ক্রিকেট শুধু ক্রিকেট নয়, জয়ের অন্তরালে আছে মেয়েদের পঞ্চাশ বছরের লড়াই

ICC Women's World Cup India 2025: ভয় হয়, মেয়েদের ক্রিকেটের বিস্তার যদি এই বিশ্বকাপ জয়ের পর বাড়ে, 'ক্রিকেটপ্রিয় ভারত' যদি নিয়মিত হারমনপ্রীতদের খেলা দেখে, তাহলে ম্যাচ হারলেই রেপ থ্রেট আসবে না তো? অসম্ভব নয়।

SD

ভারতে যে মহিলা ক্রিকেট দল আছে, তা আশি দশকের মধ্যভাগে জন্ম নেওয়া আমি জানতে পেরেছিলাম ১৯৯৭ সালে। বাড়ির টিভিতে ইএসপিএন চ্যানেল ছিল না। তাই সব খেলা দেখার উপায় ছিল না। সেবছর ভারতে বিশ্বকাপের আসর বসেছিল বলেই হয়তো জানতে পেরেছিলাম৷ এটাও জানতে পেরেছিলাম সে আইসিসির পূর্ণ সদস্য হতে গেলে একটা দেশে মেয়ে ক্রিকেটের টিম থাকতেই হয়, তাই ভারতেরও আছে। সেবার অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা বিশ্বজয়ী হয়েছিল ঘরের মাঠে, ইডেনে। সেমিফাইনালে ছিটকে গিয়েছিল ভারত। যদিও দেশের মেয়েরা সেমিফাইনালে ওঠায় ভারতের উচ্ছ্বাসও ছিল না, ছিটকে যাওয়ায় হুতাশও ছিল না। পুরুষ টিমে আজহারউদ্দিনের গদি টলোমলো, অতএব কার মাথায় পরের অধিনায়কের মুকুট উঠবে, তা তখন ভারতীয় ক্রিকেট চর্চার কেন্দ্রে। এই যদি হয় নব্বই দশকের শেষ ভাগ, তাহলে সত্তর আর আশির দশক কেমন ছিল, তা অনুমেয়। অতএব, মেয়েরা যখন বাইশ গজে নামে, তখন সে কি আর শুধুই ক্রিকেট খেলা?

উইমেন্স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া গঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। ভারত প্রথমবার মেয়েদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন করে (নাকি করতে বাধ্য হয়?) ১৯৭৮ সালে। প্রথমত ক্রিকেটার ও দ্বিতীয়ত পরবর্তীকালে ডব্লুসিএআই-এর সদস্য, ঘটনাচক্রে যিনি প্রবাদপ্রতিম সুনীল গাভাস্কারের বোন, সেই নূতন গাভাস্কার একবার বলেছিলেন, সত্তর-আশির দশকে মেয়েদের ক্রিকেটকে প্রফেশনাল ক্রিকেট মনেই করা হতো না। টাকা ছিল না। শুধু আবেগ ছিল, নেশা ছিল, খেলতে পারার অহংকার ছিল। এই সম্বল করে মেয়ে ক্রিকেট টিম তার যাত্রা শুরু করেছিল। বিদেশ সফর করতে হলে চাঁদা তুলতে হতো৷ নর্তকী, মডেল, অভিনেত্রী মন্দিরা বেদী নাকি নিজের উপার্জন তুলে দিয়েছিলেন ওঁদের হাতে। এয়ার ইন্ডিয়া মাঝে মাঝে যাওয়ার টিকিট স্পনসর করে দিত৷ টিমের সদস্যরা খেলতে গিয়ে এনআরআই আত্মীয়দের বাড়িতেও থেকেছেন। খেলোয়াড়রা ডর্মিটারি আর টয়লেট শুধু নয়, ব্যাটও শেয়ার করতেন। গোটা টিম তিনটে মাত্র ব্যাট পেত যে কোনো আন্তঃরাজ্য টুর্নামেন্টে। আন্তর্জাতিকে খান দুই বেশি। ডায়না এডুলজি বা শান্তা রঙ্গস্বামী জানতেন না বহুদিন যে, ‘ম্যাচ ফি’ বলে কিছু হয়। প্রাক্তন অধিনায়ক শান্তা রঙ্গস্বামী নিজের পয়সায় টিকিট কেটে, ট্রেনের আনরিজার্ভড কামরায় চেপে, নিজ নিজ বেডিং বয়ে মেয়ে-টিমের খেলতে যাওয়ার কথা মনে করতে পারেন। এসব ঘটত মাত্র পাঁচ দশক আগে। ডায়না এডুলজি মনে করতে পারেন স্পষ্ট, বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসন ২০১১ সালে বলেছিলেন, মেয়েদের ক্রিকেট পারলে তিনি তুলে দিতেন। নেহাত আইসিসি-র নিয়ম মেনে চলতে হয়…। সেই দেশের মেয়েরা যখন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পঞ্চাশ বছরের মাথায় বিশ্বকাপ জিতলেন, তা কি আর শুধুই ‘খেলা’ ছিল?

