'বেটি বাঁচাও'-এর দেশে নির্বিচারে হয় ভ্রুণহত‍্যা, পুত্রসন্তানের নির্লজ্জ চাহিদা কমেনি আজও

ভারতীয় সমাজে পুত্রসন্তানের চাহিদা কার্যত কুসংস্কারের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।

ভারতে অগুনতি দেবী রয়েছেন। সেই হিসেবে ভারতকে বলা যেতে পারে দেবীর দেশ। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো বহু দেবীর দেশ ভারতের নাগরিকদের মধ্যে একটা বড় অংশই কন্যাসন্তান চাইছেন না। আকাঙ্ক্ষা পুত্রসন্তানের। কেন এই মধ্যযুগীয় মানসিকতা, সেও ভাবার মতো বিষয়।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের এই মানসিকতা নিয়ে মাঝেমধ্যেই খবরাখবর প্রকাশিত হয়। গবেষকরা মনে করেন, ভারতীয় সমাজ আজও পিতৃতান্ত্রিক। এর শিকার মেয়েরা। এই কারণে ভারতীয় পরিবারগুলিতে কন্যাসন্তানের চাহিদা পুত্রসন্তানের তুলনায় অনেকটাই কম।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম 'ওয়াশিংটন পোস্ট' জানিয়েছে, প্রতিবছর ভারতে গর্ভপাত করা হয় ৬০ লক্ষের বেশি ক্ষেত্রে। সম্প্রতি ল্যানসেট জানিয়েছে, প্রতি ২৫জন অন্তঃসত্ত্বার ভিতর একজন গর্ভপাত করাতে বাধ্য হন।

আরও পড়ুন: ভারতের লক্ষ লক্ষ শিশুকে হাত পাততে হচ্ছে দু’মুঠো ভিক্ষের জন্য, কেন এই অবস্থা দেশের শৈশবের?

সারা পৃথিবীতেই পুত্রসন্তানের তুলনায় কন্যাসন্তানের জন্মহার তুলনায় কম। ভারত এক্ষেত্রে অগ্রগামী একটি দেশ। রসিকতা করে বললে, ব্যাপারটা অনেকটা পিছনের দিকে এগিয়ে চলার মতো!

ভারত নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধানের দেশ। এদেশে নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করেন। ভারতে হিন্দু, শিখ ছাড়াও ক্রিশ্চান, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষও বসবাস করেন।

২০১৯-'২০ সালে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-তে খতিয়ে দেখা হয়েছে গোটা ভারতে কন্যাসন্তানের জন্মদান করা নিয়ে অনীহার বাস্তব চেহারা। লিঙ্গবৈষম্যের এই ছবিটা  দেবীর দেশ ভারতে যে বেমানান সেও বলার অপেক্ষা রাখে না।

ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-তে আরও দেখা দিয়েছে, হিন্দু, মুসলমান কিংবা খ্রিশ্চান সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে পুত্রসন্তান এবং কন্যাসন্তানের জন্মপ্রদানের আনুপাতিক হার উদ্বেগজনকভাবে কমছে। ১৪ কোটি নাগরিকের দেশ ভারতে ৬ লক্ষ ৩০ হাজার পরিবারে সমীক্ষাটি চালানো হয়েছে।

২০২১ সালে সর্বশেষ ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের রিপোর্টে অবশ্য উল্টো দাবি করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, ভারতে প্রতি একহাজার পুরুষ প্রতি নারীর সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ২০ জনে এসে ঠেকেছে। একদিকে স্বেচ্ছাসেবীরা দাবি করছেন কন্যাসন্তানের সংখ্যা ক্রমশ কমছে ভারতে, অন্যদিকে গত ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভেতে এসম্পর্কে যে উল্টো দাবি করা হয়েছে কার্যত তাতে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। কিন্ত নানা গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে, গত ১০০ বছর ধরেই ভারতে নারী-পুরুষের আনুপাতিক হার ক্রমেই কমেছে।

২০১১ সালে পরে ভারতে নারী-পুরুষের আনুপাতিক হারের পরিস্থিতি কী তা জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আগামী জনগণনার রিপোর্টের জন্যে। বিশিষ্ট গবেষক তথা সমাজকর্মী সাবু জর্জ বলেছেন, ভারতীয় পরিবারগুলিতে এখনও পুত্রসন্তানের ব্যাপক চাহিদা। পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়াটা গর্বের বলে একটা চালু বিশ্বাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতীয় সমাজে রয়েছে। এজন্য সমাজের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোই দায়ী। বাবা-মায়েরা মনে করেন কন্যাসন্তান বোঝা এবং পুত্রসন্তানের জন্ম সুবিধেজনক শেষ বয়সের দেখভালের জন্য।

ভারতীয় সমাজে পুত্রকন্যার জন্মদান করা নিয়ে এই মনোভাব দেশ স্বাধীনের আগেও শত শত বছর ছিল। এখনও অসামাজিকতা এবং অশিক্ষার কারণে সন্তানের জন্মের আগেই পুত্র ও কন্যাসন্তানের জন্মগ্রহণের ক্ষেত্রে ভেদাভেদের মানসিকতা বহাল রয়েছে। ভারতীয় সমাজের অসংখ্য সমস্যার মধ্যে এও এক বিরাট সমস্যা। বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষক সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার। তাতেও একই তথ্য উঠে এসেছে।

