৭০-এ ৭০ পেয়েও ডাক নেই! এসএসসি-র স্বচ্ছতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন
SSC Recruitment Controversy: কাট অফ মার্কস এতখানি উঁচু রাখার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন অনভিজ্ঞ এবং নতুন চাকুরিপ্রার্থী ৭০-এ ৭০ পেয়েও ইন্টারভিউর জন্য ডাক পাননি।
একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল গতকাল প্রকাশ পেয়েছে। বোঝা গেছে কারা কারা চাকরি পাওয়ার জন্য ডাক পেয়েছেন। যাঁরা অভিজ্ঞতাহীন নতুন পরীক্ষার্থী ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে, তাঁদের অধিকাংশই ডাক পাননি। ক্ষোভে ফুটছেন রাজ্যের শিক্ষিত বেকারদের একটি বিরাট অংশ। এই ক্ষোভ অত্যন্ত সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। আমার মেসেঞ্জার এবং হোয়াটসঅ্যাপ উপচে পড়ছে এই শিক্ষিত বেকারদের নানা বার্তায়। এঁরা এমন সব প্রার্থীদের ফলাফলের ছবি পাঠাচ্ছেন যাঁরা লিখিত পরীক্ষায় ৬০-এ ৬০ পেয়েছেন এবং অ্যাকাডেমিক স্কোরেও পেয়েছেন ১০-এ ১০। যাঁরা আমাকে এঁদের রেজাল্টের সফটকপিগুলি পাঠাচ্ছেন, তাঁরা লিখছেন, আর কী করলে এঁরা ইন্টারভিউতে ডাক পেতেন, বলুন। সত্যিই এঁদের পক্ষে আর একটি নম্বরও বেশি পাওয়া সম্ভব ছিল না। ৭০ নম্বরের মধ্যে এঁরা ৭০-ই পেয়েছেন তাও ইন্টারভিউতে ডাক পাননি কারণ কখনও কাট অফ মার্কস ৮০-তে ৭৬, তো কখনও ৭৪! এককথায় অবিশ্বাস্য! ঠান্ডা মাথায় ভাবলে মনে হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আমার বেশ কিছু লেখায় এবং সাক্ষাৎকারে ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসা যেসব প্রার্থীদের সুপ্রিম কোর্ট ‘আনটেইনটেড’ বলেছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার জন্য ১০ নম্বর দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, শিক্ষকসমাজের মধ্য থেকে বোধহয় সুপ্রিম কোর্টের রায়টি ৩ এপ্রিল ২০২৫-এ প্রকাশ পাওয়ার পর এই দাবিটি আমার একটি লেখাতে আমিই প্রথম তুলেছিলাম। এর কারণটি ছিল খুব স্পষ্ট, আমি চাইনি ২০১৬ সালের একজন যোগ্য প্রার্থীও চাকরি হারাক। কিন্তু ২০১৬ সালের ‘সো-কলড আনটেইনটেড’ প্রার্থীদের মধ্যে মিশে থাকা অযোগ্য প্রার্থীদের সকলের চাকরি রক্ষা করার জন্য রাজ্য সরকারেরই একটি স্বশাসিত সংস্থা স্কুল সার্ভিস কমিশন যা করল, তাকে কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। প্রশ্ন করতে পারেন অনেকে, ২০১৬ সালের আনটেইনটেড প্রার্থীদের মধ্যে সত্যিই কি অযোগ্য প্রার্থীরা মিশে ছিলেন? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ ছিলেন। তাঁদেরকে চিহ্নিত করা যায়নি। চিহ্নিত করা যায়নি কারণ স্কুল সার্ভিস কমিশন একটি স্বচ্ছতালিকা পেশ করে আদালতে জানায়নি কারা যোগ্য এবং কারা অযোগ্য।
আরও পড়ুন
এসএসসি দুর্নীতি: প্রকাশ্যে ঘুষদাতারা, টাকা নিল কারা?
