নিয়ন আলোয় ম্রিয়মাণ ভালোবাসার ধন, উপহারের গায়ে এখন শুধুই টাকার গন্ধ!

Gifts of Love: আজকাল এমন উপহারের কথা কেউ চিন্তা করতে পারছে না। যে কোনও জিনিসে নিয়ন আলোর, জৌলুসের দাগ না থাকলে ঠিক মান থাকছে না সমাজে।

কবে থেকে ঠিক জানি না, আমাদের উপহার দেওয়ার যে মুদ্রা, যে ভঙ্গি তা আমূল বদলে গেল। বরাবরের মতো এখনও একথা বলার যে, তা ভালো না খারাপ, তা বিচার করার জন্য এই লেখার অবতারণা নয়। আমি শুধু দেখাতে চাইব কীভাবে বাজার ঠিক করে দিল আমাদের ভালোবাসার, আদরের, আহ্লাদের উপহার। যা দেব বা দিতে চাইব তা যেন ঝলমলে ও রঙিন হয় এবং অবশ্যই দামি হতেই হবে, না হলে যেন মুখ থাকল না। একেবারে ছোটবেলায় প্যাঁ পুঁ জুতোর প্রতি ছিল ভালোবাসা। একবার করে পা ফেললেই আলো জ্বলে উঠত। ধীরে ধীরে আলো আর উঁচু শব্দের প্রতি পিরিত কমে এলে হাওয়াই চপ্পল সুন্দরতম মনে হয়, কেমন এক বেলকাঠের খড়ম খড়ম ফিলিং আসে। সেই যে নতুন জুতো অনেক অপেক্ষার পর কাছে পেয়ে মাথার পাশে নিয়ে ঘুমনো, তার আনন্দই ছিল আলাদা। এই উপহার আসত ছোটমাসির কাছ থেকে, পুজোয় পাওয়া এই সামান্য জুতো সারা বছর চালানোর কায়দা শিখে নিতে হত।

অক্টোবরের গোড়ায় পুজো ছিল একবার, সামান্য মেঘ হচ্ছে, আবার জল, রোদছায়ার অল্প অল্প গয়না ঝিকঝিক করছে মফসসলের গতরে। সকাল-দুপুরে খুব গরম থাকলেও সন্ধের পর থেকে হাওয়া বেশ ঠান্ডা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল আকাশ নীল, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছি নির্জন প্রতিমা। বাড়ির পুজো আর প্যান্ডেলের পুজো ফারাক খেয়াল করছি যত্ন করে, দুর্গার চোখ, হাতের ভঙ্গি, মুখের হাসিটুকু দেখতে দেখতে মন বেশ ভরে ওঠে।এই সব হল বিনিপয়সার আনন্দ। ঢাকের সঙ্গে কাঁসর বাজানো ছেলেটিকে মন দিয়ে দেখলে দেখবেন বুকের ভিতর কিছু একটা টের পাচ্ছেন। মনে হয় বলি, আসুন, বাঁচি, এই নিন আমার হাতটা শক্ত করে ধরুন তো। কিছু খুশির ফিকির বাতলাই। এই উপহার আকাশবাতাস থেকে নেমে আসা।

সেই যে রবীন্দ্রনাথের গানে আছে না, না চাইতেই পাওয়া আকাশ আলো তনু মন প্রাণ, এমন পাওয়ার কথা ভাবলে তো ভিতরে এক কান্নার আকুলতা টের পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন- কামসূত্রেও যা নেই! পাড়াগাঁয়ের লুকোচুরি যেভাবে শেখায় শিরশিরে যৌনতার সহজপাঠ

এইসময় বেলার দিকে মন দিয়ে বাজার করা যায়। ইলিশ-রুই-পমফ্রেটের দিকে না ঝুঁকে তাজা মাছের ডিম কেনা যায় সস্তায়, আজ ১৫০ টাকা কেজি দর ছিল, লইট্যাও তো চমৎকার, ৬০ টাকা কেজি, চারখানা কাঁঠালিকলা কেনা যায় দাম করে ১০ টাকায়, দাম কমাতে পারলে বড় এক আঁটি শাপলা ৮ টাকায়।স্নান করার আগে গায়ে একটু কাঁচা হলুদ বাটা, মুখে থুপে নেওয়া যায় ঘৃতকুমারী, রূপটান। ভাতে গর্ত করে ডাল দিয়ে মেখে খান। চুল আঁচড়ান ভালো করে নিমকাঠের চিরুনি দিয়ে। একটু গড়িয়ে নিয়ে সাইকেলে করে আবার টইটই। ক'টা জামা হয়েছে, আদৌ হয়েছে কিনা, কত টাকা হাতে রয়েছে, নিকুচি করেছে ওসবের, এসব বাদ দিয়ে আনন্দ করুন। যা আছে তাতেই মাতোয়ারা হয়ে থাকুন। একবছর অপেক্ষার পর পুজোপার্বণ এল, ওসব বিষণ্ণতা এলে-টেলে লাল লাল জিলিপি বা বড় একখানা পাঁপড়ভাজা কিনে খান। অবাক হন, বিস্মিত হন, কথা বলুন, ভালোবাসুন।