ভারতের রাজ্যগুলিতে এখনও কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তানের চাহিদা বেশি। অন্তঃসত্ত্বারা পুত্রসন্তান না কি কন্যাসন্তানের জন্ম দেবেন সে-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে প্রাক-জন্মকালীন ডাক্তারি পরীক্ষা করার ঝোঁক গত ৭০ দশক থেকেই বেড়েছে। এই সম্পর্কিত ডাক্তারি পরীক্ষার সহজলভ্য হয়েছে গত সাতের দশক থেকেই।

পুত্র এবং কন্যাসন্তানের আনুপাতিক হার যদি ১০০জন কন্যাসন্তান পিছু ১০৫ জন পুত্রসন্তান হয়, তবে তা স্বাভাবিক। কিন্তু এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে কন্যাসন্তানকে মায়ের পেটে থাকাকালীনই ভ্রূণহত্যার করানোয়। সর্বশেষ সেনসাস অনুযায়ী, ভারতে ১১১ জন পুত্রসন্তানপিছু কন্যাসন্তানের জন্মের হার ১০০ জন। বর্তমানে পুত্রসন্তানের হার ১০০ জন কন্যাসন্তানপিছু ১০৮ জনে এসে দাঁড়িয়েছে।

ভারতীয় নাগরিক শিখদের মধ্যে কন্যাসন্তানের জন্মপ্রদানের ক্ষেত্রে অনীহা তীব্র বলে সমীক্ষায় জানা গিয়েছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের কম শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে আর্থিকভাবে সম্পন্ন পরিবার সর্বাধিক। আবার ভ্রূণহত্যার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ।

ভারতে ভ্রূণহত্যা আইনত নিষিদ্ধ হলেও কন্যাভ্রূণ হত্যার সংখ্যা দিনেদিনে বেড়ে চলেছে। দিকেদিকে পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে চলছে কন্যাভ্রূণ হত্যা করার জন্য বেসরকারি ক্লিনিক গজিয়ে উঠেছে। ইউনিসেফ-এর রিপোর্ট অনুসারে, প্রতি বছর ভারতে অন্তত ১০ লক্ষ কন্যাসন্তানের ভ্রূণহত্যা করা হয়। কেবলমাত্র পঞ্জাব নয়, হরিয়ানা, দিল্লি, গুজরাত, হিমাচল প্রদেশ, উড়িষ্যা-সহ সর্বত্রই একই ছবি।

এই পরিস্থিতিতে প্রতি হাজার জন পুরুষ প্রতি নারীর সংখ্যা ৮০০-তে গিয়ে ঠেকেছে বলে স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে গোটা সমাজব্যবস্থাতেই। একদিকে কন্যাসন্তানের জন্মদানের প্রতি অনীহা, অন্যদিকে ধর্ষণ থেকে শুরু করে নানা উপায়ে নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে।

স্বেচ্ছাসেবীদের মতে, কন্যাসন্তানের প্রতি অনীহা ভারতে এক ঐতিহাসিক সমস্যা। কেবলমাত্র স্বাধীন ভারতেই নয়, পরাধীন ভারতেও একই পরিস্থিতি ছিল। জন্মের পরেই কন্যাসন্তানকে বহুক্ষেত্রে হত্যা করা হত নানান উপায়ে। কন্যাসন্তান হত্যার এই উপায়গুলির মধ্যে জলে ডুবিয়ে কিংবা বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা অহরহই ঘটত।

সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের এক সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গিয়েছে, করোনা ভাইরাস ঢোকার আগে ভারতে কন্যাসন্তান হত্যার সংখ্যা বেড়েছে ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ। এদিকে অভিভাবকরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন ১৮ বছর কিংবা তার থেকেও কম বয়সে।

ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর এবং ১৫ নম্বর ধারা অনুসারে কন্যাভ্ৰূণ হত্যা করাটা নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র মায়ের ভ্রূণ জটিল কিংবা দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হলে গর্ভধারণের তিনমাস পরে সেই ভ্রূণ নষ্ট করা আইনত বৈধ।

স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, যে সমস্ত মেয়েরা ভ্রূণহত্যায় নারাজ পারিবারের অন্দরেই তাঁরা মানসিক এবং শারীরিক লাঞ্চনার শিকার। এক্ষেত্রে পাশে পাওয়া যাচ্ছে স্বামীকেও। এই সমস্যার মোকাবিলা একদিনে সম্ভব নয় সেও বলাবাহুল্য। বরং সমস্যা সমাধানের অন্য পথ সমাজের মন-মানসিকতার রদবদল  ঘটানো।

গবেষকদের একাংশ দাবি করছেন, পরিস্থিতি একেবারে রসাতলে যায়নি। বরং পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে সাম্প্রতিককালে কন্যাসন্তানের ভ্রূণহত্যার ঘটনা তুলনায় কমেছে। যদি আজও পাঞ্জাব ও হরিয়ানার গুরুদোয়ারাগুলিতে বহু মানুষ মানত করেন পুত্রসন্তানের কামনায়।

ভারতীয় সমাজে পুত্রসন্তানের চাহিদা কার্যত কুসংস্কারের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এদিকে ভারতের বিধানদাত্রী ভারতমাতা!

More Articles