সম্মুখসমরে কাসপারভ-আনন্দ: দাবাবিশ্ব ফিরে যাচ্ছে ৩০ বছর আগের ঐতিহাসিক সেই দিনে

Garry Kasparov vs Viswanathan Anand: ২০২৫ সালে ফের মুখোমুখি হলেন কাসপারভ আর আনন্দ, ঠিক যেমন ফিশার আর স্প্যাসকি হয়েছিলেন। সেই ব্যবধান ছিল ২০ বছরের। আর, এঁদের ব্যবধান তিরিশ বছরের। আরও একটা তফাৎ রয়েছে।

গ্যারি কাসপারভের নামের পাশে এখন ক্রোয়েশিয়ার পতাকা। গ্যারি কাসপারভের এলো রেটিং এখন র‍্যাপিড দাবায় ২৭৮৩ আর ব্লিৎজ দাবায় ২৭১২। গ্যারি কাসপারভের বয়স এখন ৬২। বিশ্বনাথন আনন্দের বয়স ৫৬। তাঁর নামের পাশে ভারতের পতাকা। র‍্যাপিডে এলো রেটিং ২৭২৭ আর ব্লিৎজে ২৭৩২। এসব নেহাৎ পরিসংখ্যান। ময়দান থেকে অবসর নেওয়া দুই ক্রীড়াবিদ, যাঁরা একসময় বিশ্ব শাসন করেছেন, তাঁদের ছায়া। বিশ শতকের শেষ দুই দশক আর একুশ শতকের প্রথম দেড় দশকে তাঁরা দাবাবিশ্বকে শাসন করেছেন। তাঁদের খেলা গেমগুলি এখন দাবাড়ুদের পাঠ্য। তাঁদের গেম বিশ্লেষণ ক’রে দাবা-ইঞ্জিনের অগ্রগতি ঘটেছে। দাবার আধুনিকতায় অবিচ্ছেদ্য সংযোজন তাঁদের নীতি, কৌশল এবং তত্ত্ব। আনন্দ এবং কাসপারভ একসঙ্গে আবার ক্রীড়াবিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, কারণ তিরিশ বছর পরে শুধু এই দু’জনকে নিয়েই আয়োজিত হয়েছে এক প্রতিযোগিতা। তাবড় দাবাড়ু আর সাংবাদিকেরা মুখিয়ে ছিলেন আরও একবার তাঁদের দ্বন্দ্ব দেখবেন বলে।

                                                              (১)
২০১৪ সালে কাসপারভ ক্রোয়েশিয়ার নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। রাশিয়া আর তাঁকে স্বীকৃতি দেয় না। অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই কাসপারভ বনাম রুশ সরকারের প্রতর্ক তৈরি হয়ে গেছে। পুতিনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সংঘাতে রাজপথে নেমেছেন। গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কারাবাসও করতে হয়েছে। কাসপারভ বলেছেন, অধুনা রাশিয়ায় তাঁর প্রাণসংশয়। কারাবাসের সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কারপভ। আনাতোলি কারপভ অবশ্য চিরকালই সোভিয়েত ও রাশিয়ার নয়নের মণি। ১৯৭৫ সালে সোভিয়েতের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করেছিলেন তিনি; ববি ফিশার খেলতে না আসায় ন্যায্য নিয়মে বিশ্বখেতাব দখল করেছিলেন তিনি। মিখাইল বটভিনিকের পরে কারপভ সোভিয়েতের আদর্শ ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কাসপারভ অবশ্য তা নয়। তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা ভাঙনমুখী সোভিয়েতের দ্বারা সম্ভব ছিল না। কাসপারভ সোভিয়েতের শেষলগ্নে বিশ্বদাবায় নতুন যুগের সূচনা করলেন। সোভিয়েত ভেঙে স্বতন্ত্র হলো রাশিয়া। ’৯০-র দশক। কাসপারভ তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কারপভকে দু’বার হারিয়ে বিশ্বখেতাব স্থায়ী ভাবে দখল করেছেন। বিশ্বের অন্য দাবাড়ুদের বিরুদ্ধে জিতেছেন। এলো রেটিং বাড়াতে বাড়াতে অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন। কাসপারভের সঙ্গে অন্য দাবাড়ুদের কয়েক যোজন দূরত্ব তখন। তার মধ্যেই ফিডের সঙ্গে মতান্তর। সমান্তরাল বিশ্বখেতাবী যুদ্ধও শুরু ক’রে দিলেন নতুন দাবাসংস্থার অধীনে। প্রফেশনাল চেস অ্যাসোসিয়েশন। আর, তাঁর স্বাধীনচেতা, স্পষ্টবাক্‌, হার না-মানা জেদের সঙ্গে সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে লাগল তৎকালীন রাশিয়ার রাজনীতির সঙ্গেও। কাসপারভ যখন খ্যাতির চূড়ায়, তখনই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে যুগান্তর ঘটল। আইবিএম নির্মিত ডিপ ব্লু বনাম কাসপারভের খেলা। আইবিএম কাসপারভকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেতে সর্বস্ব বাজি ধরল, কারণ, ডিপ ব্লু যদি কাসপারভকে হারাতে পারে, তাহলে মানবমেধার ওপরে কৃত্রিম মেধার জয় সূচিত হবে। কাসপারভ ১৯৯০-র দশকে মানবমেধার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, ক্রীড়াজগতের অন্যতম সেরা প্রতিনিধি। সম্প্রতি ‘রিম্যাচ (২০২৪)’ নামক ওয়েবসিরিজে এই গেমের রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব এবং ক্রীড়াকৌশল প্রায় নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

