কেন্দ্রে কার্নিভাল আর প্রান্তে মৃত্যুমিছিল! নেতারা আর কবে দায়বদ্ধ হবেন?

Kolkata’s Carnival and Bengal’s Pain: যে মানুষেরা উত্তরবঙ্গ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমানে থাকেন তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হলো প্রান্তবাসীর বিপর্যয়ে কেন্দ্রের বিনোদন যজ্ঞ বন্ধ করা যায় না।

"আমরা মেয়ে বেচতে যাবো না কলকাতায়/ কোলকাতা কিনে আনবো মেয়ের বিয়েতে"

                                                                                                 —তারক সেন

শব্দ ব্রহ্ম কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে বোধহয় তা সত্যি নয়। তাই তো অঙ্গারভূমির উল্লেখযোগ্য কবির প্রত্যয় ভরা লাইনগুলো মলাটবন্দি হয়েই থেকে গেছে। আমরা কলকাতাকে কিনতে পারিনি বরং আমাদের যাবতীয় স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্খা, কল্পনা নিয়ে রোজ সেঁধিয়ে যাচ্ছি এক ভয়ঙ্কর হাঁ করা গহ্বরে, যার নাম কল্লোলিনী কলকাতা। সম্প্রতি এ বঙ্গভূমে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনা আরেকবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে এ রাজ্যের সব মানুষের ভালো-মন্দ, আনন্দ-দুঃখ ঠিক করবে কলকাতা।

শারদ উৎসবের ঠিক আগে কলকাতায় এক রাতের রেকর্ড বৃষ্টি, অসহায় মানুষের তড়িতাহত হয়ে মৃত্যু, জলমগ্ন কংক্রিটের জঙ্গল এবং বইপাড়ার অপূরণীয় ক্ষতির কোলাজ যে বিষাদ প্রতিমা তৈরি করেছিল, তার উদযাপন ছিল সার্বজনীন। সেই শোকে আমরা যাতে অংশ নিতে পারি, টিভি চ্যানেলের রাত-দিনের ধারাবিবরণী যাতে আমাদের চোখ এড়িয়ে না যেতে পারে, তার জন্য সরকার বাহাদুর দু-দিনের ছুটি ঘোষণা করলেন। আমরা অংশত মেঘলা আকাশকে সঙ্গী করে দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ এলাকায় বৃষ্টিহীন আগাম শারদ উৎসবে মাতলাম। আর দুর্গাপুজোর সমাপ্তি লগ্নে যখন প্রবল বর্ষণে বানভাসি উত্তরবঙ্গ, চারদিক ধ্বংসস্তুপ, দীর্ঘ হচ্ছে মৃত মানুষের সারি, আর্ত মানুষেরা রাস্তায় তখন কার্নিভালে মেতেছে শহর কলকাতা। ক্ষমতার কেন্দ্রে ও উপকেন্দ্রে থাকা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, বণিকসভার কর্তাব্যক্তি সুসজ্জিত মঞ্চে দন্ডায়মান, পাশে রঙ মাখা সঙের দল এবং অবশ্যই শহর কলকাতার আমোদগেঁড়ে প্রিয় সহনাগরিকেরা- সবাই এই জনগণের করের টাকায় হওয়া বিনোদন যজ্ঞে সামিল। এই কার্নিভাল মানবিক না অমানবিক, শ্লীল না অশ্লীল, সেই প্রশ্ন অবান্তর। মূল বিষয় হলো এই কার্নিভালের বার্তা। যে মানুষেরা উত্তরবঙ্গ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমানে থাকেন তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া হলো প্রান্তবাসীর বিপর্যয়ে কেন্দ্রের বিনোদন যজ্ঞ বন্ধ করা যায় না। কলকাতার বানভাসি হওয়ার ঘটনা দাবি করে সার্বজনীন প্রতিক্রিয়া, উত্তরবঙ্গের বন্যা নেহাৎই এক আঞ্চলিক ঘটনা, যেমনটা ঘাটালে প্রতিবছর হয়। আলিপুরে গগনচুম্বী ফ্ল্যাটের বাসিন্দার জলমগ্ন হওয়ার অভিজ্ঞতার মধ্যে যে মেট্রোপলিটন শোভনতা আছে তার সঙ্গে ভূতনির চরের সব হারানো মানুষটার অসংস্কৃত যন্ত্রণার তুলনা চলে না।

আরও পড়ুন

বন্যার মাঝে কার্নিভালে মুখ্যমন্ত্রী! অমানবিক রাজনীতির কৈফিয়ত কী?

