চৌকিদারই চোর? বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি নির্বাচনী বন্ডই?
Bharti Airtel Electoral Bond: ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখ, সংসদে যে নতুন টেলিকম বিল পেশ হয়, সেই সময়ে ১৪৩ জন বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত দুর্নীতির খবর আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য যা চালু করেছিলেন আমাদের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, প্রয়াত অরুণ জেটলি, দেখা যাচ্ছে তা ক্রমশ শুধু দেশের নয়, বিশ্বের অন্যতম বড় দুর্নীতি হয়ে উঠছে। এই নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতির সমালোচনায় সরব হয়েছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রীর স্বামী, পারকালা প্রভাকর সহ অন্যান্যরা। বেশ কিছু সাংবাদিকের নিরলস লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরে জানা যাচ্ছে, দুর্নীতি দমন করার নামে কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলিহেলনে, ইডি এবং সিবিআই কীভাবে তোলাবাজি করে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার থেকে টাকা তুলেছে নিজেদের দলীয় তহবিলে। শুধু তাই নয়, এমনটাও প্রকাশ্যে এসেছে, বেশ কিছু সংস্থার যত না লাভ হয়েছে, তার বহুগুণ টাকা রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিজেপিকে দিয়েছে। সেখানেও প্রশ্ন উঠেছে, সেই টাকার উৎস কী? তাহলে কি দেশের কিছু বৃহৎ শিল্পপতি ঘুরপথে বিজেপিকে টাকা দিয়েছেন, যাতে ব্যবসায়িক সুবিধা পাওয়া যায়। এমন তথ্য আসছে যাতে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা মিলিতভাবে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে।
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তাহলে কি ওষুধের গুণগত মান কমিয়ে এই টাকা দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, একমাত্র বাম দলগুলো ছাড়া সবাই টাকা পেয়েছে। সেইজন্যই এই নিয়ে কোনও বিরোধিতাও হচ্ছে না। রোজ এই বিষয় নিয়ে নতুন নতুন তথ্য আসছে। সবটা দেখে শুনে মনে হচ্ছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ‘ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল'-এর এক নতুন সংস্করণ এনেছে, ‘গর্ভমেন্ট অফ দ্য কর্পোরেট, বাই দ্য কর্পোরেট এবং ফর দ্য কর্পোরেট’। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার পরে এবং স্টেট ব্যাঙ্ককে সমস্ত তথ্য প্রকাশ্যে আনতে বলার পরে প্রতিদিন নতুন নতুন এমন উদাহরণ আসছে, যা দেখে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য।
আরও পড়ুন- নির্বাচনী বন্ডের নামে কীভাবে তোলাবাজি চক্র চালাচ্ছিল মোদি-শাহের বিজেপি?
গত ২০১৩ সাল থেকে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে কোটাক মহিন্দ্রা ব্যাঙ্কের কিছু জটিলতা চলছিল। নানা সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কোটাক মহিন্দ্রা ব্যাঙ্ককে কিছু নির্দেশাবলী মেনে চলার কথা জানাচ্ছিল। কোটাক মহিন্দ্রা ব্যাঙ্কের মাথা, উদয় কোটাক দীর্ঘদিন ধরে সেই সব পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছিলেন, এমনকী তাঁরা সুপ্রিম কোর্টেও গেছিলেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, কিছুতেই সমস্যা মিটছিল না। নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার পরে দেখা গেছে, তিন খেপে তাঁরা ৬০ কোটি টাকা দিয়েছে এবং তা পেয়েছে বিজেপি। তারপরেই দেখা যায়, যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক একসময় উদয় কোটাকের উপর খড়্গহস্ত ছিল, সেই তারাই উদয় কোটাককে কোটাক ব্যাঙ্ককে ৩২ মাস আরও চালানোর অনুমতি দেন। বোঝাই যাচ্ছে কে বা কারা ওই নির্দেশ দিতে তাদের বাধ্য করেন। শুধু কোটাক মহিন্দ্রা নয়, ভারতী এয়ারটেল মোবাইল সংস্থা নিয়েও কথা ওঠা শুরু হয়েছে।
২০১২ সালে দেশের সমস্ত গণমাধ্যমে তখন একটাই আলোচনা, কংগ্রেসের দুর্নীতি। তাদের ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি তখন দেশ জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি আওয়াজ তুলেছেন, ‘বহুত হুয়া ভ্রষ্টাচার, আব কি বার মোদি সরকার’। দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রায়ে জানায় ১২২ টি টেলিকম লাইসেন্স, যা কংগ্রেস সরকার দিয়েছিল, তা বাতিল করতে হবে। সমস্ত গণমাধ্যমে এই বিষয় নিয়ে খবর হয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এটি এক দৃষ্টান্তকারী সিদ্ধান্ত। তার প্রায় এক দশক পরে, নরেন্দ্র মোদির সরকার যে নতুন টেলিকম বিল নিয়ে আসে, তার মধ্যেও যে দুর্নীতি হয়েছে তা আজকের নির্বাচনী বন্ডের তথ্য দেখে বোঝা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ভারতী এয়ারটেল নির্বাচনী বন্ডে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা দিয়ে তার বিনিময়ে ব্রডব্যান্ডের ব্যবসার অনুমতি পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের ৯ তারিখে, তাঁরা ওই টাকার বন্ড কেনার পরে, ২১ নভেম্বর ছাড়পত্র পায়।
বেশিরভাগ মানুষ ভুলে গেলেও, অনেকের নিশ্চিত খেয়াল আছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৮ তারিখ, সংসদে যে নতুন টেলিকম বিল পেশ হয়, সেই সময়ে ১৪৩ জন বিরোধী সাংসদকে কীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ওই বিলে বলা হয়েছে, সরকার নিজের সুবিধা অনুযায়ী শুধু ইন্টারনেট বন্ধই করতে পারবে তা নয়, যে কোনও ব্যক্তির মোবাইলে নজরদারি চালাতে পারে। সেই বিলেই বলা হয়েছে, নিলাম না করেই যে কোনও পছন্দমতো সংস্থাকে ব্রডব্যান্ড চালানোর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। টেলিকম মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব সেই সময়ে বলেছিলেন, সারা বিশ্বে এখন এটাই নিয়ম! নিলাম না করেই কোনও সংস্থাকে বরাত দেওয়াটাই বস্তুর। নির্বাচনী বন্ডের তথ্য দেখলে কি মনে হবে না, এই বরাত পাইয়ে দেওয়া এবং সেই সংক্রান্ত বিল পাশ করানোর সঙ্গে
এর সংযোগ আছে?