আরেক অধিনায়ক মিতালি রাজ (ওডিআই অভিষেক ১৯৯৯) যখন ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন হয়ে গেছেন, সেই সময়েও তাঁকে ‘সম্বন্ধ’ দেখে বিয়ে দিতে চাওয়া হয়েছে। ‘পাত্র’ এসে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘আমার মায়ের শরীর খারাপ আর ম্যাচ একসঙ্গে পড়লে কোনটাকে অগ্রাধিকার দেবেন?’ একথা মিতালি স্বয়ং বলেছেন একাধিক ইন্টারভিউতে। ঝুলন গোস্বামীকে যখন আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটার খেতাব দিয়েছে, যখন সবচেয়ে বেশি উইকেট তাঁর ঝুলিতে, তখনও তিনি সমঝোতা করে বলেছেনমেয়েদের ক্রিকেট ছেলেদের ক্রিকেটের মতো রেভিন্যু তুলতে পারে না। তাই সমান ম্যাচ ফি হয় না।’ সেই মিতালি, সেই ঝুলনের হাতে আজকের বিশ্বকাপ তুলে দিচ্ছেন উত্তরসূরীরা। কারণ তাঁরা জানেন, আনরিজার্ভড ট্রেনে যাতায়াত আর বিদেশ সফরের জন্য চাঁদা তোলার সময় থেকেই এই ২০২৫ সালের জয়ের এক একটা ইঁট গেঁথে চলেছিলেন পূর্বজারা। এই যে পঞ্চাশ বছরের লড়াই, এ কি শুধুই ‘খেলা’?

আরও পড়ুন- শেফালি-দীপ্তি যেন জয় আর বীরু, বন্ধুত্বের দর্পে ভেঙে খান খান প্রোটিয়া প্রতিরোধ

ডমেস্টিকে খেলতে খেলতে, প্রতীকা রাওয়াল আহত হওয়ার পর বিশ্বকাপের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ ডাক পেয়েছিলেন শেফালি বর্মা৷ ফাইনালে ৭৮ বলে ৮৭ রান করেছেন, ৭ ওভারে ৩৬ রান দিয়ে ২ উইকেট পকেটস্থ করেছেন। হরিয়ানার রোহতাক-এর এই মেয়েটি ভাইয়ের নাম ভাঁড়িয়ে খেলতেন আঞ্চলিক স্তরে। ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’-এর পুরস্কারও নিতে হত ভাইয়ের নামে। এই সব মেয়েদের জন্য খেলা কি শুধুই ‘খেলা’?

সাতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ভারতে খেলতে এসেছিল। অস্ট্রেলিয়ান দুই ক্রিকেটার খেতে বা বেড়াতে বেরিয়েছিলেন ইন্দোরে৷ এক ভারতীয় পুরুষ পিছু নেয় মোটরসাইকেলে। তারপর যা করে তাকে অস্ট্রেলিয়ান মহিলা ক্রিকেট বোর্ড 'ইনঅ্যাপ্রপ্রিয়েট টাচ' বলেছে। সারা পৃথিবীতে নিন্দিত হয় ঘটনাটি৷ কিন্তু ক্যাবিনেট মন্ত্রী কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বললেন, ‘ওঁরা কি কাউকে বলে বেরিয়েছিলেন?’ আমাদের দেশে প্রশ্বাস বায়ুর নাম ‘অক্সিজেন’ নয়, রেপ কালচার। নিঃশ্বাস হিসেবে প্রতি মুহূর্তে আমরা যা ছাড়ি, তা ভিক্টিম-ব্লেমিং-এর পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ। এই দেশে মেয়েদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ সত্যিই কি শুধু ‘খেলা’?

