হ্যালোইনে মজে বাঙালি; গপ্পের মামদো ভূতেরা আজ উপেক্ষিত

Halloween: চতুর্দশীর চোদ্দো শাক ও চোদ্দো প্রদীপ ঠিক যতটা সাদামাটা, হ্যালোইনের ভৌতিক সাজসজ্জা এবং তামসিক আবহের রোমাঞ্চ ঠিক ততটাই রঙিন। সঙ্গে উপরি পাওনা, ‘ট্রিক, অর ট্রিটে সাজানো চকোলেটের বাক্স’।

বাঙালি মনের আনন্দে পাশ্চাত্যের বহু কিছুই নিজের জীবনে গ্রহণ করেছে। চলন-বলন,খাদ্যাভ্যাস কিংবা রীতি-আচার সবেতেই তার ছোঁয়া বর্তমান। বেশ একটা এদেশীয়-বিদেশীয় মিলে, খিচুড়িমার্কা হাইব্রিড কালচারে সর্বত্র ছয়লাপ। অর্থাৎ বারো মাস এখন গিয়ে ঠেকেছে চোদ্দো পাব্বনে। আর এই তালিকার নবীনতম সংযোজন হল ‘হ্যালোইন’।

পৃথিবীর সমস্ত দেশেরই একটা নিজস্বতা আছে। ব্যতিক্রম কেবল ধর্ম। স্রেফ এই একটা ক্ষেত্রে কাহিনি-উপকাহিনিগুলিকে এক সরলরেখায় ফেললে, শুধু যে অমিলই মিলবে তা কিন্তু নয়। নামভেদ থাকবে কিন্তু আচার প্রায় এক। এই যেমন, বাঙালির ভূতচতুর্দশী এবং পাশ্চাত্যের হ্যালোইন! কয়েনের দুই পৃষ্ঠ। তবুও ভূতচতুর্দশী ছেড়ে ‘হ্যালোইনেই’ এখন বেশি মজে বাঙালিরা। অবশ্য এর একটা গুরুতর কারণ এমনও হতে পারে যে, বাঙালির নিজেদের মামদো ভূতের তুলনায় পাশ্চাত্যের ড্রাকুলা ভূতেরা মস্তিষ্কে অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণে বেশি সিদ্ধহস্ত। অস্বীকার করার উপায় নেই, চতুর্দশীর চোদ্দো শাক ও চোদ্দো প্রদীপ ঠিক যতটা সাদামাটা, হ্যালোইনের ভৌতিক সাজসজ্জা এবং তামসিক আবহের রোমাঞ্চ ঠিক ততটাই রঙিন। সঙ্গে উপরি পাওনা, ‘ট্রিক, অর ট্রিটে সাজানো চকোলেটের বাক্স’।

বাঙালির অন্দরমহলে হ্যালোইনের বাড়বাড়ন্ত ‘ইদানিং’ হলেও, পাশ্চাত্য হ্যালোইনের বয়স কিন্তু আনুমানিক ২০০০ বছর। প্রথম দিকে অবশ্য এই রীতি ‘সামহেইন’ নামেই পরিচিত ছিল। পরে স্কটিশ শব্দ 'অল হ্যালোজ' ইভ থেকে আসে। হ্যালোইন বা হ্যালোউইন শব্দটি, ১৭৪৫ সালে। যার অর্থ পবিত্র সন্ধ্যা। মনে করা হয়, এদিন মৃতেরা পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসেন। দেখা করেন নিজেদের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কিংবা জানান দেন নিজেদের অস্তিত্বের। প্রতি বছর ৩১ অক্টোবরটা হ্যালোইন দিবসের নামে নামাঙ্কিত। কারণ, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাছে ৩১ অক্টোবর (কেলটিক ক্যালেন্ডার) হলো বছরের শেষ দিন। এবং তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই দিনে প্রকৃতির নেতিবাচক শক্তি পুনর্জীবিত হয়। মৃতেরা জেগে ওঠেন। তাই তাঁদের একপ্রকার খুশি করতেই এই উৎসব। যাতে 'তেনারা' কর্তৃক কারোর ক্ষতি না হয়।

আরও পড়ুন- অশুভ আত্মা তাড়ানোর উৎসব! হ্যালোউইনের অজানা গল্প জানলে শিউরে উঠতেই হবে