আরও পড়ুন

আগামী দশ বছরে বিশ্ব দাবার রাশ ভারতের হাতেই, নিশ্চিত!

কাসপারভের ওই তুঙ্গ মুহূর্তে আরেকটি দেশ দাবায় তাঁর হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করছিল। ভারত। ভারতে দাবার সূচনা- দাবা নিয়ে বহু মিথ, গল্পগাছা, এবং প্রাচীন ক্রীড়াব্যক্তিত্বের ইতিহাস ইত্যাদি রয়েছে। কিন্তু, দাবার আধুনিক ধরনেও ভারতীয় দাবাড়ুদের উপস্থিতি সেই ঊনিশ শতক থেকেই সমীহ জাগানো। ইউরোপিয়ান দাবাতাত্ত্বিকদের অনেকেই ‘ইন্ডিয়ান সিস্টেম’ ব্যূহসজ্জায় ভারতীয় দাবাড়ুদের প্রতি ঋণস্বীকার করেছেন। কিন্তু, বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো ক্রীড়াব্যক্তিত্ব ভারত পেল ১৯৯০-র দশকেই। বিশ্বনাথন আনন্দ। ক্যান্ডিডেটস দাবা জিতে আনন্দ মুখোমুখি হলেন কাসপারভের। ১৯৯৫। বিশ্বদাবায় এক ভারতীয়র প্রতিস্পর্ধী দানপর্যায় আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামহলে দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল।

                                                           (২)

আমি তখন সবে দাবার প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। দু-একটা প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছি। আনন্দ বনাম কাসপারভের দাবাযুদ্ধ ঘিরে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলা খবরের কাগজে সেই গেমের খবর আর দানগুলি ছাপা হচ্ছে। সেগুলো বোর্ডে খেলে খেলে দেখছি, বুঝছি না তেমন ভালো, কিন্তু দেখছি। ইংরাজি খবরের কাগজের পাতা থেকে খেলার বিশ্লেষণের অংশ কেটে কেটে রাখছে বাবা। শুনছি, ১৯৭২ সালে স্প্যাসকি বনাম ফিশার বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ের সময় নাকি এদেশে দাবাকে ঘিরে এমনই উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল। পরপর আটটা ম্যাচ ড্র। ইশ্‌, এত ড্র হচ্ছে কেন? ওই বয়সে কি ড্র দেখতে ভাল লাগে? নবম গেমে জিতলেন আনন্দ! আমি দারুণ খুশি। চারদিকে বলাবলি হচ্ছে, ভারত এবার বিশ্বখেতাব জিতবেই। কাসপারভের ‘ঔদ্ধত্য’ চূর্ণ হবে। শুনেছিলাম কাসপারভের নাকি খুব অহংকার। প্রতিপক্ষকে ধর্তব্যে আনেন না। বোর্ডে বসে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আনন্দের দিকে তাকান, যাতে আনন্দের মনোবল ভেঙে দেওয়া যায়। আরও কত কথা উড়ত এদেশের হাওয়ায়। পরের দু’টো গেমে হেরে গেলেন আনন্দ। পিছিয়ে পড়লেন। তবু আশায় আশায় ছিলুম। আনন্দ ঠিক ফিরে আসবেন। ড্র হলো আবার। তার পরের দু’টো গেমে কাসপারভ যখন আনন্দকে হারালেন, তখন মন বিষণ্ণ হয়ে গেছে। আর বোধহয় আশা নেই। না, না, কুড়ি গেমের লড়াই। শেষ তিনটে ম্যাচে কি জিতবেন না আনন্দ? আনন্দ হেরে গেছেন। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে বুঝেছি, কাসপারভ সেই সময় কেন অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। কেন ২০ গেমের লড়াই ১৮ গেমে শেষ হয়ে গেছিল আর, আনন্দ মাত্র একটা গেমে কাসপারভকে হারাতে পেরেছিলেন, আর, কাসপারভের বিরুদ্ধে খেতাবী লড়াইয়ে একটা জয়ই সেইসময় মহার্ঘ ছিল, সেসব পরে বুঝেছি।