আর অন্যরকম ছোট ছোট উপহার কীভাবে মাধুর্য এনে দিতে পারে তার কথাই বলি। আমার এক পরিচিতজনকে অচেনা একজন নাম না জানিয়ে একটা আয়না উপহার পাঠিয়েছে। ছোট ছোট ঝিনুক বসানো। কিছুই না, জন্মদিনে ছোট একটি হাতআয়না। সাদা কাগজের মোড়কে নকশা কেটে উপহার দিয়েছে এইভাবে। এক বন্ধুর কথা জানি সে আমাকে একবার শ্রেষ্ঠ দু'টি উপহার দিয়েছিল। এক, জলের ধারে বসে বসে সাধারণ একজোড়া হাওয়াই চপ্পল, ঘন রঙ, গুপি-বাঘার জুতোর আত্মীয় মনে হবে দেখে। দুই,গায়ে মাখা সুগন্ধি একখানা সাবান। স্নান করতে বসলেই মনে কীরকম ঢেউ এসে লাগে। বেঁচে থাকা এক বিরাট ও জব্বর আনন্দের ব্যাপার, রহস্যময় ও নির্জন ব্যাপার; মাঝে মাঝেই কিন্তু টের পাওয়া যায়।

কিছুদিন আগেই দেখতে গেছি, ঘোড়ানাশের পাশে আখড়া গ্রামে কোজাগরীর মেলা বসেছে। পাড়াগাঁয়ের মেলাতে সবার সঙ্গে সবার দেখা হয়। আকাশে চাঁদ, জলের ধারে ছাতিমফুলের গাছ, ঘ্রাণে ম ম করছে। হরেকমাল বসেছে। চুবড়ি থেকে চিরুনি, সাবানদানি থেকে ফুলের সাজি সব ছয়টাকা। পাশেই ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের বইয়ের দোকান এসেছে; চে গুয়েভারার ডায়েরি, সুকুমারী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ, ক্ষিতিমোহন সেন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বইপত্র আরও কত কী। পাঁপড়-জিলিপি, নাগরদোলা, হরেকরকমের পসরা। ভিড়। তফাতে দাঁড়িয়ে ছাতিমফুল হাতে সরস্বতী-পট কিনছি।

কেনা শেষ হলে ফাঁকা জায়গায় দেখি মোটরবাইক থামিয়ে এক ছেলে দাঁড়িয়ে। ব্যাগ ঝোলানো। একটি ঝকমকে চুড়িদার পরে অনুশীলন সমিতির সদস্যদের সর্তকতায় একটি মেয়ে এল, এদিক ওদিক তাকাল, তারপর খুব সুন্দর করে লজ্জা পেয়ে টুক করে একটি টিফিন কৌটো চালান করে দিল ছেলেটির ব্যাগে।যাওয়ার সময় একবার ঘুরে তাকাল, চোখে এমন ভালোবাসা। তারপর অচেনার ভান করে মিশে গেল মেলায়।

আরও পড়ুন- গোপন ভিডিও থেকে অসভ‍্য অসভ‍্য খেলা! পাড়াগাঁয়ের যৌনতার ক্লাসরুম কেমন ছিল

আমি দূর থেকে দেখছি ছেলেটি ওখানে দাঁড়িয়েই কৌটো খুলে বের করল গতরাতের লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদ। নারকেল বা তিলের নাড়ু দুটো বের করে খেয়ে মুখে মুছে গাড়ি চালাতে শুরু করল। ছেলেটির চাপদাড়ির ভিতর এমন আলো করা হাসি আমি ভুলতেই পারছি না। আকাশে লাল চাঁদ উঠেছে, দুধের সরের মতো জ্যোৎস্না ফকফক করছে।

এবার বাবারা সবাই মিলে তীর্থদর্শনে গেছিল। অনেকে মিলে সস্তার ভ্রমণ। বুদ্ধগয়া দেখতে গিয়ে বাবা একটি অশ্বত্থ পাতা কুড়িয়ে এনেছে আমার জন্য। কেউ ভালোবেসে কাউকে রান্না করে খাওয়াল, সামান্য একটি ফুল দিল উপহার। তাতে জৌলুস নেই কিন্তু আছে প্রাণ। এই প্রাণ থেকে দ্রুত আমরা টলে গেছি, টলে যাচ্ছি। আজকাল এমন উপহারের কথা কেউ চিন্তা করতে পারছে না। যে কোনও জিনিসে নিয়ন আলোর, জৌলুসের দাগ না থাকলে ঠিক মান থাকছে না সমাজে।

ভালোবেসে দেওয়া উপহার অবশ্যই টাকার গুঁড়ো থেকে জন্মানো হতে হচ্ছে, প্রাণের জিনিস হাসির খোরাক, এই কথা বোঝাতেই এত গুলো ব্যক্তিগত অনুষঙ্গের কথা বলা। জীবনের সহজ স্ফূর্তিতে বাঁচার অবলম্বন কখনই কেবলমাত্র টাকা হতে পারে না।

More Articles