লাইমলাইট থেকে শত হস্ত দূরে দীপ্তি-রিচাদের যেভাবে গড়েছেন অমল মুজুমদার

Amol Muzumdar: অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, যিনি কোনোদিন ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে পর্যন্ত নামেননি, তিনি কীভাবে একটা দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারবেন। আজ তিনি সেই সব প্রশ্নের যোগ্য উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।

নভি মুম্বইয়ের মাঠে রবিবার ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটাররা লিখে ফেললেন এক নতুন ইতিহাস। হারমনপ্রীতদের হাত ধরে ভারতের মহিলা ক্রিকেটে রচিত হলো এক গৌরবগাথা, যা ভবিষ্যতে আর কোনোদিন ম্লান করতে পারবে না কোনো দল। ২০১১ সালে ধোনির বিশ্বকাপ জয় যে-রকম কপিল দেব অ্যান্ড কোম্পানির কৃতিত্বকে ম্লান করতে পারেনি, সে-রকমভাবেই এবার ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে রয়ে যাবেন হারমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মন্ধানা, শেফালি বর্মা, জেমিমা রদ্রিগেজ থেকে শুরু করে দীপ্তি শর্মারা।

রবিবার রাতে মায়ানগরীর ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে যে এক নবজাগরণের সূচনা করল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। লরা উলভার্টের শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে অনাবিল আনন্দে মেতে উঠলেন ভারতের মেয়েরা। এই জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেন শিলিগুড়ির বাঙালি কন্যা রিচা ঘোষ। তবে এই সাফল্যের পিছনে বর্তমান মহিলা ক্রিকেটের গুরু অমল মুজুমদারের গুরুত্বও কম কিছু নয়। বরাবর লাইমলাইট থেকে দূরে থাকলেও আজকের এই জয়ের তিনিই কিন্তু নেপথ্য নায়ক। বছর দু'য়েক আগে তিনি যখন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, যিনি কোনোদিন ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে পর্যন্ত নামেননি, তিনি কীভাবে একটা দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারবেন। তবে, আজ তিনি সেই সব প্রশ্নের যোগ্য উত্তর দিয়ে দিয়েছেন নিজের প্রশিক্ষণ দিয়ে, নিজের ধৈর্য্য দিয়ে।

২০২৩ সালে যখন অমল মুজুমদার এই দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রয়োজন ছিল স্থিরতা। আগে যে ক'জন ক্রিকেটার মহিলা ক্রিকেট দলের প্রশিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন, তাদের সবার আমলেই উঠেছিল নানা প্রশ্ন। সে উর্কেরি ভেঙ্কট রমনার সময়কালে হোক কিংবা, রমেশ পাওয়ারের সময়কালে, ভারতীয় মহিলা দলের শৃঙ্খলা এবং নির্বাচনী সিদ্ধান্ত নিয়ে অজস্র প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল বিসিসিআই। ২০২৩ সালে যখন অমল মুজুমদার এই দলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন সবে সবে অবসর নিয়েছেন মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামীরা। তাই পুরো নতুন দল নিয়ে লড়াইটা কখনোই সোজা ছিল না অমল মুজুমদারের কাছে।

আরও পড়ুন

লরার ক্যাচ হাতের মুঠোয়, ২০২৫-এর কপিল অমনজ্যোৎ

আসলে অমল মুজুমদার জানতেন, নাম যশ খ্যাতির থেকেও অনেক বড় হলো কাজের স্পষ্টতা। হয়ত তিনি ভারতের নীল জার্সিটা কোনোদিন গায়ে চাপাতে পারেননি, কিন্তু কৌশলী হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। কোচ অমল মুজুমদার দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে খেলেছেন রঞ্জি ট্রফিতে। মুম্বাই, অসম এবং তারপর অন্ধ্রপ্রদেশ, এই তিন দলের হয়ে ডোমেস্টিক ক্রিকেট খেলেছেন অমল মুজুমদার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর নামের পাশে রয়েছে ১১ হাজারেরও বেশি রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে, হাঁকিয়েছেন ৩০টি সেঞ্চুরি এবং ৬০টি হাফ সেঞ্চুরি। জাতীয় দলের জার্সি না পরতে পারলেও, ক্রিকেটকে বুঝেছিলেন খুব গভীরভাবে।

ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের দায়িত্ব পাওয়ার আগে কোচ অমল মুজুমদার কাজ করেছেন ভারতের জুনিয়র দল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে। কোচ হিসেবে অমল মুজুমদারের রেকর্ড বরাবরই ভালো। মাঠে নামার আগেই খেলোয়াড়দের মনে একটা দৃঢ় চিন্তাভাবনা তৈরি করে দিতেন অমল মুজুমদার।

বছর দু'য়েক আগে অমল মুজুমদার ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন

কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হতে না হতেই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েন ভারতীয় দল। গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে পরপর তিনটি ম্যাচ হেরে ব্যাকফুটে চলে যায় টিম ইন্ডিয়া। সকলের মনে সংশয়, হারমনপ্রীতরা কি পারবেন আদৌ বিশ্বকাপ জিততে? নাকি আবারো খালি হাতে ফিরতে হবে ভারতের মেয়েদের? টিম সিলেকশন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তার মধ্যেই আবার প্রতিকা রাওয়াল চোট পেয়ে ছিটকে গেলে তাঁর জায়গায় আসেন শেফালি বর্মা। সব মিলিয়ে অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে পড়ে যান কোচ অমল মুজুমদার। বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তোলেন মেজাজ এবং স্ট্র্যাটেজি নিয়ে।