যদিও ইতিহাসের শিকড় ধরে আরেকটু গভীরে গেলে এই উৎসবের অন্য একটি সত্য,‘যা নির্মম, যা কালের অন্তরালে এখনও সজীব’ তা বর্তমান। পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর ইউরোপে কালোজাদু অভ্যেসের একটা রমরমা শুরু হয়। ধারণা দাঁড়ায়, পুরুষ অপেক্ষা নারীরা এই কু-বিদ্যায় বেশি আসক্ত। ক্রমে প্রচলন বাড়ে ‘ডাইনি’ (witches) শব্দটারও। কারোর উপর সন্দেহ হলেই তাকে ‘ডাইনি’ দাগিয়ে দেওয়াটা প্রায় নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। বিশেষত যেসব নারীদের চিন্তাধারা আর পাঁচজনের থেকে ভিন্ন, যাঁরা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার জ্ঞান রাখতেন, বিভিন্ন ধরনের গাছপালা সংগ্রহ করতেন, তাঁদের খুব সহজেই সেই সমাজ ‘অশুভ’ বলে চিহ্নিত করত।

মামদো ভূতের রাজ্যে বাসা বেঁধেছে 'হ্যালোইন'

মনে করা হতো, ব্যক্তি বা সমাজের যাবতীয় অঘটনের পেছনে হাত রয়েছে এই ডাইনিদের। অতিবৃষ্টি,খরা,বন্যা,মহামারী— শয়তানের সঙ্গে চুক্তি করে এই ডাইনিরা নাকি সবকিছু করাতেই সক্ষম ছিলেন। অগত্যা, সংস্কার-কুসংস্কারের ফারাকে ব্যর্থ একটা সমাজের একাংশ তখন নেমে পড়লেন এই ‘ডাইনিদের’ শায়েস্তা করতে। নাম দেওয়া হল, ‘উইচ হান্ট'- ডাইনিদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা। ইংল্যান্ড, জার্মানি ও স্কটল্যান্ডে এই উইচ হান্টের নির্মমতা ছিল আরও প্রকট। অধিকতর ক্ষেত্রে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো তাঁদের। ইতিহাস বলছে, প্রায় ৬০ হাজার নারী সেই সময় এই অপবাদে প্রাণ হারান।

আরও পড়ুন - ভূতচতুর্দশী | আজও জেগে ওঠে পেঁচাপেঁচি, চোরাচুন্নি, ঝেঁয়ো পেত্নীর মতো বাঙালি ভূতেরা?

‘বদল’ প্রকৃতির নিয়ম। কালের নিয়মে সবই বদলায়। ঠিক যেমন অপবিদ্যার ভ্রম কাটিয়ে পাশ্চাত্য এখন সংস্কারযুক্ত। ডাইনি, অপবিদ্যা কিংবা ভূত— বাস্তব জীবনের বদলে সেলুলয়েড পর্দাতেই দেখতে বেশি পছন্দ করেন ওদেশের মানুষ। তাই হ্যালোইন এখন কেবল মজার একটি উৎসব। যেখানে আলো-অন্ধকার এবং বিশ্বাস এক সরলরেখায় অবস্থান করে কিন্তু কোনোটাই একে অপরকে লঙ্ঘন করে না। পরন্তু, স্ব স্ব অবস্থানে থেকে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করে। যা উপভোগ্য।

প্রসঙ্গত, পাশ্চাত্যের উৎসবসমূহের আঁচ আমাদের চেনা অন্দরের সবটুকু আলোকিত করতে পারলেও, অন্তরের বিস্তর একটা অংশ এখনও কলুষমুক্ত করতে পারেনি। পারলে, গত দুই দশকে ভারতে ৩০০০ এর বেশি মহিলাকে ডাইনি অপবাদে খুন হতে হতো না। ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, আসাম, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের খবরে ‘ডাইনি সন্দেহে মহিলাকে খুন’— হেডলাইন ছাপত না। কালীপুজোর রাতে, পুরুলিয়ায় ডাইনি সন্দেহে গৃহবধূকে পিটিয়ে খুন করা হতো না। সুতরাং, ভারতে ‘হ্যালোইন’ এখনও তার সুপ্রাচীন নির্মম বাস্তবতাকে পিছু ছাড়াতে পারেনি। বরং একটা উৎসবের অন্তরালে থাকা নির্মম সমাজের বাস্তবতা হয়েই থেকে গেছে।

More Articles