প্রফেশনাল চেস অ্যাসোসিয়েশনের ক্যান্ডিডেটস দাবার সেমিফাইনাল ও ফাইনালে আনন্দ হারিয়েছিলেন মাইকেল অ্যাডামস এবং গাতা কামস্কিকে। ব্রিটিশ দাবা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় দাবার সেই সময়ের দুই সেরা প্রতিনিধি অ্যাডামস এবং কামস্কি। খেতাবী লড়াইয়ের নবম ম্যাচে, পরপর আটটা ম্যাচ ড্রয়ের পরে, আনন্দের জয় চিত্তাকর্ষক ছিল। সিসিলিয়ান প্রতিরক্ষার স্কেভেনিঞ্জেন শাখায় খেলেছিলেন কাসপারভ। ধ্রুপদী শাখা। সিসিলিয়ান প্রতিরক্ষার মূল বিষয় সময়জ্ঞান এবং আক্রমণ-প্রতিরক্ষার যথাযথ সামঞ্জস্য। আনন্দ কাসপারভকে ব্যূহ সাজিয়ে কুইনের দিকে পিস জড়ো করার সময় দেননি। তার আগেই আক্রমণ শানিয়েছিলেন কুইনের দিকে। ওপেনিং প্রস্তুতির দারুণ উদাহরণ। মিডল গেমের শেষলগ্নেই খেলা শেষ। পজিশনাল জিত। কাসপারভ পরের ম্যাচেই এই ‘অপমানের’ বদলা নিয়েছিলেন। রুই লোপেজ ওপেনিং। আনন্দের মরফি প্রতিরক্ষা, মাঝছক খুলে দিয়ে কুইনের আক্রমণে পন জিতে নেওয়া, কাজে আসেনি। কাসপারভ এন্ডগেমে পৌঁছেছিলেন বিশাল অ্যাডভান্টেজ নিয়ে। ২০ গেমের খেতাবী লড়াই ১৮তম গেমে জিতে নিয়েছিলেন ১০.৫-৭.৫ ব্যবধানে।

