বিহার থেকে বাংলায়: ৩৫ বছরে ধরে দেওয়ালির মাটির পুতুল গড়েন মনোজ পণ্ডিত
Clay Dolls For Diwali: পুতুলগুলির নির্মাণ শৈলীর মধ্যে গ্রামীণ বিহারের ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। ঘাগরা চোলি পরে কখনও কাঁধে তো কখনও মাথায় কলসি ও অন্য হাতে শিশুকে কোলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে গ্রাম্য রমণী।
মাও সে তুং-এর মূর্তি হাত নাড়িয়ে অভয় দিচ্ছে। পাশে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ধুলো মাখা আবক্ষ মূর্তিগুলি প্রমাণ করে দিচ্ছে এ অঞ্চল শ্রমজীবী মানুষের জন্য। বৈদ্যবাটির চাপদানির অঞ্চলের একাধিক কলকারখানার মাঝে ট্রেড ইউনিয়নের ধূসর হয়ে যাওয়া স্মৃতি আজও রয়ে গিয়েছে। মূলত এ অঞ্চলে পড়শি রাজ্য বিহার থেকে আসা শ্রমজীবী মানুষের বাস। আর তাদেরই মাঝে হিন্দি বলয়ের নিজস্ব মাটির তৈরি পুতুলশৈলীকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন মনোজ পণ্ডিত। চাপদানি মঞ্জুশ্রী সিনেমা হলের কাছে মুখার্জি পাড়ার লালপাক্কায় দেওয়ালি উপলক্ষ্যে মাটির পুতুল তৈরি করে চলেন তিনি। বাঙালিরা যেমন মূলত রথ এবং ঝুলন যাত্রার সময় মাটির পুতুল মেলা থেকে কিনে থাকে তেমনই রাজস্থান থেকে আসা মাড়োয়ারিরা জন্মাষ্টমীর সময় মাটির পুতুল সংগ্রহ করে। আর বিহার থেকে এ রাজ্যে আসা শ্রমজীবী মানুষরা দেওয়ালির সময় মাটির পুতুল কিনে থাকে। সেই সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্যই প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মাটির পুতুল তৈরি করেছেন মনোজ পণ্ডিত। শিল্পীর কথায় প্রায় ৩৫ বছর ধরে মাটির পুতুল তৈরি করে আসছেন।
প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে মাটির পুতুল তৈরির কাজ শুরু হয়। বছরে শুধুমাত্র দেওয়ালি উপলক্ষেই মাটির পুতুল তৈরি করা হয়ে থাকে। অন্যান্য উৎসব যেমন রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা ও জন্মাষ্টমী উপলক্ষে আলাদা করে মাটির পুতুল তৈরি করা হয় না। দেওয়ালিকে কেন্দ্র করে মাটির পুতুল নির্মাণ করা হয়ে থাকে। এ বছর প্রায় এক হাজারেরও বেশি মাটির পুতুল তৈরি করা হয়েছে। এটেল মাটি ব্যবহার করে দুইখোল ছাঁচের পোড়ামাটির রঙিন এই পুতুলগুলি নির্মিত হয়। মূলত উত্তর ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপট এই পুতুল নির্মাণের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে নারী জীবনের সাংসারিক সংগ্রাম। রঙ করার ক্ষেত্রে বাজার চলতি ফেব্রিক রং ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পুতুলগুলিকে পোড়ানোর পর খড়িমাটি রঙের প্রাথমিক প্রলেপ দেওয়া হয়। তারপর শুরু হয় রং করার পালা। এই বিপুল পরিমাণ কর্মযজ্ঞে পরিবারের সকল সদস্য মনোজ পণ্ডিতের পাশে এসে দাঁড়ায়। স্ত্রী সুনিতা পণ্ডিত, বড়ো দাদা চন্দ্রদেও পণ্ডিত এবং ছোট ভাই লবকুশ পণ্ডিত পুতুল নির্মাণের ক্ষেত্রে মনোজ পণ্ডিতকে সাহায্য করে থাকেন। বছরের বাকি সময়টা ছোট ছাঁচের দেবদেবীর মূর্তি, মাটির প্রদীপ ও অন্যান্য মাটির আসবাব তৈরি করে অর্থ উপার্জন করে থাকেন।

