বিহার হোক বা বাংলা নারীর হাতে নগদ অর্থই কি ক্ষমতার চাবিকাঠি?
Gender Economics vs Vote Politics: এই নগদ অনুদানগুলি জাতপাতভিত্তিক রাজনীতিকে ছাপিয়ে গিয়ে মহিলাদের একত্রিত করেছে এবং উন্নয়নভিত্তিক ভোটের (ডেভেলপমেন্টাল ভোটিং) প্রবণতা বাড়িয়েছে।
বিহারের নওদা জেলার বাসিন্দা চরিত্তর শর্মা। পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। কলকাতা তাঁর কাজের জায়গা। সারা বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। নিজের সামান্য খরচটুকু রেখে রোজগারের বাকিটা পাঠিয়ে দেন স্ত্রী চিন্তা দেবীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। তাঁর রুটিন বাঁধা— প্রতি বছর দুর্গাপূজার অষ্টমীর আগে বাড়ি ফিরবেনই, নবমীতে তাঁর বাড়িতে বলি হয়। আর তারপর প্রায় মাস দেড়েক কাটিয়ে আবার কর্মক্ষেত্রে ফেরা।
এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কলকাতা ফিরে তিনি যখন ফোন করলেন, আমি স্বভাবসুলভ ব্যঙ্গাত্মক সুরে প্রশ্ন করলাম,
শর্মাজি দেশে গিয়ে কাী করলেন? জমি কিনলেন নাকি?
শর্মা শান্ত গলায় উত্তর দিলেন,
না দাদা, ছোট ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করে এলাম।
এর পরের প্রশ্নটিই ছিল মোক্ষম। আমি মজা করে জিজ্ঞেস করলাম,
নীতীশ কুমারকে জিতিয়ে তবেই কলকাতা এলেন?
তাঁর উত্তরটি শুনলে বিহার নির্বাচন নিয়ে ওঠা অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবে। তিনি বললেন,
দাদা, সব মহিলার অ্যাকাউন্টে দশ হাজার করে টাকা দিয়েছে সরকার। চিন্তা দেবীও পেয়েছে। বিহারের কোনো মহিলা বাদ নেই। খুব বুদ্ধি করে নীতিশ কুমার সরকার মেয়েদের টাকা দিয়েছে। ছেলেদের দিলে গাঁজা-মদ খেয়ে উড়িয়ে দিত, জুয়া খেলে নষ্ট করত। মেয়েরা টাকাটা পাওয়ায় সেটা সংসারের কাজে লেগেছে। তারা তো নীতীশকে ভোট দিয়েইছে, বাড়ির বাকি ভোটারদেরও চাপ দিয়েছে ওদেরকে ভোট দেওয়ার জন্য।
‘এস আই আর’-এর নামে বিপক্ষের ভোট বাদ দেওয়া, ভোট মেশিন বা ইভিএম কারচুপি-বিরোধীদের এরকম হাজার অভিযোগ। নওদার এই বাসিন্দার বক্তব্য সব অভিযোগের উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু এর গভীরে লুকিয়ে আছে অর্থনীতি ও রাজনীতির এক গভীর সমীকরণ।
‘জেণ্ডার ইকোনমিক্স’ এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার
চরিত্তর শর্মা অর্থনীতির ছাত্র নন, কিন্তু তিনি যে কথাটি বললেন, তাকেই আধুনিক অর্থনীতিতে ‘মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট’ বা গুণক প্রভাব বলা হয়। উন্নয়নমূলক গবেষণা দেখায় পুরুষদের উপার্জনের একটা অংশ (যেমন তার বর্ণনা মতে গাঁজা, মদ, জুয়া) প্রায়শই অনুৎপাদনশীল ভোগে ব্যয় হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পক্ষান্তরে, নারীর হাতে আসা নগদ অর্থ মূলত উৎপাদনশীল ভোগে বা বিনিয়োগে (সন্তানের শিক্ষা, পারিবারিক পুষ্টি, স্বাস্থ্য বা গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়) ব্যবহৃত হয়।
চিন্তা দেবীর মতো মহিলারা যখন এই টাকা সংসারে ব্যবহার করেন, তখন সেই টাকার উপযোগিতা এবং অর্থনৈতিক গুণক প্রভাব বহুগুণ বেড়ে যায়, যা পরোক্ষভাবে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এই টাকা মহিলাদের আর্থিক নিরাপত্তা দেয় এবং পরিবারের যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে (যেমন অসুস্থতা বা ছেলে মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি) তাদের নির্ভরশীলতা কমায়।
কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অধিকার ও উৎপাদনশীলতা
মহিলাদের হাতে নগদ অর্থ আসার ফলে কৃষি অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসে। বিহার বা ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতিতে মহিলারা কৃষির মেরুদণ্ড। বীজ রোপণ থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত অধিকাংশ কাজ মহিলারাই করেন। তবে ঐতিহ্যের কারণে জমি ও সম্পদের উপর তাঁদের অধিকার সাধারণত থাকে না।
রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাও-এর তথ্য অনুযায়ী, নারীদের যদি পুরুষদের সমান কৃষি উপকরণ, অর্থ বা ঋণের সুবিধা দেওয়া হয়, তবে কৃষি উৎপাদন ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। চিন্তা দেবীর মতো মহিলারা সরকারি অনুদানের এই অর্থ ভালো বীজ, সার বা কৃষি সরঞ্জামে বিনিয়োগ করেন। এই পুঁজি যেন নষ্ট না হয়ে উৎপাদনশীল সম্পদে রূপান্তরিত হয়, যা খাদ্য সুরক্ষার জন্যও জরুরি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মহিলাদের স্থানীয় বাজারে আরও সক্রিয় হতে উৎসাহিত করে, যার ফলে তারা কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতে এবং বাজার সংযোগ উন্নত করতে সক্ষম হন।
লিঙ্গ সমতা ও সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিত
চরিত্তর শর্মার কথায় পরিবারের অভ্যন্তরে ক্ষমতার পালাবদলের ইঙ্গিত স্পষ্ট। সরাসরি অর্থ পাওয়ায় পরিবারের অভ্যন্তরে চিন্তা দেবীর সামাজিক মর্যাদা ও গুরুত্ব বেড়েছে। আগে যেখানে তিনি কেবল শ্রম দিতেন, এখন তিনি পুঁজির নিয়ন্ত্রক। আগে মহিলারা অনেক ক্ষেত্রে ‘প্রক্সি ভোটিং’ (পুরুষের নির্দেশে ভোট দেওয়া) করতেন। কিন্তু এখন এই আর্থিক সুবিধা তাঁদের ‘দর কষাকষির ক্ষমতা’ দিয়েছে। এর ফলেই তিনি বাড়ির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং ভোটারদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বিহারে বহু বছর ধরে নারী ভোটারদের ভোট দেওয়ার হার পুরুষদের প্রায় কাছাকাছি বা বেশি। এই নগদ অনুদানগুলি জাতপাতভিত্তিক রাজনীতিকে ছাপিয়ে গিয়ে মহিলাদের একত্রিত করেছে এবং উন্নয়নভিত্তিক ভোটের (ডেভেলপমেন্টাল ভোটিং) প্রবণতা বাড়িয়েছে। এই অনুদান শুধুমাত্র অর্থ নয়, এর মাধ্যমে সরকার নারীকে পরিবারের কর্তা বা অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এই স্বীকৃতি সমাজে জেন্ডার ইকুয়ালিটি অর্জনের জন্য একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ।
রাজ্যভিত্তিক ‘স্কিম’ এবং মহিলা ভোটের জোয়ার
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পরিসংখ্যান বলছে, যেখানেই মহিলাদের হাতে সরাসরি অর্থ বা সুবিধা পৌঁছেছে, সেখানেই মহিলা ভোটারের হার পুরুষদের টেক্কা দিয়েছে বা সরকার গঠনে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে।
মধ্যপ্রদেশ ও ‘লাডলি বহেনা’: সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে সমস্ত এক্সিট পোলকে ভুল প্রমাণ করে বিজেপি ক্ষমতায় ফেরে। নেপথ্যে ছিল ‘লাডলি বহেনা যোজনা’। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা স্বীকার করেছেন, মহিলারা একচেটিয়াভাবে ভোট দিয়ে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি বা সরকার বিরোধী হাওয়া রুখে দিয়েছিলেন। সেখানে মহিলা ভোটারের হার ছিল চোখে পড়ার মতো।
পশ্চিমবঙ্গ ও ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’: ২০২১ এবং ২০২৪-এর নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের সাফল্যের বড় কারণ এই প্রকল্প। পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যের বহু কেন্দ্রে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ভোট প্রদানের হার বেশি ছিল। মহিলারা তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার স্বার্থে বা ‘বেনিফিশিয়ারি’ হিসেবে ভোট দিয়েছেন, কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে নয়।
ওড়িশা ও ছত্তিশগড়: ওড়িশায় ‘সুভদ্রা যোজনা’ বা ছত্তিশগড়ে ‘মহাতারি বন্দনা’।
এই সবকটি প্রকল্পই প্রমাণ করে মহিলারা এখন ‘সাইলেন্ট ভোটার’ থেকে ‘ডিসাইসিভ ভোটার’-এ পরিণত হয়েছেন।একসময় মহিলারা ভোট দিতেন বাড়ির পুরুষদের নির্দেশে (প্রক্সি ভোটিং)। তবে এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতার হাত ধরে মহিলারা এখন নিজেদের প্রভাব খাটিয়েই বাড়ির রাজনৈতিক অভিমুখ নির্ধারণ করছেন, যা প্রমাণ করে ক্ষমতার হাতবদল হয়ে গেছে।
‘ভোগ’ বনাম ‘বিনিয়োগ’ এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ঝুঁকি
