সার্জিক্যাল স্ট্রাইক — অপারেশন সিঁদুর! যত আঘাত, প্রত্যাঘাত ততই! তবু কীভাবে মাথাচাড়া পাক সন্ত্রাসীদের?
Indian Army: অপারেশন সিঁদুর দিয়ে পাকিস্তানের সরকারি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদকে ঠাকনো যাবে? ভবিষ্যতের জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে কি?
২২ এপ্রিল, ২০২৫। পাক সমর্থিত সন্ত্রাসবাদীদের একটি ছোট দল কাশ্মীরের বৈসরণ তৃণভূমিতে ঢুকে পড়ে এবং ধর্মের ভিত্তিতে বেছে বেছে ২৫ জন পর্যটককে এবং পর্যটকদের বাঁচাতে গেলে একজন 'স্বধর্মী' স্থানীয় যুবককেও খুন করে। প্রতিশোধ নেওয়ার চাপ বাড়তেই ভারত প্রত্যাঘাত করে অপারেশন সিঁদুর দিয়ে এবং তারপর পাকিস্তান পাল্টা প্রতিশোধ নিতে মুহুর্মুহু ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি বর্ষণ করতে থাকে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে। ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করলেও পাকিস্তান তাতে আমল দেয় না। এতদূর অবধি ঘটনা সকলেরই জানা। তবে এরপর ঘটনা প্রবাহ দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে। একদল যুদ্ধবিরতিতে খুশি নন, তাদের মনে হয়েছে নরেন্দ্র মোদি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলেন না। দ্বিতীয় গোষ্ঠীর মনে হয়েছে, এখানে আসল তাস খেলেছে চিন। চিন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসীদের পাঠিয়ে কাশ্মীরে পর্যটকদের হত্যা করার জন্য চাপ দিয়েছিল যাতে ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং যার ফলে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে ওঠে। কিন্তু মোদি সরকার সংঘাত থেকে সরে এসে চিন-পাক যৌথ দুষ্ট পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছে।
মনে রাখতে হবে, ২০১৬ সালে উরি, ২০১৯ সালে বালাকোট— দুই-ই নরেন্দ্র মোদির বজ্রকঠিন ভাবমূর্তি নির্মাণে সাহায্য করেছিল। মোদির নেতৃত্বে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী শত্রুপক্ষের ঘরে ঢুকে তাদের নিকেশ করার 'হিম্মত' রাখে এমন একখানা প্রচারের দমেই কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি দলকে জেতান বিপুল ভোটে। আশেপাশে এখনই লোকসভা নির্বাচন নেই ঠিকই, তবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা ভোট আছে। সেসব সংসদীয় রাজনীতির কড়াপাকের প্রশ্ন ছাড়াও, কিছু জিজ্ঞাসা তো থেকেই যায়। ট্রাম্পের ভূমিকা, বিক্রম মিশ্রির ভূমিকা, নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা, এবং সর্বোপরি অপারেশন সিঁদুর থেকে পাওয়া লাভের গুড় ঠিক কী?
ভারত পাকিস্তানের এই অস্থির অবস্থায় পহেলগাঁও হামলা আবার ফিরে দেখা জরুরি। কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে। পহেলগাঁও এক বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র, তাও আবার কাশ্মীরের মতো সংবেদনশীল জায়গায়। প্রশ্ন হছে, সরকার কেন পর্যটকদের সমাগমপূর্ণ তৃণভূমিকে সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত রেখে দিয়েছিল?
হামলার পরে আমরা জানতে পারি, যেখানে হামলাটি হয়েছিল, সেখানকার ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনও নিরাপত্তাকর্মী উপস্থিত ছিলেন না। স্ক্রোল ডট ইনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলাআর অব্যবহিত পরেই নিরাপত্তার ত্রুটি স্বীকার করার পরিবর্তে, কাশ্মীর উপত্যকার সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্র সরকার স্থানীয় প্রশাসনের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছিল। সর্বদলীয় সভায় সরকারই দাবি করেছিল যে, পর্যটকদের জন্য তৃণভূমি উন্মুক্ত রাখার কোনও অনুমোদন চাওয়া হয়নি। যদিও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছিল। তবে সরকারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত গাফিলতির প্রশ্নটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বদলা চাইয়ের স্লোগানে চাপা পড়ে যায়।
এরপরই ৭ মে অপারেশন সিঁদুর চালানো হয়। পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি স্থানে গভীর রাতে হামলা করে ভারত। সরকারের দাবি ছিল, এই নয়টি ঘাঁটি সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয়স্থল ছিল। জৈশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈবার সদর দফতর ছিল এখানে। ভারতের সশস্ত্র বাহিনী জানায়, এই হামলায় ১০০ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে, যার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসবাদীও রয়েছে।
এখানে প্রশ্ন উঠছে, এই হামলা দিয়ে পাকিস্তানের সরকারি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদকে ঠাকনো যাবে? ভবিষ্যতের জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে কি?
