দুনিয়ায় বেড়ে চলা হিংসায় ফেসবুকের প্রভাব কতটা?
ফেসবুকের জনপ্রিয়তা সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে! ফেসবুকের সব অ্যাপে প্রায় ৩৫০ কোটি গ্রাহক রয়েছেন, যা বিশ্বের মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৬০ শতাংশ! এই বিপুল পরিমাণ গ্রাহকসংখ্যার কারণেই যে কোনও সময় বিশ্বের যে কোনও দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চরিত্র বদল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মটি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ফেসবুকের প্রভাব উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি। অনেক দিন ধরেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট করার মতো মারাত্মক অভিযোগ উঠছিল। যদিও, সেই অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে এসেছে এই মার্কিন সংস্থাটিও। তবে, এবার সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ফেসবুকের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন সংস্থারই এক কর্মী। কীভাবে বুঝেশুনে সমাজকে ধ্বংস করার কাজ করে চলেছে এই সংস্থাটি, তা সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন ফেসবুকের প্রাক্তন প্রোডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সিস হাউগেন। তাঁর অভিযোগ, সমাজের ক্ষতি হবে জেনেও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মানুষের জীবনের পরিবর্তে অর্থকেই গুরুত্ব দেয় ফেসবুক। সম্প্রতি কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ফেসবুকের সব পরিষেবা। এছাড়াও, প্রায় ১৫০ কোটি ফেসবুক গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য সামনে আসার অভিযোগ উঠেছিল কোম্পানির বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্সিসের অভিযোগে আরও চাপের মুখে ফেসবুক।
চলতি বছর সেপ্টেম্বরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এক রিপোর্টে ফেসবুক কীভাবে জেনেশুনে তরুণ-তরুণীর জীবনে ক্ষতি করছে তা জানানো হয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, তরুণীদের জন্য ইনস্টাগ্রাম কতটা ক্ষতিকর তা জানার পরেও কোম্পানির তরফ থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এক-তৃতীয়াংশ তরুণী ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারের কারণে নিজেকে নিয়ে অবসাদের শিকার হচ্ছেন বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল। তবে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ তথ্য কীভাবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের কাছে পৌঁছল তা নিয়ে ধন্ধে ছিলেন সকলেই। পরে এক সাক্ষাৎকারে এই তথ্য কোম্পানির বাইরে নিয়ে আসার কথা মেনে নিয়েছেন ফ্রান্সিস।
তিনি অভিযোগ করেছেন, ফেসবুকের অভ্যন্তরীণ গবেষণায় উঠে এসেছে, তারা বিশ্বব্যাপী ঘৃণা, ভুল তথ্য সরবরাহ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করছে। গবেষণার রিপোর্ট জানা সত্ত্বেও তা সাধারণ মানুষের সামনে নিয়ে আসছে না ফেসবুক।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, “কোনও সিদ্ধান্ত যদি মানুষের জন্য ঠিক হয় অন্যদিকে বিপরীত সিদ্ধান্তে যদি ফেসবুকের লাভ হয়, তবে, সংস্থার তরফ থেকে প্রত্যেকবার ফেসবুকের লাভকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। ফেসবুকের মধ্যে ঠিক কী কী চলছে তা সংস্থার বাইরের কেউ জানেন না। এর পরেই আমি সিদ্ধান্ত নিই ধীরে ধীরে কোম্পানির কিছু তথ্য প্রকাশ্যে আনব। এর ফলে আর কেউ ফেসবুকের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।”
সাক্ষাৎকারেও তিনি ফেসবুকের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ গবেষণার ফলাফল সামনে নিয়ে এসেছেন। তিনি জানিয়েছেন, “সাধারণ মানুষকে নিয়মিত মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে ফেসবুক। এই সংস্থাটি কীভাবে বিশ্বব্যাপী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, বিভক্ত রাজনৈতিক বক্তব্য, ভুল তথ্য ছড়ানোর কাজ করছে সেই প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।”
"সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে সারাক্ষণ বিদ্বেষমূলক পোস্ট দেখার কারণে সাধারণ মানুষ একে অপরের উপরে বিশ্বাস হারাচ্ছেন। ফেসবুকের এই মনোভাবের কারণেই সমাজে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী হিংসা বাড়ছে,” বলেন তিনি।
