বারাসাত কাল্পিক-এর 'অদ্ভুত লাইব্রেরি'! একটি পাঠ অভিজ্ঞতা

Barasat Kalpik: লাইব্রেরিয়ানের কন্ঠে যখন শোনা যায় “শোক ছাত্রদের মানায় না”— তখন তা হয়ে ওঠে এই প্রযোজনার সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত।

শিক্ষা জ্ঞানচক্ষুর কপাট দড়াম করে খুলে দেবে- এই প্রত্যাশা আদি অনন্তকালের। কিন্তু সেই শিক্ষা যদি শিকল পরিয়ে দেয়, তবে? হারুকি মুরাকামির মূল উপন্যাস 'অদ্ভুত লাইব্রেরি' থেকে বারাসত কাল্পিকের সাম্প্রতিক নাট্যপ্রযোজনা হয়ে উঠল সেই দ্বন্দ্বেরই এক রূপক উপস্থাপনা। দেবব্রত ব্যানার্জির সংযমী অথচ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নির্দেশনায়, সুদীপ বসুর রূপান্তরে,অভি চক্রবর্তীর সুচারু কলমে এই নাটক হয়ে উঠেছে আত্মার অনন্ত গ্রন্থাগারে প্রবেশের এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এই রূপান্তর এক স্বপ্নময় অথচ হাড়-হিম করা দার্শনিক অনুসন্ধানে রূপ নিয়েছে অচিরেই।

শিক্ষা, শৃঙ্খল, প্রেম, মৃত্যু, ইতিহাস, বর্তমান— এই সবকিছুর জটিল সংলাপে মঞ্চে রচিত হয়েছে মানব-অভিজ্ঞতার এক দুর্বোধ্য প্রতিচ্ছবি। আর সেই বার্তালাপে অর্ণব কুমার রায়ের আলো যেন এক নীরব চরিত্র। ভয়, নিঃসঙ্গতা, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় আলো-আঁধার দর্শককে টেনে নিয়ে যায় অনন্ত শূন্যতায়। লাইব্রেরিয়ানের মুখে পরা ক্ষীণ আলোর আঁচড়ে বা শূন্য খাঁচার আর্তিতে ফুটে ওঠে মিথ আর আতঙ্কের রসায়ন। শেষে হঠাৎ সাদা আলোর প্লাবনে মুক্তির মতো কিছু আসলেও, তার ভিতরেই যেন বেজে চলে অমোঘ এক মৃত্যু-স্মরণ। সুসান সন্টাগ যেমন বার্গম্যানকে নিয়ে বলেছিলেন, আলো কখনও কখনও চরিত্র হয়ে ওঠে—এই নাটকের আলো-ছায়া তেমনই মুক্তির দীপ্তি আর মৃত্যুর বেদনাবোধে দার্শনিক ওজন বহন করে। নীলাংশুক দত্তের আবহ বাজে হৃদস্পন্দনের মতো। কখনও নীরবতার প্রান্তে থেমে থেমে, কখনও মাটির ঘ্রাণে ভিজিয়ে দেয় ভয় আর আশা। যেন ফিলিপ গ্লাসের মিনিমালিস্ট রচনার প্রতিধ্বনি, অথচ তার মধ্যেই কোথাও উঁকি মারে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের অন্তর্লীন সুর।

আরও পড়ুন- শশী তোমার শরীর নাই, ঘর নাই? পুতুলনাচের ইতিকথা ছবির নিবিড়পাঠ

চরিত্ররূপে ভেড়ামানুষের (অজয় বিশ্বাস) ভয়ংকর দ্ব্যর্থতা ফুটে ওঠে সারা নাটক জুড়ে। সে না সম্পূর্ণ দানব, না নিছক রক্ষাকর্তা—বরং জ্ঞানের এক দ্বৈত রূপ। মুক্তির প্রতিশ্রুতি, দাসত্বের ছায়া—দুই-ই তার শরীরী ভাষায় উপস্থিত। অ্যান্টোনিন আর্তোর থিয়েটার অফ ক্রুয়েলটি–র মতোই এই চরিত্র যেন বাস্তবতার অতীত আর ভীতির আনুষ্ঠানিক প্রতিমূর্তি। অন্যদিকে নার্সের (অভিনন্দনা দে) চরিত্রটি মঞ্চে আনে মমতা আর ভালোবাসার সামান্য আলো। কিন্তু সেই আলোও দ্বিধাময়—ব্রেখটের ভেরফ্রেমডুংর বা (Verfremdungseffekt) মতো, সহজ ক্যাথারসিস থেকে দূরে সরিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন তোলে মনে।