৩ নভেম্বর খবরের কাগজে ভারতীয় মেয়েদের বিশ্বজয়ের খবরের পাশাপাশি, পরের পাতায় দুটি খবর বেরিয়েছে। এক, শিশুকন্যাকে তার ঠাকুমা বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছেন। মেরে ফেলা হয়েছে, কারণ সে মেয়ে। দুই, এক নাবালিকাকে তার দুই সহপাঠীই নাকি টিউশনের পর ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে। পুরুষ নয়, নিতান্ত কিশোরেরা ধর্ষণ করেছে কিশোরীকে। এদেশে বিশ্বচাম্পিয়ান হোক বা নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী, মেয়ে মানে মাংসপিণ্ড। কিংবা নিঃশব্দ প্রথাপালনকারী৷ এবং প্রথাপালনকারী হলেও মাংসপিণ্ড৷ এই দেশে মেয়েদের খেলা কি শুধুই ‘খেলা?’

আরও পড়ুন- লরার ক্যাচ হাতের মুঠোয়, ২০২৫-এর কপিল অমনজ্যোৎ

আসলে মাঠে, তথা প্রতিটি খেলার সংশ্লিষ্ট সব বোর্ড ও অ্যাসোসিয়েশনে, সমাজেরই প্রতিচ্ছবি যে! সানিয়া মির্জাকে রাজদীপ সরদেসাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন রিটায়ারমেন্ট, ‘সেটল করা’, বাচ্চাকাচ্চার পরিকল্পনা , সংসার ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে। সানিয়া বলেছিলেন, ‘আপাতত আমি খেললে আপনি কি খুব দুঃখ পান?’ আমাদের দেশে চূড়ান্ত সফল খেলোয়াড়দের এরকম অ-খেলোরায়াড়ি প্রশ্ন করা চলে।

ভারত যে রাতে ২০২৫ সালের বিশ্বকাপটি জিতল, সে রাতে কুস্তিগীর বিনেশ ফোগাট এক্স হ্যান্ডেলে লিখলেন, ‘সন্তানকে খাওয়াতে খাওয়াতে দেখলাম যে ভারতীয় মেয়েরা বিশ্বসেরা হলো। একেই বলে নারীশক্তি!’ পরদিন সাক্ষী মল্লিক লিখলেন, ‘মেয়েরা দেখিয়ে দিয়েছে মাঠে নামলে তারা দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতে পারে।’ সেই সাক্ষী মল্লিক, যিনি রেসলার'স শু খুলে রেখে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন ‘আই কুইট।’ সেই বিনেশ যিনি কাঁদতে কাঁদতে বজরং পুনিয়ার সঙ্গে যমুনাতে আন্তর্জাতিক মেডেল ভাসাতে গিয়েছিলেন। কারণ তাঁদের ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, বিজেপির প্রাক্তন এমএলএ ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে একাধিক কুস্তিগীর মেয়ে সরব হওয়ার পরও, তাঁরা বিচার পাচ্ছিলেন না। উপরন্তু প্রতিবাদরত, এশিয়ান-অলিম্পিক জেতা কুস্তিগীর মেয়ে ও ছেলেদের যন্তরমন্তর থেকে চ্যাংদোলা করে প্রিজন ভ্যানে তুলেছিল পুলিস। ওয়ার্ল্ড রেসলিং ফেডারেশন নিন্দা করেছিল ভারতের আমরা ভুলিনি নিশ্চয়? ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে লঘু চার্জশিট গঠন হয়েছে দেড় বছর পর, কিন্তু যৌন নির্যাতনের চার্জশিট গঠন হলেও গ্রেপ্তারি তিনি এড়িয়ে গেছেন আগাম জামিন নিয়ে। এসব ডামাডোলের মধ্যে বিনেশের শেষ কামব্যাক, যা অলিম্পিকে সোনাও আনতে পারত, তা ১০০ গ্রাম ওজন তারতম্যের জন্য হাতছাড়া হয়েছে, তাও আমরা ভুলিনি নিশ্চয়? বিনেশ নিশ্চয় আনন্দ পেয়েছেন ভারতীয় মেয়েদের ক্রিকেটীয় বিশ্বজয়ে। কিন্তু আমরা যেন বিনেশ ফোগাট নামক ট্র‍্যাজিক নায়িকার জন্য দুফোঁটা সহানুভূতি বাঁচিয়ে রাখি। এখনও আমাদের দেশের নানা খেলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন, বোর্ডগুলোতে যে আইসিসি নেই (আইসিসি মানে ইন্টারনাল কমপ্লেন্ট কমিটি, কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ হলে ভুক্তভোগী যেখানে জানাবেন), এইটা যেন মনে রাখি৷ ভবিষ্যতে কখনও ভারতীয় মেয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে কুস্তিগীরদের মতো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলে, তাঁদের জয় শাহের বাপের বিরুদ্ধে পথে নামতে হলে, আমরা যেন ভালো-মন্দ গুলিয়ে না ফেলি, যেন পক্ষ নিতে পারি তক্ষুনি।

