১৭ বছরে ১৪ বার সরকার বদল, কেন কোনো স্থায়ী সমাধান খুঁজে পেল না নেপাল?
Nepal's Political History: ২০০৬ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয় এবং ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলোপ হয়। নেপাল হয় একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।
মঙ্গলবার পদত্যাগ করেছেন নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। কেপি ওলি সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সহিংস আন্দোলনের জেরে কার্যত উত্তপ্ত নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। অনথিবদ্ধ সামাজিক মাধ্যমে সরকারি নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ছাত্র-যুবদের আন্দোলন কেপি ওলির আসন নাড়িয়ে দিয়েছে, তবে নেপালের আমজনতার ক্ষোভের আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল অনেক আগেই। ২০০৮ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ১৪টা সরকার দেখেছে নেপাল। কিন্তু একটিও পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। গত কয়েক দশক ধরে নানা রাজনৈতিক উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে নেপাল।
১৯৫১ সালের আগে নেপালে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৯৫১ সালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্থানে রানা শাসন উৎখাত হয় এবং নেপালে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৬১ সালে রাজা মহেন্দ্র রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করেন এবং “পঞ্চায়েত” নামে একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আম জনতার অসন্তোষ ক্রমেই বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৯০ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল “জনআন্দোলন” শুরু করে। গণআন্দোলনের চাপে রাজা বিরেন্দ্র রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এইভাবে “পঞ্চায়েত” ব্যবস্থা শেষ হয় এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে।
আরও পড়ুন- শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ,নেপাল || বারবার গণবিক্ষোভ যা শেখাল
১৯৯৬ সালে নেপালের বাম দলগুলি বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং সংসদীয় রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে “জনগণের প্রজাতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু করে। এক দশক ধরে চলা এই সংঘর্ষে ১৭,০০০-রও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ২০০৬ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয় এবং ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলোপ হয়। নেপাল হয় একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। রাজা জ্ঞানেন্দ্র হলেন নেপালের শেষ রাজা।
ছাত্রজীবনেই বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন কেপি ওলি। ১৯৭০ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেন। সেই সময় বহুবার কারাবাস করতে হয় তাঁকে। প্রায় ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন তিনি। ১৯৯১ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কেপি ওলি। এরপর ধীরে ধীরে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (ইউনিফায়েড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট বা ইউএমএল) গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। ২০০৬ সালের রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন ও ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলোপের পর নেপাল নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ে প্রবেশ করলে, ওলি দলের অন্যতম শীর্ষনেতা হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন- চিনের গোলামিই নেপালে কেপি ওলির পতন ডেকে আনল?
কেপি ওলি প্রথমবার ক্ষমতার স্বাদ পান ২০১৫ সালে। এই সময়ে তিনি নেপালের নতুন সংবিধান বাস্তবায়ন শুরু করেন। তবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, সীমান্ত অবরোধ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ে কেপি ওলির সরকার। শেষমেষ কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (মাওপন্থী-কেন্দ্র) সমর্থন সরিয়ে নিলে, ৯ মাসেই পতন হয় কেপি ওলি সরকারের।
এরপর ২০১৮ দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন কেপি ওলি। এবার পুষ্প কমল দাহাল প্রচন্ডের সঙ্গে জোট বেঁধে একসঙ্গে নির্বাচনে লড়েন ওলি। নেপাল ইউনিফায়েড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট (ইউএমএল) পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (মাওপন্থী-কেন্দ্র) ক্ষমতায় আসে এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব ভাগাভাগি হয় প্রচণ্ড ও ওলির মধ্যে। সমৃদ্ধ নেপাল, সুখী নেপালে’র প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হন ওলি।
আরও পড়ুন- নেপালের গণ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ছায়া কতটুকু?
বারবার ক্ষমতায় এলেও ওলির কথা ও কাজে ফারাক থেকেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, মিথ্যে তত্ত্ব, দুর্নীতি, পাহাড় জমেছে অভিযোগের। ২০২১ সালে অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের অভিযোগে নেপাল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর নেপালি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা শের বাহাদুর দেউবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফের ২০২৪ সালে সরকার গঠন করেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে একটিও কথা রাখেননি ওলি। সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন হয়নি। ক্ষমতার রাস ছিল এলিটদের হাতে। ঠিক হাসিনার মতো ওলি তাঁর আত্মীয় পরিজনদের নানা সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ। এই সমস্ত অভিযোগের স্তুপে অগ্নি নিক্ষেপের কাজ করেছিল সামাজিক মাধ্যমে নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের জেরে সংগঠিত আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করে শেষমেষ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন কেপি ওলি।
নেপালের রাজনীতিতে আপাতত অসীম শূন্যতা তৈরি হয়েছে শূন্যস্থান। বিরোধী দলের প্রতিও মানুষের আস্থা নেই। কারণ গত কয়েক বছরে নেপালের মানুষ দেখেছেন নিজেদের বামপন্থী দাবি করা নেতারা কেবল নিজেদের গদি বাঁচানোর কথায় ভেবেছেন। আমজনতার দাবি পূরণে তাঁদের ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। এদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্যে কার্যত দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে নিচু তলার। এখন দেখার, কোন রাজনৈতিক সমাধান নেপালের জন্য অপেক্ষা করছে।

Whatsapp