মঞ্চশিল্প নাটকে ভেসে ওঠে স্বপ্নদৃশ্যের মতো। অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের কাটআউট, ভাসমান মেঘ, ভাঙাচোরা সিলুয়েট— সব মিলিয়ে এই দৃশ্যশিল্প যেন টাদেউস কান্টরের পরীক্ষামূলক মঞ্চভাষাকে স্মরণ করায়। সময়, স্থান, ইতিহাস— সবই এখানে দ্রবীভূত হয়ে যায় কালাতীত যাত্রায়।

আরও পড়ুন- সলিল চৌধুরীকে কেন বুঝতেই পারল না সেকালের কমিউনিস্ট পার্টি?

কিশোর নায়কের (অনুভব সেনগুপ্ত) ওপর চাপানো হয় জীবনের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক শিক্ষাব্যবস্থার নির্বিচার বোঝা—সাবমেরিন তৈরির খুঁটিনাটি, মেষপালনের পদ্ধতি, অটোমান সাম্রাজ্যের কর আদায়ের ইতিহাস ইত্যাদি। ফুকো যেমন Discipline and Punish–এ বলেছিলেন, শিক্ষা শুধু জ্ঞান দেয় না, শরীর-মনকে শাসনের যন্ত্রে পরিণত করে—তেমনই এই নাটকে বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ানের (প্রসুন ব্যানার্জি) সংলাপ “শীত অভ্যাস হয়ে যাবে” বা “মানুষ মানুষকে খায়” হয়ে ওঠে নাটকের সবচেয়ে নির্মম উচ্চারণ, শোষণের নগ্ন স্বীকৃতি। পুঁজি যেমন তরুণ প্রতিভাকে গ্রাস করে, লাইব্রেরি তেমনি গিলে খায় কিশোর মস্তিষ্ককে। এই নাটক স্মরণ করায় তাজমহলের শ্রমিকদের অজ্ঞাত মৃত্যুর কথা—যারা হারিয়ে গিয়েছিল সৌন্দর্যের পেছনে। তাদের রক্তে গড়ে ওঠা ঐতিহ্য আজও নীরব। গ্যাস চেম্বারের ইতিহাস শেখায়—মানুষকে মানুষ হতে হলে অতীতের বেদনাকে জানতে হয়। অ্যাডর্নো বলেছিলেন, “আউশভিৎসের পর কবিতা লেখা নিষ্ঠুর, কিন্তু আউশভিৎস ভুলে যাওয়া তার চেয়েও ভয়ংকর।” কেবল বিশ্বজনীন ইতিহাস নয়, স্থানীয় ঘটনাবলীও জুড়ে গেছে নাটকের চলনে। আরজি কর মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ধর্ষণ বা আহমেদাবাদের বিমান দুর্ঘটনায় হোস্টেলের ছাত্রদের মৃত্যু—প্রমাণ করে যে অতীতের নৃশংসতা ও বর্তমানের ট্র্যাজেডি একই স্রোতে বহমান। মুরাকামির সেই উক্তির মতোই, “অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ একই সঙ্গে ঘটে চলে।”

লাইব্রেরিয়ানের কন্ঠে যখন শোনা যায় “শোক ছাত্রদের মানায় না”— তখন তা হয়ে ওঠে এই প্রযোজনার সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত। যে শিক্ষা শোককে নিষিদ্ধ করে, তা মানুষকে যন্ত্রে রূপান্তরিত করে এবং শেষে কিশোর যখন উপলব্ধি করে— “লাইব্রেরি আর শ্মশান একই পথে ছিল ”— তখন স্পষ্ট হয় উপলব্ধিহীন জ্ঞানের ভাণ্ডারই হয়ত হয়ে ওঠে মৃত্যুর রাস্তা। কিন্তু সবশেষে নাটকের পর্দা নামে সন্তান আর মায়ের বিচ্ছেদে, মায়ের মৃত্যুতে। কোনো প্রতীক নয়, কোনো আলঙ্কারিতা নয়— কেবল এই নাটক বলে চলে জ্ঞান যদি প্রেমহীন হয়, তবে তা কেবল মৃত শূন্যতা, শূন্য সঞ্চয়। ভালোবাসার মধ্য দিয়েই মৃত্যু হয়ে ওঠে জীবনের শেষ পাঠ। দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অদ্ভুত লাইব্রেরি শুধু নাট্যরূপ নয়— এ যেন আধুনিক মানবসভ্যতার প্রশ্নপত্র, এক দার্শনিক উপাখ্যান।

More Articles