                                                             (৩)
এরপর গঙ্গা আর ভোলগা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। কাসপারভ বিশ্বখেতাবী মুকুট খুইয়েছিলেন স্বদেশীয় ভ্লাদিমির ক্রামনিকের কাছে। যদিও তাঁর রেটিং সেই সময় সকলের অধরাই ছিল, কিন্তু ক্রামনিকের অসাধারণ প্রস্তুতি আর ক্ষুরধার পরিকল্পনা কাসপারভের আধিপত্য খর্ব করেছিল। ২০০০ সালে বিশ্বখেতাব জিতলেন আনন্দ। ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কাসপারভের দর্প আরও একবার চূর্ণ হলো হাঙ্গেরির জুডিথ পোলগারের ক্রীড়াদক্ষতায়। নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করেছিলেন কাসপারভ- “দাবা একটা যুদ্ধ। আর, মেয়েরা যুদ্ধে ঠিক পারদর্শী না!” ২০০২ সালে পোলগার ক্রীড়াজগতে পুরুষ-নির্ধারিত বৈষম্যের প্রতর্ককে কিস্তিমাত করেন কাসপারভকে হারিয়ে। ২০০৫- আন্তর্জাতিক দাবা থেকে অবসর নিলেন কাসপারভ। আর, ২০০৭ সালে ফের বিশ্বখেতাব জিতলেন আনন্দ। পেছনে ফেললেন ক্রামনিক, পিটার লেকো, পিটার স্বিডলার, বরিস গেলফাঁ, আলেক্সান্দার মরোজেভিচ, লেভন অ্যারোনিয়ান, আলেক্সান্দার গ্রিসচুকদের। ১৯৮৫-২০০৫ দাবায় কাসপারভ জমানা। আর, ২০০৬-২০১৩ আট বছর বিশ্বনাথন আনন্দের একাধিপত্য। বিশ্বখেতাব জেতা, বিশ্বখেতাব রক্ষা করা এবং পরবর্তী প্রজন্মের দাবাড়ুদের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া- আনন্দ ভারতীয় ক্রীড়াকে আন্তর্জাতিক পরিসরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা দিলেন। এরপর ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হলো ম্যাগনাস কার্লসেন যুগ। আনন্দকে পরপর দু’টো বিশ্বখেতাবী লড়াইতে হারিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন কার্লসেন। কাসপারভের এলো-রেটিং ছাপিয়ে নতুন রেকর্ড গড়লেন। ক্লাসিক্যাল, র‍্যাপিড আর ব্লিৎজের সঙ্গে সঙ্গে বুলেট দাবার অত্যাধুনিক ধরনেও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন। সে অবশ্য অন্য কাহিনি। কিন্তু, কার্লসেন যুগ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ আর কাসপারভ ‘আগের প্রজন্মের’ হয়ে গেলেন। আনন্দ অবশ্য ২০১৭ সালে র‍্যাপিড দাবায় বিশ্বখেতাব জিতেছেন। ২০২১ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সর্বোচ্চ স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। কাসপারভ আর মূলধারার দাবা প্রতিযোগিতায় ফেরেননি। সম্প্রতি আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। কিন্তু, নিয়মিত প্রতিযোগিতায় অংশ নেননি। বরং তাঁর রাজনৈতিক জীবন আর প্রশিক্ষকের পেশাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশ্বনাথন আনন্দ ভারতীয় দাবাকে বিশ্বের সেরা তিনের মধ্যে নিয়ে এসেছেন- তাঁর দেখানো পথে প্রশিক্ষণ পেয়ে আর অনুশীলন ক’রে গুকেশ, প্রজ্ঞানন্ধা, বৈশালী, দিব্যা, অর্জুন, নিহালরা সবচেয়ে শক্তিশালী তরুণ ক্রীড়াপ্রজন্ম হয়ে উঠেছে। স্বয়ং কাসপারভও স্বীকার করেছেন, “আনন্দের ছেলেপুলেরা এখন বিশ্বদাবা শাসনের জন্য তৈরি।”