এদেশে কোনো মেয়ে ব্যক্তিগত ভাবে ভাল খেললে তাঁকে অন্য মেয়েদের বিরুদ্ধেই যেন পারলে দাঁড় করিয়ে দেন সমাজের জ্যাঠারা৷ দেখেছ, মেয়ে হয়েও কেমন দৌড়ল? তীর ছুড়ল? ভার তুলল? যেন ওঁরা এমন কিছু ‘ব্যতিক্রম’, যা মেয়েদের ‘গড়পড়তা অযোগ্য’ হওয়ার নিয়মটাকেই প্রমাণ করে৷ জ্যাঠারা আরও বলেন, ‘আসল নারীস্বাধীনতা’ পদক জেতায় নিহিত, হাফ প্যান্ট পরাতে নয়৷ মানে সাংবিধানিক ব্যক্তিস্বাধীনতাটুকু পেতে গেলেও আপনাকে আন্তর্জাতিক পদক-টদক আনতে হবে, তারপর ওঁরা ভেবে দেখবেন। ওঁরা জানেন না, ওই ‘অসাধারণ’ মেয়েদের পদক আনার, কাপ জেতার লড়াইও রোজ কঠিনতর হয় ওঁদেরই খাপ পঞ্চায়েতির জন্য। জেমিমা রদ্রিগেজ, দেখা যাচ্ছে, আগেই আন্তর্জালে রেপ থ্রেট পেয়েছেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হিসেবে, ‘ধর্মান্তরকারী’ সন্দেহে। ভয় হয়, মেয়েদের ক্রিকেটের বিস্তার যদি এই বিশ্বকাপ জয়ের পর বাড়ে, 'ক্রিকেটপ্রিয় ভারত' যদি নিয়মিত হারমনপ্রীতদের খেলা দেখে, তাহলে ম্যাচ হারলেই রেপ থ্রেট আসবে না তো? অসম্ভব নয়।

তবু, আশা জাগে। ব্যক্তিগত ভাবে কোনো মেয়ের পদক জিতে আনার চেয়ে খানিক আলাদা মেয়েদের হকি টিমের, মেয়েদের ক্রিকেট টিমের জয়৷ এই ধরনের জয় প্রমাণ করে, একজন নয়, এগারোজন বা পনেরজন ‘অন্যরকম মেয়ে’ ছোটবেলা থেকে স্রোতের বিরুদ্ধে লড়ে টিকে গেছে। পনেরটা উপড়ে না ফেলা কন্যাভ্রূণ জিতে গেছে খেলায়, যে খেলা শুধুই ‘খেলা’ ছিল না।

More Articles