হাথরাস থেকে লখিমপুর- আইনের জটে কেন আজও আটকে দলিত ধর্ষণের মামলা?
Uttar Pradesh Rape: ভারতে ২০২০ সালে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে সরকারি তথ্যেই দেখা গেছে।
দলিত কন্যাকে ধর্ষণ করে খুনের মতো ঘটনায় বারবার এগিয়ে উত্তর প্রদেশ। বারবার এই রকম ঘটনা ঘটছে যোগীর রাজ্যে। হাথরাস থেকে লখিমপুর- দলিত মেয়েদের ধর্ষণ করে খুন করা হচ্ছে এই রাজ্যে, অবাধে। লখিমপুরের ঘটনা তোলপাড় ফেলার আগে এই রাজ্যেই এক দলিতের আর্তকান্না কেউ শুনতে পায়নি। তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, ভারতে যেভাবে নাবালিকা ধর্ষণ এবং খুনের মতো ঘটনা বেড়ে চলেছে, তাতে কি লজ্জায় মুখ লুকাবে না সমাজ? স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করছে দেশ। এরপরও কেন দলিতদের ধর্ষণ করে খুন করে মতো জঘন্য ঘটনাকে লালন করা হবে? আড়াল করা হবে অপরাধীদের? বোধহয় তাদের মাথায় রাজনীতির লম্বা হাত! মোদ্দা কথা হল বিচারের বাণী কি নিভৃতেই কেঁদে যাবে?
লখিমপুর বিচার চায়
বুধবার উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেরি জেলায় একটি গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া দুই দলিত বোনের দেহ। পুলিশ জানিয়েছে, দুই বোনকে ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং তারপর শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে এই বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে দুই বোনের খুনের ঘটনায় বড় সড় তথ্য প্রকাশ্যে আসে। লখিমপুর খেরির পুলিশ সুপার সঞ্জীব সুমন জানিয়েছেন, ওই দুই দলিত বোনকে মাঠে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে সোহেল ও জুনায়েদ। এরপর হাফিজুল ও জুনায়েদ তাঁদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারপর তারা করিমুদ্দিন ও আরিফকে ডেকে এনে প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য মেয়েদের গাছে ঝুলিয়ে দেয়।
পুলিশ সুপারের মতে, পরিবারের সম্মতিতে এবং তাদের উপস্থিতিতে পোস্টমর্টেম করা হয়েছিল। ময়না তদন্তের ভিডিওগ্রাফিও করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ আরও বলেছে, ধৃত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ও যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা (POCSO) আইনের ৩০২ ধারা (খুন), ৩২৩ (স্বেচ্ছায় আঘাত করা), ৪৫২ (আঘাত, হামলা বা অন্যায়ভাবে সংযমের প্রস্তুতির পরে গৃহে প্রবেশ), ৩৭৬ (ধর্ষণ) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেরিতে দুই দলিত কিশোরীকে ধর্ষণ করে হত্যার অভিযোগে এখনও পর্যন্ত চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় রীতিমত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাস। এই ঘটনার প্রতিবাদে রাতেই স্থানীয় গ্রামবাসীরা গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নিঘাসন ক্রসিংয়ে বিক্ষোভ দেখায়। পুলিশ জানিয়েছে অভিযুক্ত ৩ জনও দলিত সম্প্রদায়ের। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা স্বাভাবিকভাবেই গড়াবে আদালতে। আর পাঁচটা কেসের মতো লখিমপুরও স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে না তো!