আরও পড়ুন

নেশার খেলা থেকে স্নায়ুর যুদ্ধ, জীবনকে মাপছে দাবা

২০২৫ সালে ফের মুখোমুখি হলেন কাসপারভ আর আনন্দ, ঠিক যেমন ফিশার আর স্প্যাসকি হয়েছিলেন। সেই ব্যবধান ছিল ২০ বছরের। আর, এঁদের ব্যবধান তিরিশ বছরের। আরও একটা তফাৎ রয়েছে। স্প্যাসকি আর ফিশার দু’জনেই তৎকালীন বিশ্ব-রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, টালমাটাল উপেক্ষা ক’রে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ওই প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাঁদের দু’জনের কাছেই ছিল ১৯৭২ সালের খেতাবী যুদ্ধের ‘রিম্যাচ’। আনন্দ আর কাসপারভের ক্ষেত্রে অবশ্য তা নয়। প্রদর্শনী খেলা। এই গেমের ধরনও ভিন্ন। র‍্যাপিড এবং ব্লিৎজ দাবা। ধ্রুপদী ধরন না। মোট তিনদিনের লড়াই। প্রত্যেকদিন দু’টি র‍্যাপিড এবং দু’টি ব্লিৎজ। আর, সবচেয়ে উল্লেখযোহ্য ব্যাপার, প্রথাগত পিস-পন সজ্জায় না, খেলাগুলি হবে চেস-৯৬০ সজ্জায়। ফিশার এই বিশেষ ধরনটি উদ্ভাবন করেছিলেন। বিজ্ঞানের বিন্যাসপর্যায়ের সূত্র মেনে অসংখ্য এমন পজিশন হতে পারে, যেখানে সাদা ও কালোর পিসগুলি অসংখ্য ক্রমে বিন্যস্ত থাকতে পারে। পনগুলি অবশ্য একইভাবে সজ্জিত থাকবে। প্রথাগত পিস-পন বিন্যাসের দাবার বাইরে এই নির্দিষ্ট বিন্যাসহীন পিসবিন্যাসের গেম এখন বেশ জনপ্রিয়। এখানে দাবার প্রচলিত ওপেনিং তত্ত্ব কাজ করবে না, কারণ, পিস-পনের শুরুর অবস্থান আলাদা। কিন্তু, পজিশনের ধারনা, মিডলগেমের তত্ত্ব, নীতি-কৌশল এবং এন্ডগেমের তত্ত্ব কার্যকরী থাকবে। অর্থাৎ যোদ্ধাকে আঁচ ক’রে নিতে হবে নিজের পিস ও পনগুলির ব্যূহ কী রকম হতে পারে, কয়েক দান পরে তাদের অবস্থান কীভাবে সুবিধাজনক হতে পারে, এবং এন্ডগেমের সম্ভাব্য নীতি কী হতে পারে। ফিশার-র‍্যান্ডম দাবায় স্মৃতিতে থাকা পজিশন মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ; তত্ত্ব, দানপরম্পরা গণনা আর, যুক্তিগ্রাহ্য দূরদর্শিতাই প্রাধান্য পায়। আনন্দ-কাসপারভের প্রদর্শনী গেমের নাম ক্লাচ চেস। এ এক নতুন ধরনের প্রতিযোগিতা, যেখানে প্রতিটি রাউন্ডের সাথে অর্থমূল্য এবং পয়েন্টের পরিমাণ বাড়তে থাকে, ফলে প্রতিদিনের খেলায় উত্তেজনা বাড়ে। কোনো গেম জিতে একদিন এগিয়ে থাকা নিরাপদ থাকে না, কারণ পরের দিনের খেলায় পয়েন্টপ্রাপ্তি বদলে যাবে। শুরুতে পয়েন্ট হারালেও, প্রতিদ্বন্দ্বী ফিরে আসার সুযোগ পায়। প্রথম দিনে, প্রতিটি জয়ে বিজয়ী পাবে ১ পয়েন্ট ও ১,০০০ ডলার। দ্বিতীয় দিনে প্রতিটি জয়ে ২ পয়েন্ট ও ২,০০০ ডলার। তৃতীয় দিনে প্রতিটি জয়ে ৩ পয়েন্ট ও ৩,০০০ ডলার। আর, ড্র হলে অর্থমূল্য ভাগাভাগি হবে। অভিনব পদ্ধতি। দুই ‘প্রাক্তন’ শ্রেষ্ঠর লড়াইয়ের অভূতপূর্ব রণক্ষেত্র।

                                                             (৪)
প্রথম দিনের শেষে কাসপারভ ২.৫-১.৫ ব্যবধানে এগোলেন। দু’টি র‍্যাপিডই ড্র হলো। একটি ব্লিৎজ জিতলেন কাসপারভ, আরেকটি ড্র। দ্বিতীয় দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দুই দাবাড়ুর কাছে। কাসপারভ প্রায়-নিখুঁত নীতিতে ব্যবধান বাড়ালেন। একটি র‍্যাপিড আর একটি ব্লিৎজ জিতে ৮.৫-৩.৫ পয়েন্টে এগোলেন। তৃতীয় দিন প্রথম র‍্যাপিডে পয়েন্ট ভাগাভাগি হলো। পরের গেম জিতে কাসপারভ তিন পয়েন্ট পেলেন। ব্লিৎজে দু’টোই জিতলেন আনন্দ। ততক্ষণে অবশ্য বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ১৩-১১ ব্যবধানে শিরোপা জিতলেন কাসপারভ। বারোটি গেমের মধ্যে একটি গেম বিশেষভাবে উল্লেখ করার- তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় র‍্যাপিড গেম। এই গেম জিতেই কাসপারভ খেতাব নিশ্চিত করলেন। কাসপারভের সাদা। আনন্দের কালো।