নারীর ক্ষমতায়নে নগদ অর্থের ভূমিকা স্পষ্ট। তবে এই ‘ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার’ নির্ভর ভোট-সমীকরণের একটি অন্ধকার দিকও রয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনীতির জন্য চিন্তার কারণ। এই অর্থ ‘ভোগ’ নাকি ‘উৎপাদনশীল বিনিয়োগে’ ব্যয় হচ্ছে তা দেখা জরুরি। এই স্কিমগুলির মূল সাফল্য নির্ভর করে এই অর্থের ‘উৎপাদনশীল ভোগে’ ব্যবহারের উপর। কিন্তু এই স্বল্প ও সরাসরি অনুদানের টাকার একটি অংশ যে কেবল দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে বা অনুৎপাদনশীল ভোগে (যেমন উৎসবের খরচ, সাধারণ জামাকাপড়) ব্যয় হচ্ছে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
এই টাকার ‘মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট’ সত্যিই হচ্ছে কিনা, তা নিরূপণ করার জন্য সরকারের কাছে কোনো কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা বা ‘এন্ড-ইউজ মনিটরিং’ নেই। প্রতিটি টাকা সন্তানের শিক্ষা বা বীজে যাচ্ছে, নাকি কেবল ভোগে, তা ট্র্যাক করা অসম্ভব। এই ধরনের ‘রেউড়ি রাজনীতি’ (Revdi Culture) বা তাৎক্ষণিক নগদ অনুদানের মাধ্যমে যদি বারবার নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করা যায়, তবে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রকৃত উন্নয়নের দিকে যাওয়ার প্রবণতা কমতে পারে। জন্ম দিতে পারে উন্নয়ন-বিমুখ রাজনীতির। সরকার তখন দীর্ঘমেয়াদি, ব্যয়বহুল এবং জটিল প্রকল্পগুলিতে (যেমন শিল্প স্থাপন, কর্মসংস্থান তৈরি, উন্নত পরিকাঠামো বা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বৃহৎ বিনিয়োগ) আগ্রহ দেখাবে না। কারণ, এই প্রকল্পগুলির ফল পেতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং তা সরাসরি ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলে না। তবে বলতেই হয়, ইনভেস্টমেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি তৈরি না হলে স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। অর্থনীতিকে দীর্ঘকালীন সময়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শুধুমাত্র অনুদান দিয়ে হবে না, উৎপাদনশীল ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
নারী, অর্থনীতি এবং নতুন গণতন্ত্র
চরিত্তর শর্মা ও চিন্তা দেবীর জীবন প্রমাণ করে লিঙ্গ সমতা অর্জনের পথ আর কেবল আইন বা স্লোগানে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক। চিন্তা দেবীর মতো গ্রামীণ মহিলাদের হাতে সরাসরি টাকা আসা মানে কেবল একটি সরকারি অনুদান নয়, এটি সমাজ এবং পরিবারে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। এই সামাজিক পরিবর্তন সরাসরি ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলেছে, বিহারের নির্বাচনের ফলাফলে তা আরও স্পষ্ট হলো।
তবে সরকার এবং নীতি-নির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, নগদ অর্থ দিয়ে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি একটি জরুরি পদক্ষেপ, কিন্তু এটিই সমাধান নয়। এই সাময়িক স্বস্তি যেন দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ না হয়। নারীকে ‘ভোট ব্যাংক’ নয়, ‘অর্থনৈতিক অংশীদার’ হিসেবে দেখলে, সরকারের উচিত এই অনুদানগুলির সঙ্গে দক্ষতা উন্নয়ন, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে উৎপাদনশীল ঋণ এবং বাজারে প্রবেশাধিকারের মতো বিষয়গুলি যুক্ত করা। শুধুমাত্র তবেই এই নগদ অর্থ সত্যিকারের ‘উৎপাদনশীল বিনিয়োগে’ পরিণত হবে, যা ভারতকে দীর্ঘমেয়াদে সমৃদ্ধির পথে চালিত করবে।
মেয়েরা টাকা পেলে সংসারের উন্নতি হয়
চরিত্তর শর্মার এই উক্তিটি আগামী দিনে ভারতের মূলমন্ত্র হতে চলেছে। তবে এই উন্নতির পথ যেন স্বল্পমেয়াদী ভোগে আটকে না থাকে, বরং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও স্থায়ী কর্মসংস্থানের রাস্তা খুলে দেয়, সেই দিকে নজর রাখা আজ সময়ের দাবি।
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)
Whatsapp