হাথরাসের হাহাকার
২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ১৯ বছরের এক দলিত তরুণীর ওপর ঘটে যায় নারকীয় যৌন অত্যাচার। উচ্চবর্ণের কয়েকজনের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন তিনি। মুহূর্তে অগ্নিগর্ভ হয় হাথরাস। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে দেশে। পর পর রাজনৈতিক দলের নেতারা ঘটনাস্থলে যেতে থাকেন। থাকে নিরাপত্তার কড়া বেষ্টনী। নির্যাতিতার বাড়ি ঘিরে থাকে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রহরা। এরপর সময় বয়ে গিয়েছে। ছন্দে ফেরার চেষ্টা করে হাথরাস, তবে এর বুকে রয়ে গিয়েছে তরুণীর নৃশংস গণধর্ষণের ক্ষত। আসলে এটাই হল মোদ্দা কথা, ছন্দে ফেরা। সময়ের অতলে সব ঘটনাই শেষ পর্যন্ত চাপা পড়ে যায়। হাসরাথের স্মৃতি জাগিয়ে তুলল লখিমপুর।
আরও পড়ুন-প্রাপ্য শুধুই সহমর্মিতা! উমরের মুক্তি চেয়ে কি আদৌ জোট বাঁধবে দেশ?
সব কিছুর মাঝে নির্যাতিতার পরিবার চেয়ে এসেছে ‘ন্যায় বিচার’। এরপর উত্তরপ্রদেশে ভোট আসে। সেখানে বিজেপির প্রচার জুড়ে ছিল উন্নয়নের বার্তা। আর বিরোধীরা হাতিয়ার করেছিল হাথরাস কাণ্ডকে। আলিগড়ের জেএনএম হাসপাতাল থেকে পরে নয়া দিল্লির সফদরজং হাসপাতাল। বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের শিকার প্রবল অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে ঘুরেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধর্ষণের শিকার হয়ে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মারা গিয়েছিলেন তরুণী।
যাঁর মৃত্যুর পরই ৪ জন অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়। এত সবের মাঝেই ন্যায় বিচারের আশায় দিন গুনছে পরিবার। ভোট আসে, ভোট যায়। বিচার কোথায়?
কোন পথে চলছে মামলা?
সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, উত্তর প্রদেশের হাথরাসে দলিত যুবতীর গণধর্ষণ ও খুনের মামলায় সিবিআই তদন্তে নজরদারি চালাবে এলাহাবাদ হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে আদালত আরও জানায়, উত্তরপ্রদেশের বাইরে বিচারটিকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ খোলাই আছে, যতদিন না তদন্ত সম্পূর্ণ হচ্ছে।
একগুচ্ছ আবেদনে বলা হয়েছিল, উত্তর প্রদেশে স্বচ্ছ বিচার হওয়া সম্ভব নয়, কেননা তদন্তে এখনই তালগোল পাকিয়ে গেছে। শীর্ষ আদালত তার রায়ে বলেছে, সিবিআই তদন্তের স্ট্যাটাস রিপোর্ট হাইকোর্টকে দেবে।
হাথরাস মামলা এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চের অধীনে যায়। সেখানে হাথরাসের ঘটনায় নির্যাতিতার সঙ্গে ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে প্রশাসনের ব্যবহার নিয়ে একের পর এক পরিস্থিতি তুলে ধরছেন নির্যাতিতার আইনজীবী। আর সেখানেই কার্যত প্রশাসনকে ভর্ৎসনা করে আদালত। ১৯ বছরের ওই তরুণীর গণধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হতেই পুলিশ তদন্তে নামে। এদিকে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়েও শেষমেশ হাথরাসের ওই তরুণীর মৃত্যু হয়। পরবর্তীকালে তাঁর গ্রামে পুলিশ মরদেহ নিয়ে যাওয়ার দু’ঘণ্টার মধ্যে রাতের অন্ধকারে দেহের সৎকার করে। অভিযোগ ওঠে, নির্যাতিতার পরিবারের অমতে পুলিশ এই কাজ করেছে। পরবর্তীকালে পুলিশ জানায় ফরেন্সিক সহ একাধিক তদন্তে ধর্ষণের তত্ত্ব মেলেনি।