মনোজ পণ্ডিতের বানানো মাটির পুতুল
দেওয়ালি ও ধনতেরাস উপলক্ষে বৈদ্যপাটির চাপদানিতে প্রতিবছর একটি অস্থায়ী দেওয়ালির বাজার বসে। সেখানেই এই পুতুলগুলি নিয়ে বসেন মনোজ পণ্ডিত। এছাড়াও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পুতুলগুলি কিনে নিয়ে চলে যান। পুতুলগুলির নির্মাণ শৈলীর মধ্যে গ্রামীণ বিহারের ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। ঘাগরা চোলি পরে কখনও কাঁধে তো কখনও মাথায় কলসি ও অন্য হাতে শিশুকে কোলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে গ্রাম্য রমণী। বিভিন্ন রকম গয়না এবং পুতুলগুলিতে শাড়ি পরানোর কৌশলে বিহারের নিজস্ব সংস্কৃতি প্রস্ফুটিত হয়েছে। প্রতিটি নারীই স্বাস্থ্যবতী। বাস্তব জীবনের অনাহার, অপুষ্টি পুতুলের শরীরে নেই। ভরাট মুখে হালকা হাসি নিয়ে মাথা উঁচু করে সংসার সীমান্তের সংগ্রামের কথা বলে চলে এই পুতুলগুলি।
শিল্পীর পুতুল নির্মাণশৈলীর মধ্যে পুতুলের শরীরে থাকা গয়নাগুলিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মাথার টিকলি, নাকছাবি, কানের ঝুমকা, হাতের চুড়ি, গলার মালা এবং পায়ের নুপুর সোনালি রং দিয়ে আঁকা হয়েছে। ঘাগরা এবং শাড়ির নকশার মধ্যেও সোনালি রং ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পুতুলগুলি আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। শকুন্তলা পুতুলের গয়নাগুলি চোখে পড়ার মতো। ভরাট শরীরে ওই গয়না আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে শকুন্তলাকে। এছাড়াও ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রক পরা শিশু কন্যার পুতুলও নির্মাণ করেছেন শিল্পী। মনোজ পণ্ডিতের মতে এই পুতুলটি তাঁর সব থেকে প্রিয়। তাঁর পুতুলগুলির গড় উচ্চতা সাড়ে সাত ইঞ্চি থেকে সাড়ে সাত ইঞ্চির মধ্যে। শ্রমজীবী শিশুদের কথা মাথায় রেখে পুতুলগুলির দামও কম রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি হাতি, ঘোড়া, উট পুতুলও তৈরি করা হয়ে থাকে। এদের পিঠে আবার রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে। পশু ছাড়াও মোটকা-মুটকি (আহ্লাদ-আহ্লাদী), পুলিশ পুতুলও তৈরি হয়। পুতুল তৈরির পাশাপাশি শিল্পী মাটির খেলনা বাটি, ছোট ঘটি, জাতা পেশাই তৈরি করে থাকেন। শিল্পীর কথায় পরিশ্রম সাধ্য এই কাজে পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের কোনো উৎসাহ নেই। তাঁরা এই কাজ শিখতে চাইছেন না। অন্যদিকে লেখাপড়া করেও চাকরি নেই। ফলে এক দোদুল্যমান পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছে প্রাত্যহিক জীবন।
আরও পড়ুন
শক্তিমান থেকে আলিফ লায়লা, আরতি পালের মাটির পুতুল কেন এত জনপ্রিয়?
