবা অবসাদগ্রস্ত।
ভারতে ইভটিজারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একাধিক আইন রয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৫৪এ, ৫০৯ ধারায় ইভটিজারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কেউ ইভটিজিং করেছে তা আদালতে প্রমাণিত হলে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে তিন বছরের শাস্তি হতে পারে। এদিকে বাস্তব পরিস্থিতি হলো, শাস্তি তো হচ্ছেই না, উল্টে আইনকানুন খাতায়-কলমেই থেকে গিয়েছে বছরের পর বছর ধরে।
ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ মেয়েদের সম্মানরক্ষা করা। অথচ ঘটছে সম্পূর্ণ উল্টোটা। একদিকে সমাজে হতাশ অথবা অবসাদগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা যেমন উত্তরোত্তর বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ইভটিজিংয়ের ঘটনাও। সমাজের পরিবর্তন না হলে এই পরিস্থিতির রদবদল হওয়া সম্ভব না, বাস্তব পরিস্থিতি অন্তত সেকথাই বলছে।
ইভটিজারদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে যে হেল্পলাইন নম্বরগুলি চালু করা হয়েছে, এরকম একটি নম্বর হলো ১০৯১। এছাড়া জাতীয় মহিলা কমিশনে অভিযোগ করা যেতে পারে যে নম্বরে, সেই নম্বরগুলি হলো ৭৮২৭১৭০১৭০। জাতীয় মহিলা কমিশনের এই নম্বরটি চালু রয়েছে ২৪ ঘণ্টাই। বাড়িতে ইভটিজিংয়ের শিকার হলে অভিযোগ করা যেতে পারে ১৮১ নম্বরে।
ইভটিজিং এক ধরনের সামাজিক অপরাধ। এই অপরাধ কেবল অপরিচিতর মাধ্যমেই ঘটে না, বন্ধুবান্ধবও অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের উদ্দেশে অশ্লীল মন্তব্য করে বিকৃত রুচির আনন্দ লাভ করছে। আদতে এর জেরে মহিলাদের ব্যক্তিগত জীবন বিপন্ন হচ্ছে ভয়ানকভাবে।