সুপ্রিম কোর্টের রায়টি পড়লেই বোঝা যায় যে, সুপ্রিম কোর্টও মনে করেছিলেন যে, আন্টেনডেট প্রার্থীরা সো কল্ড আনটেইনটেন্ড কারণ এক্ষেত্রে চালের মধ্যে কাঁকর ঢুকে আছে। এঁরা হয়ত ফাঁকা ওএমআর শিট জমা দিয়ে চাকরি পাননি, কিন্তু এঁদের অযোগ্যতাকে নিশ্চিতই ইন্টারভিউ সহ নানাভাবে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। তা না হলে কেন স্কুল সার্ভিস কমিশন যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের একটি স্বচ্ছতালিকা প্রথমেই আদালতে পেশ করতে পারেনি? যোগ্যদের মধ্যে অযোগ্যরা ঢুকে আছে এই সন্দেহ করেছিলেন বলেই, সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতিরা পুরো প্যানেলটি বাতিল করার ঘোষণা করেছিলেন। একই সঙ্গে যোগ্য প্রার্থীরা যাতে বিপদের মধ্যে না পড়েন, আবার যোগ্যদের মধ্যে মিশে থাকা অযোগ্যরা যাতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাদ পড়ে যান, তাই ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত যোগ্যদের চাকরি বহাল রাখার পাশাপাশি নতুন নিয়োগের পরীক্ষা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু, শেষমেশ পরীক্ষাটি নিয়ে যা করা হলো, তা কেবল হাস্যকর এবং বেদনাদায়কই নয়, ভয়ংকর।
কাট অফ মার্কস এতখানি উঁচু রাখার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন অনভিজ্ঞ এবং নতুন চাকুরিপ্রার্থী ৭০-এ ৭০ পেয়েও ইন্টারভিউর জন্য ডাক পাননি। এঁরা ইন্টারভিউতে ডাক পেলে যোগ্যদের মধ্যে মিশে থাকা অযোগ্যরা নিশ্চিত ভাবে ছিটকে যেতেন। তাঁদের রক্ষা করতেই কাট অফ মার্কসকে এতখানি উঁচু রাখা হলো যা ভারতবর্ষে হওয়া যে-কোনো পরীক্ষার নিরিখেই অস্বাভাবিক। এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না যে, যোগ্য অভিজ্ঞদের যাঁদের লিখিত পরীক্ষা একটু খারাপ হয়েছিল এবং যাঁদের অ্যাকাডেমিক স্কোর খুব ভালো নয়, তাঁদেরও কেউ কেউ কাট অফ মার্কস এত উঁচু রাখায় ইন্টারভিউতে ডাক না পেতে পারেন। তাই, আদালতে এই কাট অফ মার্কস চ্যালেঞ্জ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা একশো শতাংশ।
আরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যেভাবে প্রার্থীদের ইন্টারভিউতে ডাকা হয়েছে সেই পদ্ধতি নিয়ে। যে-পরিমাণ শূন্যপদ দেখানো হলো এবং যতজন প্রার্থীকে সেই শূন্যপদের জন্য ডাকা হয়েছে সেই অনুপাত মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ইংরেজির ক্ষেত্রেই ধরা যাক। জেনারেল ক্যাটেগরিতে ভ্যাকেন্সি ছিল ১৯৯, ডাকা হয়েছে ৩১৯জনকে। জেনারেল ফিমেল ক্যাটেগরিতে ভ্যাকেন্সি ছিল ২৮, ডাকা হয়েছে ৪৬ জনকে। শিডিউল কাস্ট ক্যাটেগরিতে ভ্যাকেন্সি ছিল ১০৩, ডাকা হয়েছে ১৬৫জনকে। শিডিউল ট্রাইব ক্যাটেগরিতে ভ্যাকেন্সি ছিল ২৯, ডাকা হয়েছে ৪৭জনকে। এভাবে বিষয়ে এবং ক্যাটেগরি ধরে ধরে তথ্য আরও বাড়ানো যেতে পারে। কমবেশি একই চিত্র ফুটে উঠবে।
এত বছর পর যখন স্কুল সার্ভিস কমিশনের একটি পরীক্ষা হলো, তখন কেন শূন্যপদের অন্তত আড়াই গুণ ছাত্রছাত্রীকে ডাকা হলো না, সে প্রশ্ন তো রয়েই যায়। লিখিত পরীক্ষায় এবং অ্যাকাডেমিক স্কোরে যাঁরা খুবই ভালো করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই যে খুব ভালো শিক্ষক হবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। এজন্যই ডেমোনস্ট্রেশন এবং ইন্টারভিউয়ের প্রয়োজন। শূন্য পদের আড়াই গুণ প্রার্থীকে ইন্টারভিউতে ডাকলে প্রকৃত অর্থে যোগ্য