ফেসবুকে আপনি যে পোস্ট দেখতে পান তা এনগেজমেন্টের উপরে নির্ভর করে। অর্থাৎ যে পোস্টে যত বেশি লাইক ও কমেন্ট হয় সেই পোস্ট নিউজ ফিডে তত উপরে চলে আসে। ফেসবুকের এই অ্যালগোরিদমের কারণেই সমাজে সমস্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে ফ্রান্সেস হাউগেন। তিনি জানিয়েছেন, ফেসবুকের আভ্যন্তরীণ গবেষণায় জানা গিয়েছে ঘৃণামূলক পোস্ট খুব সহজেই মানুষকে উত্তেজিত করে। ফলে সেই ধরনের পোস্টে এনগেজমেন্ট দ্রুত বাড়তে থাকে। এই তথ্য জানার পরেও ফেসবুক নিজেদের অ্যালগোরিদম ঠিক করছে না। ফেসবুক বুঝতে পেরেছে এই অ্যালগোরিদম পরিবর্তন করলে মানুষ আগের থেকে কম সময় তাদের সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করবে। এর ফলে কম বিজ্ঞাপনে ক্লিক করবেন গ্রাহকরা, ফলে কমে যাবে কোম্পানির লাভ। গ্রাহক যত বেশি ফেসবুক ব্যবহার করবেন কোম্পানি তত বেশি লাভ করবে। আর এই কারণেই ঘৃণামূলক পোস্ট দেখিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করার কাজ করে চলেছে ফেসবুক। গ্রাহক ফেসবুক পোস্ট দেখে যত রেগে যাবেন তত বেশি পোস্টে লাইক-কমেন্ট বাড়তে থাকবে।
তবে শুধুমাত্র একটি সাক্ষাৎকারে থেমে থাকেননি ফ্রান্সিস হাউগেন। মার্কিন সেনেটের সামনে নিজের সব অভিযোগ জমা দিয়েছেন তিনি। ফ্রান্সিস সেখানে অভিযোগ করেছেন, কোম্পানির আধিকারিকরা ফেসবুকের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মকে কীভাবে আরও সুরক্ষিত করা সম্ভব সেই উপায় জানলেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। কারণ কোম্পানির তরফ থেকে তাদের আকাশছোঁয়া লাভকে মানুষের জীবনের আগে রাখা হয়েছে। এর ফলে সমাজে আরও বেশি বিভাজন তৈরি। অনেক ক্ষেত্রেই এর ফলে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। জেনেশুনে ফেসবুকের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের জন্যই এই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আর সব জেনেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না ফেসবুক, অভিযোগ হাউগেনের।
একই সঙ্গে ইনস্টাগ্রামকে সিগারেটের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। এমনকি, ফেসবুকের সঙ্গে তামাকজাত কোম্পানিগুলির মতোই আচরণ করা উচিত বলে মত হাউগেনের।
তিনি আশঙ্কা করেছেন, এখনই এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বিশ্বব্যাপী যে হিংসা আজ আমরা দেখতে পারছি, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। তিনি জানিয়েছেন, মানব সভ্যতার এই প্রচ্ছদের শেষ অংশ এতটাই ভয়ঙ্কর হতে চলেছে যে কেউ তা পড়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করবেন না।
তবে শুধুমাত্র আশঙ্কা করেই থেকে থাকেননি ফ্রান্সিস। কীভাবে এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎকে এড়ানো সম্ভব সেই বিষয়ে দিক-নির্দেশ করেছেন তিনি। এই জন্য ফেসবুকের সব অভ্যন্তরীণ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ্যে নিয়ে আসার দাবি তুলেছেন ফ্রান্সিস। এছাড়াও সরকারের তরফ থেকে আরও কড়া মনোভাব দেখানোর আবেদন করেছেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, অ্যালগোরিদম ব্যবহার না করে নিউজফিডে কালানুক্রমিকভাবে পোস্ট দেখালে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে।
ফেসবুকের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, সংস্থার ভিতরে ঠিক কী কী হয় সেই বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান নেই ফ্রান্সেসের। এই গবেষণার সঙ্গে তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। চলতি মাসে মার্ক জুকারবার্গ এই বিষয়ে জানিয়েছেন, “অভিযোগগুলি সত্যি নয়,” এবং "এই অভিযোগের কোনও মানে হয় না।” এছাড়াও, কম বয়সীদের উপরে ইনস্টাগ্রামের প্রভাবের রিপোর্টকে ভুলভাবে পরিবেশন করার অভিযোগ করেছেন মার্ক জুকারবার্গ।
ফ্রান্সিসের সাহসিকতাকে অনেকেই কুর্নিশ জানিয়েছেন। তবে ফেসবুকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ যদি সত্যি হয় সেই ক্ষেত্রে তা ঠিক করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এর আগেও একাধিকবার ফেসবুকের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ উঠলেও প্রত্যেকবার ঘুরে দাঁড়িয়ে লাভের পরিমাণ বাড়িয়েছে সংস্থাটি। এবার কীভাবে ফেসবুক এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসে তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকেই।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.wsj.com/articles/facebook-knows-instagram-is-toxic-for-teen-girls-company-documents-show-11631620739
- https://www.wsj.com/articles/facebook-whistleblower-frances-haugen-says-she-wants-to-fix-the-company-not-harm-it-11633304122?mod=series_facebookfiles
- https://www.theguardian.com/technology/2021/oct/06/mark-zuckerberg-hits-back-at-facebook-whistleblower-frances-haugen-claims