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, এতে ভবিষ্যৎ মোটেও সুরক্ষিত করা যাবে না। সন্ত্রাবাদীদের ঘাঁটি ধ্বংস করলেই যে আক্রমণ বন্ধ হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আফগানিস্তানে এমনই কঠিন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাছাড়া ২০১৬ সালে উরিতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছিল, তার ফলে কি ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা রোধ করা গেল? বালাকোট স্ট্রাইক করে কি পহেলগাঁওয়ের হামলা আটকানো গেল?
আরও পড়ুন- ২০২২ সালেই সতর্ক করেছিলেন! রাহুল গান্ধির কথায় আমল দিলে এড়ানো যেত পাক হামলা?
তাহলে ভারত এমন হামলা সহ্য করে যাবে? কোনও পদক্ষেপ করবে না? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবশ্যই করবে। তবে, সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ভেঙে ফেলার জন্য নীরবে কাজ করতে হবে, টেকসই কাজ প্রয়োজন, তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ করা উচিত নয়, তাতে দেশকে প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধে নামতে হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, অপারেশন সিঁদুর শুরু করার আগে, সরকার সংবেদনশীল সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী বেসামরিক নাগরিকদের প্রস্তুত করার জন্য, বা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করেনি। পাক হামলায় প্রাণ গেছে সীমান্তের নিরপরাধ মানুষদের।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, চিনের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশী এবং প্রতিপক্ষ থাকলে সাহসিকতার প্রদর্শন সন্ত্রাসের জবাব হতে পারে না। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষে, ভারত এবং চিনের সৈন্যরা একে অপরের সঙ্গে আরও লড়াই করতে পারত, কিন্তু ভারত সীমান্ত থেকে পিছিয়ে এসেছিল কারণ সেনা চিনের ক্ষমতার পরিধি জানত। এবং এই ক্ষমতাগুলি এখন ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানেও স্থানান্তরিত হচ্ছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, পাকিস্তানের ৮০% অস্ত্র এখন চিন থেকে আসে।
আধুনিক যুদ্ধ প্রযুক্তিগত। সাম্প্রতিক প্রত্যাঘাত পর্বে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী দাবি করেছে যে তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতটাই শক্তিশালী যে পাকিস্তানের সামরিক হামলা চালানোর প্রচেষ্টাকে তা ব্যর্থ করেছে। তবে পাকিস্তানও কিন্তু সাফল্য দাবি করেছে যে তারা চিনের জেট ব্যবহার করে ভারতীয় বিমানগুলিকে গুলি করে নামিয়ে দিয়েছে, যার মধ্যে একটি ফ্রান্স-নির্মিত রাফায়েলও রয়েছে। ভারত সরকার তা অস্বীকার বা নিশ্চিত করেনি। ভারতীয় বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা শুরু বলেছেন, ক্ষতি যুদ্ধেরই একটি অংশ।
এক্ষেত্রে তাই প্রশ্ন উঠছে, অপারেশন সিঁদুর শুরু করার আগে ভারত সরকার কি চিনের অস্ত্রশস্ত্রের বিষয়ে বিশেষ জোর দিয়েছিল বা এই অস্ত্র মোকাবিলায় বিশেষ পরিকল্পনা করেছিল? যুদ্ধবিরতির ঘোষণা কেন ট্রাম্প করলেন, এই নিয়ে অজস্র বিতর্ক থেকেই যাবে। প্রশ্ন থেকেই যাবে, যুদ্ধ শুরু করতে তাহলে স্রেফ কেবল গুটিকয় সন্ত্রাসবাদীর প্রয়োজন? অপারেশন সিঁদুর বা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক দিয়ে কেন দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না পাকিস্তানকে? কেন সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি উড়িয়ে দেওয়ার পরেও নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কেবলই অলীক কোনও মায়ার সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চলছে ভারতের? আসল ঘাঁটি থেকে যাচ্ছে নিরাপদেই, দশকের পর দশক জুড়ে?