বাইরে যতই সমালোচনা চলুক না কেনো, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেননি কোচ অমল মুজুমদার। তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন স্মৃতি, হারমনপ্রীত, দীপ্তিদের উপর। গ্রুপ স্টেজের বাধা পার করে ভারতীয় দল সেমিফাইনালে পৌঁছতেই সামনে এসে হাজির হলো ৭ বারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। এবারের বিশ্বকাপেও এলিসা হিলি, ফিবি লিচফিল্ড, এলিস পেরিরা ছিলেন দারুন ফর্মে। সেমিফাইনালের প্রথমার্ধে অস্ট্রেলিয়া ৩৩৮ রান তোলার পর ভারতীয় টিম যখন সাজঘরে ফিরছে, কোচ অমল মুজুমদার একটাও কথা বললেন না তাঁদের সঙ্গে। শুধু সাজঘরের সাদা বোর্ডে ইংরেজিতে লিখে দিলেন আটটি শব্দের একটি লাইন,

'We just need one more run than them to reach the final'

অর্থাৎ

' ফাইনালে পৌঁছতে গেলে আমাদের শুধু এক রান বেশি তুলতে হবে।'

এই একটা লাইনেই পরিষ্কার লক্ষ্য মেলে ধরলেন কোচ। আর তাতেই অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রবল প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট পাকা করে নিল ভারত।

আরও পড়ুন

শেফালি-দীপ্তি যেন জয় আর বীরু, বন্ধুত্বের দর্পে ভেঙে খান খান প্রোটিয়া প্রতিরোধ

ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দলটিও নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে এসেছিল ফাইনালে। লরা উলভার্ট এসেছেন সেমিফাইনালে সেঞ্চুরি করে। ফলে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে একেবারেই হালকাভাবে নেয়নি টিম ইন্ডিয়া। তবে, কোচ বিশ্বাস রেখেছিলেন নিজের দলের উপরে। ম্যাচের আগের পেপ টকে সব সময় উদ্বুদ্ধ করছিলেন দলকে। সিলেকশন নিয়ে অধিনায়কের সঙ্গে লম্বা আলোচনা হোক, কিংবা স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কথোপকথন, সব সময়ই দলের সঙ্গেই অবস্থান করছিলেন কোচ অমল মুজুমদার। তাই কোচ স্যারের প্রতি পূর্ণ আস্থাও রেখেছিলেন হারমনপ্রীতরা। সেমিফাইনালের পর ভারতীয় মহিলা দলের অধিনায়ক হারমনপ্রীত কৌর বলেছিলেন,

'স্যারের উপরে আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। স্যার যা বলেন, সেটা একেবারে হৃদয় দিয়ে বলেন। কখনও কখনও স্যার কঠোর হন, তবুও সেটা আমাদের ভালোর জন্যই।'

মহিলা ক্রিকেটের গুরু, রমাকান্ত আচরেকরের শিষ্য অমল মুজুমদার

ক্যাপ্টেনের এই কথোপকথনের মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়, ভারতীয় দলে কোচ অমল মুজুমদারের প্রভাব নীরব, তিনি ক্যামেরার সামনে বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না, বরং তিনি বিশ্বাস করেন কাজে। তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত সাহসী হলেও দলের ক্ষেত্রে সেসব ভালো প্রমাণিত হয়ে এসেছে বারবার। তরুণ ক্রিকেটারদের চান্স দেওয়া থেকে শুরু করে সঠিক খেলোয়াড়কে সঠিক জায়গায় খেলানো সবকিছুই তাঁর প্রশিক্ষণের মুনশিয়ানার প্রমাণ বহন করে। ক্রান্তি গৌড় কিংবা শ্রী চরণীর মতো তরুণ বোলারদের সুযোগ দেওয়া থেকে শুরু করে সেমিফাইনালে জেমিমাকে তিন নম্বরে নামানোর সিদ্ধান্ত সবকিছুই ছিল তাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত। তাই হয়ত ম্যাচের পর গুরু অমল মুজুমদারের পা ধরে হারমনপ্রীত তাঁকে জানালেন এক অনন্য গুরুদক্ষিণা।

নিজের দুরন্ত ব্যাটিং দক্ষতার জন্য এককালে তাঁকে বলা হত দ্বিতীয় সচিন তেন্ডুলকর। মধ্যবর্তী ক্রমের খেলোয়াড় হওয়ার কারণে রাহুল দ্রাবিড় কিংবা ভিভিএস লক্ষণকে টেক্কা দিয়ে অমল মুজুমদার হয়ত কোনোদিন জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাননি। কিন্তু, সেই সুযোগ না পাওয়া 'দ্বিতীয় সচিন'ই আজ ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটকে নিয়ে গেলেন এক নতুন উচ্চতায়, হয়ে উঠলেন রাজকন্যেদের রূপকথার নেপথ্য নায়ক।

More Articles