আরও পড়ুন- ইডি হানা দেয়নি কখনই! বন্ডের বিনিময়ে বিজেপির থেকে কী কী সুবিধে নিয়েছেন লক্ষ্মী মিত্তল?
রাস্তাঘাটে কান পাতলে এই নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতি নিয়ে কিছু কথা শোনা যাচ্ছে বটে কিন্তু তা খুব জোরালো নয়। মানুষ সম্ভবত এই দুর্নীতি মেনে নিয়েছে। তবে অনেক মানুষই বলছেন, রাজ্যের শাসকদলের দুর্নীতি সচেতনভাবে দেখানো হয়েছিল, যাতে মানুষের মনে ওই পরিমাণ টাকার ছবি দেখে প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু বিজেপির এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ফলে কত টাকা প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর অনুগত সহচরদের হাতে গেছে তা বোঝা যাচ্ছে না! ৬০০০ কোটির শূন্য গুনতে গুনতেই চলে যাচ্ছে বেলা! তবে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তাদের বক্তব্য, যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করার জন্য এই নির্বাচনী বন্ড আনা হলো, যে চৌকিদার বা দারোগা নিজে বলেছিলেন, তিনিই আম জনতার টাকার রক্ষাকর্তা, দিনের শেষে যদি দেখা যায়, সেই চৌকিদার নিজেই চুরি করে আখের গুছিয়েছে, তখন তাঁকে কে শাস্তি দেবে? কোন ইডি বা সিবিআই সেই তদন্ত করবে? কংগ্রেসের প্রশ্ন, এই তোলাবাজি করে, নিজেদের দলীয় ভাণ্ডারে টাকা তোলা কি যথেষ্ট দুর্নীতি নয়? দুর্নীতি বন্ধ করার নাম করে চৌকিদার যে আরও বড় ডাকাতি করলেন, তার সাজা কীভাবে দেওয়া সম্ভব?
অনেকে বলতে পারেন, এই দুর্নীতি যদি এতই বড়, তাহলে তা নিয়ে প্রচলিত গণমাধ্যমে আলোচনা নেই কেন? এখানেই আসল রহস্য লুকিয়ে। এরকম বেশ কিছু সংস্থার নাম আসছে, যেমন মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং বা এসেল গ্রুপ, যাঁদের আবার নিজস্ব গণমাধ্যমও আছে। ফলত বোঝাই যাচ্ছে, কেন এই বিষয় নিয়ে
কোনও আলোচনা হচ্ছে না সান্ধ্যকালীন টিভি-পর্দায়। তবে এই ধরনের গণমাধ্যমের বাইরেও বেশ কিছু সংবাদ সংস্থা এই দুর্নীতির খবর রোজ প্রকাশ করছে। তাঁদের এই নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নতুন আখ্যান তৈরির চেষ্টা করছেন। নিজেকে সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে রেখে 'রবিনহুড' কিংবা 'দাতা কর্ণ' সত্ত্বা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। সেই জন্যই তিনি কৃষ্ণনগরের বিজেপি প্রার্থীকে ফোন করে তার প্রচার করেছেন। বলেছেন, ইডি এই রাজ্যের
নেতা মন্ত্রীদের অসদুপায় অবলম্বন করে উপার্জন করা যে ৩০০০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে, সেই টাকা তিনি বাংলার গরিব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। এখানেই সেই প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আসছে! যাঁর দায়িত্ব ছিল চৌকিদার হওয়ার, দুর্নীতি বন্ধ করার, তিনিই যদি দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তোলেন তাহলে কি নাগরিকদের উচিত নয়, এবার নতুন করে বলা- 'গলি গলি মে শোর হ্যয় চৌকিদার হি চোর হ্যায়'!