আনন্দ এবং কাসপারভ দু’জনেই যে মরিয়া হয়ে উটেছিলেন গেমটা জিততে, সেটা দানপর্যায়ে খেয়াল করা যায়। সেই সেরা সময়ের কাসপারভ আর আনন্দের ঝলক দানে এবং পরিকল্পনায়। চেস-ইঞ্জিনের আধিপত্যের যুগে কম্পিউটারে গেম বিশ্লেষণ করা বা শ্রেষ্ঠ দান খুঁজে নেওয়া কঠিন না। কিন্তু, বোর্ডে বসে লড়াইয়ের উত্তেজনায় হতে হতে ইঞ্জিনসম দান খুঁজে পাওয়া সহজ না। কাসপারভ আর আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন। দাবা-ইঞ্জিনের বিশ্লেষণে নিখুঁত দান। বাইশ নম্বর দানে, খেলা যখন এন্ডগেমের দিকে গড়াচ্ছে, সেই রূপান্তরের মুহূর্তে কাসপারভ খুঁজে পেলেন Qe1! সাদার কুইনের অবস্থানগত সুবিধা স্পষ্ট হলো। যৎসামান্য অ্যাডভান্টেজ। কিন্তু বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞ নায়ক জানেন এরকম যৎসামান্য অ্যাডভান্টেজ থেকে কীভাবে জয়ের মুখ খুলে নিতে হয়। কুইন+বিশপ (সম বর্ণের বিশপ) এন্ডগেমের প্রাথমিক তত্ত্ব মোতাবেক সাদার পনগুলোকে কালো-রঙের ঘরে বসালেন, যাতে কালোর সাদা-ঘরের বিশপ পনগুলির ক্ষতি না অরতে পারে। কালোর পনগুলোকে আটকে দিলেন সাদা রঙের ঘরে, যাতে সহজে আক্রমণ করা যায়। শেষলগ্নে নিজের কুইনের সঙ্গে আনন্দের কুইনের বাধ্যতামূলক খাওয়াখাওয়ির অবস্থান তৈরি করলেন। আনন্দের কিং তখন মূল যুদ্ধক্ষেত্র তথা কাসপারভের অপ্রতিরোধ্য পনের থেকে অনেকটা দূরে। সমবর্ণের বিশপ এন্ডগেমের ব্যাকরণের নির্ভুল প্রয়োগ। পরের দু’টো ব্লিৎজ গেমে আনন্দ জয় পেলেন, কিন্তু খেতাব ততক্ষণে কাসপারভের মুঠোয়। ১০ই অক্টোবর। ১৯৯৫ সালের ১০ই অক্টোবর কাসপারভ অষ্টাদশ গেম ড্র ক’রে বিশ্বখেতাব দখলে রেখেছিলেন। ঠিক ত্রিশ বছর পরে আবারও খেতাব জিতলেন, এতকালের চেনা সেই ‘শত্রু’র বিরুদ্ধেই। নাঃ, গ্যারি কাসপারভ আর ওর’ম সর্বগ্রাসী চোখে ভয়ঙ্করভাবে প্রতিপক্ষের দিকে তাকান না। ম্যাচ জেতার পরে মারাত্মক অভিব্যক্তিতে ফেটে পড়েন না। তিনি এখন শান্ত থাকেন। ম্যাচ জেতার পরে বিবৃতি দেন, কিন্তু সংযত। প্রতিপক্ষকে ‘শত্রু’ জ্ঞানে যুদ্ধমহড়ার রেওয়াজ ভুলে যাননি বটে, তবে আগ্রাসী অহং অনেক শান্ত আর পরিণত হয়েছে। খেতাব জেতার পরে তাঁর পুরনো শ্লেষমিশ্রিত রসিকতাবোধ জেগে উঠেছিল অবশ্য- “আনন্দের মনে হয় মনস্তাত্ত্বিক অস্বস্তি রয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনন্দের গেমের ইতিহাস তো ভালো না, সেই ভূত ওঁকে প্রতি গেমেই তাড়া করেছে নিশ্চয়!” এমন রসিকতা, চিরপ্রতিপক্ষের প্রতি শ্লেষ তাঁকেই মানায়। তিনি বৃদ্ধ হলেন, তাঁর খেলায় অনেক ‘অনিখুঁত’ দান, পরিকল্পনার কিছু গলদ দাবা-ইঞ্জিন দেখিয়ে দেয়। এখনকার শীর্ষস্তরের দাবাড়ুরা ধারাভাষ্যের মাঝে মাঝে আলোচনা করেন। তাতে কী? প্রবাদ- কাসপারভের খেলা দেখতে ঈশ্বর এখনও আসেন। শিখে নেন প্রয়োজনীয় নীতি, যুদ্ধজয়ের কৌশল, পরিকল্পনা আর সাহসী সিদ্ধান্তের জেদ।

More Articles