শিক্ষকদের বাছাই করার কাজটা সঠিকভাবে হত। কিন্তু মনেই হচ্ছে না স্কুল সার্ভিস কমিশন বা রাজ্য সরকারের প্রকৃত যোগ্য প্রার্থীদের স্কুল শিক্ষকতায় নিযুক্ত করার কোনো রকম সদিচ্ছা আছে বলে। যেভাবে ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রার্থীদের ডাকা হয়েছে তা থেকে পরিষ্কার যোগ্য প্রার্থীদের নয় বরং ২০১৬-র সমস্ত ‘সো কলড আনটেইনটেড’ প্রার্থীদের চাকরি রক্ষা করতে সরকার এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন বদ্ধপরিকর। এঁদের মধ্যে ঢুকে থাকা অযোগ্যদের সরকার আবার দুর্নীতির মাধ্যমেই চাকরি দিতে চাইছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠান দু-টির উচিত ছিল দুর্নীতির একটি অভিযোগের কালিমা থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য যোগ্যপ্রার্থীদের স্কুল শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করার বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া। হলো ঠিক উলটোটা। এটাই যদি পরিকল্পনা ছিল, তাহলে এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য যে, অনভিজ্ঞ নতুনদের এই পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হলো কেন? পরীক্ষায় বসতে গেলে যে,-অর্থমূল্য প্রয়োজন, সেই অর্থমূল্যটুকু সরকারি কোষাগারে জমা করতে?
আরও পড়ুন
এসএসসি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার ঘোষণাকে কেন মৃত্যু পরোয়ানা বলছেন শিক্ষকরা?
শূন্যপদ যা দেখা যাচ্ছে তাতে এই সন্দেহও অমূলক নয় যে, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়েগুলিতে যে-শূন্যপদগুলি আছে, সেগুলির সবক-টি আদৌ সরকার এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন দেখাল কি? কেন এই বিষয়টি নিয়ে সরকার এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে না, যেখানে অনভিজ্ঞ নবীন প্রার্থীদের ক্ষোভ এত ব্যাপক এবং সংগত?
অভিজ্ঞদের পাশাপাশি অনভিজ্ঞ নবীনদের ডাকলে এবং ইন্টারভিউ প্রভাবহীন ভাবে সংগঠিত হতে দিলে কিন্তু সত্যি সত্যিই ২০১৬-র যোগ্য প্রার্থীরা যেমন চাকরি পেতেন, তেমনই অনভিজ্ঞ নবীনদের মধ্যে যে-অংশটি যোগ্য, তাঁরাও চাকরি পেতেন। যা হলো তাতে দ্বিধাহীন কণ্ঠে এই কথাটুকু বলতেই হবে, দুর্নীতির মাধ্যমে হওয়া নিয়োগের যে-অংশটুকু প্রকাশ্যে আসেনি কিন্তু সন্দেহের মধ্যে ছিল, তাকে সন্দেহের বাইরে নিয়ে গিয়ে সেই নিয়োগগুলিকে বৈধতা দিতে অনভিজ্ঞ নবীন প্রার্থীদের বলি করা হলো এই পরীক্ষার যূপকাষ্ঠে। ২০১৬ সালের দুর্নীতির চেয়ে এই অন্যায়টি কোনো অংশেই কম নয়।
হয়ত এরপরেও আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গঠন করবে। তার কারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ভোট ভারতবর্ষে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করতে বিরাট বড়ো বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। নানা সামাজিক প্রকল্পগুলির সুবিধা পাওয়া মানুষ হয়ত আবারও দু-হাত ভরে মমতা বন্দোপাধ্যায়কেই ভোট দেবেন। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে ১৯৭০-এর দশকের গণটোকাটুকির মতোই এই অধ্যায়টিও একটি কালো অধ্যায় হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আর শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ডটিকে ভেঙে দিলে, আজ না হয় কাল সমাজের দেহটিও মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)

Whatsapp