এরপরই মামলা শুরু হয় এলাহাবাদ হাইকোর্টে। সেখানে এই মামলা নিয়ে আদালত নিজের বক্তব্য পেশ করছে। আদালত জানিয়েছে, যেভাবে হাথরাসের নির্যাতিতার সৎকার হয়েছে তা তার স্বাধীন সৎকারের অধিকার কেড়ে নেওয়ার শামিল। এই নিয়ে আচার-রীতি তাঁর পরিবারের পালন করার কথা। বোঝাই যাচ্ছে, সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা! এর পেছনে রাজনীতির হাত থাকা বিচিত্র নয়। তাই বারবার রাজ্যের বাইরে মামলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি ওঠে।
৭ সেপ্টেম্বর নাবালিকাকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে উত্তরপ্রদেশে। দলিত নাবালিকাকে ধর্ষণ করে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে দুই যুবকের বিরুদ্ধে। মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে উত্তরপ্রদেশের পিলভিটে। ঘটনার পরই দুই যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অন্যদিকে, নির্যাতিতা নাবালিকা বর্তমানে গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।
“আমরা হিংসার শিকার হচ্ছি, কারণ আমরা গরিব, নিচু জাত এবং নারী; তাই সবার কাছেই অপদস্থ হই। কেউই আমাদের পক্ষে কথা বলে না বা আমাদের সাহায্য করে না। আমরা সবচেয়ে বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হই, কারণ আমাদের কোনও ক্ষমতাই নেই,” কয়েক বছর আগে গবেষক জয়শ্রী মঙ্গুবাইকে এমনটাই বলেছিলেন এক দলিত নারী।
দলিতদের উপর বর্বর নির্যাতন ও নৃশংসতা বন্ধে ১৯৮৯ সালে একটি আইন করা ছাড়া ভারতের কোনও সরকারই দলিত নারীদের হিংসার হাত থেকে বাঁচাতে কোনও ধরনের পদক্ষেপই করেনি। ভারতে ২০২০ সালে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন দলিত নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে সরকারি তথ্যেই দেখা গেছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তর প্রদেশে ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে; মেয়েদের উপর যৌন নিপীড়নের সংখ্যাও এ রাজ্যে সবচেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন-রাজনীতিতে ভরসা নেই যুবসমাজের, বিস্ফোরক তথ্য উঠে এল সমীক্ষায়
অন্যদিকে ভারতে দলিতদের উপর যে পরিমাণ নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, তার অর্ধেকের বেশিই দেখা যায় উত্তর প্রদেশ, বিহার ও রাজস্থানে। ২০০৬ সালে ভারতের চার রাজ্যের ৫০০ দলিত নারীর উপর চালানো এক সমীক্ষায় তাদের উপর হওয়া নানা ধরনের নির্যাতনের তথ্য উঠে আসে। সমীক্ষায় অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন, ৪৬ শতাংশ যৌন হয়রানি, ৪৩ শতাংশ গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হওয়ার কথা জানান। ২৩ শতাংশ জানান তাঁরা ধর্ষিত হয়েছেন; গালাগালির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন ৬২ শতাংশ নারী।
কেবল অন্যদের হাতে নয়, দলিত নারীরা এমনকি তাঁদের সম্প্রদায়ের সদস্যদের হাতেও নিয়মিতই নির্যাতিত হয়ে আসছেন। ভারত জুড়ে অবশ্য এখন বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দলিত মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর বন্দোবস্ত করছে, যার মাধ্যমে দলিত নারীদের কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হয়ে উঠছে।
লখিমপুর বিচার চায়। কতদিন এই প্রতিবাদের দমক চলবে জানা নেই। হাথরাসে রাতের অন্ধকারে নির্যাতিতার দেহ সৎকারের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে পরিবারকে আড়াল করে। এরপর মামলা চলে তার আপন গতিতে। ছন্দে ফেরার চেষ্টা করে হাতরাস। এবারও কি দলিত কন্যার কান্না চাপা পড়ে যাবে উত্তরপ্রদেশের বাতাসে? যেমনটাই দস্তুর হয়ে গিয়েছে।