উল্লেখ করা যেতে পারে দেওয়ালি উপলক্ষে বিহারের মানুষ এক বিশেষ ধরনের কৃষিভিত্তিক ধর্মীয় আচার পালন করে থাকে। মাটি দিয়ে ছোট ঘর বা বাড়ি তৈরি করে তার মধ্যে এই সকল পুতুলগুলিকে রাখা হয়। ঘরের মধ্যে মাটির খেলনা বাটি সাজানো হয়। এই খেলনা বাটিগুলির মধ্যে বাতাসা ও কিছু শস্য সামগ্রী রাখা হয়। দেওয়ালির রাতে এই ছোট মাটির ঘরের সামনে প্রদীপ ও মোমবাতি দিয়ে আলোকিত করা হয়। এই ধর্মীয় আচারকে 'ঘোরৌন্দা' বা 'ঘোরন্দা' বলা হয়ে থাকে। আদতে এই ধর্মীয় আচারটি বাড়ির সমৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য উদযাপিত হয়ে থাকে। গৃহস্থের নিজের বাড়ির ছোট রূপ হচ্ছে এই সকল মাটির বাড়ি। ঘরে যাতে লক্ষ্মী চিরকাল বসত করে তাই এই উপাচার পালন হয়ে থাকে।

বর্তমান সময় মাটির বাড়ির পরিবর্তে কার্ডবোর্ডে তৈরি ছোট বাড়ির সংস্করণ দেখতে পাওয়া যায় বেশি। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পাঞ্চলের শ্রমজীবী জনগণের একটি বড় অংশ বিহারের অধিবাসী। তাই বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে তাদের এই নিজস্ব সাংস্কৃতিক সত্তা মিলেমিশে গিয়েছে। মৃৎশিল্পী মনোজ পণ্ডিতের পূর্বপুরুষের ভিটে বিহারে। হুগলি জেলার চাপদানির পাশাপাশি ব্যান্ডেল স্টেশন সংলগ্ন বাজার দেওয়ালি উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হয়। সেখানেও মাটির পুতুল ও কার্ডবোর্ডের তৈরি ছোট বাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি মৃৎশিল্পীরা রথ ও ঝুলনে যে সকল পুতুল বানায় সেগুলো নিয়েই বসে। আলাদা করে তাঁরা আর পুতুল তৈরি করে না। আর এখানেই মনোজ পণ্ডিতের বিশেষত্ব। তিনি কেবল মাত্র দেওয়ালি উপলক্ষে মাটির পুতুল তৈরি করে থাকেন।
কলকাতার শিয়ালদা স্টেশনের কাছে ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র সংযোগস্থলে মাটির পুতুলের বাজার বসে দেওয়ালি উপলক্ষে। অন্যদিকে, উল্টোডাঙার দক্ষিণ দাড়ি ও বড়বাজার সত্যনারায়ণ পার্ক এসি মার্কেটের সামনে কিছু মাটির পুতুল দেওয়ালি উপলক্ষে অস্থায়ী বাজারে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে বিক্রি হওয়া বেশিরভাগ পুতুলই তৈরি হয় জন্মাষ্টমীর সময়। উল্লেখ করা যেতে পারে বাঙালি সাংস্কৃতিক সাফল্যের অন্যতম ভিত হচ্ছে বিভিন্ন সংস্কৃতির ভালো দিকগুলি নিজের মধ্যে আয়ত্ত করা। বহু ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন দিয়ে যেভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি যুগের পর যুগ ধরে গড়ে উঠেছে ঠিক একই ভাবে বঙ্গসংস্কৃতির জয়যাত্রায় রয়েছে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ভিত্তি। আর সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়েই বঙ্গজীবন নিজেকে আরও মানবিক ও সমৃদ্ধ করেছে। ভিন্ন সংস্কৃতির সাংস্কৃতিক চেতনাকে বোঝার মধ্যে দিয়ে সমাজের ঐকতান গড়ে ওঠে। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মধ্যে সামাজিক একতার ভিত্তি জড়িয়ে থাকে।
(বিশেষ কৃতজ্ঞতা: পুতুল সংগ্রাহক দেবলীনা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চিত্রশিল্পী অনির্বাণ মিত্র)

Whatsapp