উত্তরবঙ্গে এই বিপর্যয়ের মধ্যে কলকাতায় এই কার্নিভাল হওয়া কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এই ঘটনায় যার সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তাদের স্মরণ করাতে চাই যে আমাদের প্রতিবাদও আজ কলকাতা কেন্দ্রিক। অভয়ার নৃশংস হত্যার ঘটনা কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজে ঘটেছিল বলেই সারা কলকাতা পথে নেমেছিল। ক'দিন আগে রামপুরহাটে এক আদিবাসী কিশোরীর ধর্ষণ নৃশংস হত্যায় আমাদের অখন্ড নীরবতা কলকাতার মাহাত্ম্যকে মনে করিয়ে দেয়। আমাদের যাবতীয় প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভাষ্যে কলকাতার এই শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত। আমরা যারা প্রান্তে থাকি তারা সবাই কলকাতার নিজস্ব উপনিবেশের অঘোষিত প্রজা। বিকেন্দ্রীকরণ নেহাৎই এক কথার কথা, আদতে কলকাতার শংসাপত্র ছাড়া সব কিছুই অচল। নগর পরিকল্পনা হোক বা পরিবহন, সবকিছু কলকাতাকে ঘিরেই। কলকাতা বানভাসি হওয়ার পরে দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায়, টিভির আলোচনায়, উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে যে পরিমাণ উদ্বেগ ও সুচিন্তিত আলোচনা লক্ষ্য করেছি তার কণামাত্র নজরে পড়ে না আসানসোল-রানীগঞ্জের ধ্বস কবলিত হওয়ার নিত্য দিনের আখ্যানে বা মালদায় গঙ্গাবক্ষে একের পর এক গ্রাম তলিয়ে যাওয়ার আর্তনাদে।

এই আধিপত্যবাদের ইতিহাস সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে লেখা হচ্ছে। আজ শাসক পাল্টেছে কিন্তু নীতি ও কৌশল একই থেকে গেছে। এই আধিপত্যের গল্পের অনেকটা জুড়ে আছে সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। কলকাতার মানুষের বাচনভঙ্গী, বেশবাস, পাতাল রেল, কফি হাউস, ফিশ কবিরাজি, বিরিয়ানি, নন্দন, পার্ক স্ট্রিট- সব মিলিয়ে একটা মাপকাঠি যার নিরিখে মফস্বলের মানুষ তার ভদ্রবিত্তের সংস্কৃতিতে অংশীদারিত্ব বিচার করে, তৈরি হয় নতুন নতুন কলকাতা তৈরির প্রয়াস। এই আগ্রাসন ইতিমধ্যেই গ্রাস করেছে বারাসত, বারুইপুর, ব্যারাকপুর, শ্রীরামপুর, চন্দননগরের মতো একদা সমৃদ্ধ আঞ্চলিক ঐতিহ্যবাহী জনপদকে। মিনি কলকাতা বানাবার নেশাকে মান্যতা দেবার জন্য আনা হচ্ছে বৃহত্তর কলকাতার ধারণাকে।

আরও পড়ুন

বৃষ্টি, ধসে বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গ, কার্নিভাল স্থগিত করা গেল না কেন?

পরিবর্তনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে বিদ্বৎজনেরা এই সরকারের মধ্যে সাব-অল্টার্ন বৈশিষ্ট্য দেখে রীতিমত সন্দর্ভ রচনা করেছিলেন, আধিপত্যের এই নির্লজ্জ প্রদর্শন নিয়ে তারা কী ভাবছেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। আর এই কলকাতার সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের গল্পকে মস্তিষ্কে ধারণ করে মফস্বলের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পৌরোহিত্য করতে আসেন কলকাতার বিদ্বৎজনেরা। কবিতা উচ্চারিত হয় :

"আমরা সবাই সেই দিনটির প্রতীক্ষায় / যেদিন তিনি আসবেন,/ সবাইকে শুনিয়ে বলবেন: 'এই গ্রীষ্মে কাসুন্দি খুবই ভালো!'/ আর আমরা সবাই মাথা নেড়ে জানাবো/ এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি তাঁর মুখ থেকেই উচ্চারিত হলো।( বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।"

কলকাতার ভালো হোক।

More Articles