কবিরাই কবিতার হন্তারক?
Sahitya Akademi cancels Kolkata event: শ্রীজাত এবং জাভেদ আখতারকে নিয়ে ঘটে যাওয়া দু-টি ঘটনাতেই যেটি সবচেয়ে আশঙ্কার তা হলো এই দুই ক্ষেত্রেই অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিত করেছে দু-টি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ উঠেছে যে, হিন্দু মৌলবাদী নেটিজেনদের চাপে সাহিত্য অকাদেমি একটি কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানকে বাতিল করেছে। যদিও সাহিত্য অকাদেমি এই অনুষ্ঠানটি বাতিল করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখায়নি। এ-সমস্ত ক্ষেত্রে অকাদেমি যা করে থাকে, তাই করেছে। জানিয়েছে যে, অনিবার্য কারণবশত অনুষ্ঠানটি বাতিল করা হয়েছে।
কিন্তু, অনুষ্ঠানটি বাতিল হওয়ার পরে ফেসবুকে হিন্দু মৌলবাদীদের উল্লাস থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, আসলে কারণটি হলো অনুষ্ঠানটির প্রেক্ষিতে অকাদেমির উপরে তাদের তৈরি করা চাপ। কীসের চাপ? এই অনুষ্ঠানে কবিতাপাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল শ্রীজাতকে। মৌলবাদী নেটিজেনরা অনুষ্ঠানে শ্রীজাতকে আমন্ত্রণ জানানোর বিরুদ্ধে টানা প্রতিবাদ করতেই থাকেন। কেন? ২০১৭ সালে তিনি একটি কবিতা লিখেছিলেন যার নাম ‘অভিশাপ’। যোগীরাজ্যে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে লেখা এই কবিতায় শ্রীজাত এমন একটি ইমেজ ব্যবহার করেছিলেন, যে-ইমেজটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিকে আঘাত করেছিল বলে সেই তখনই তাঁরা থানায় এফআইআরও করেছিলেন। সেই কবিতার প্রসঙ্গ তুলেই এখন প্রতিবাদ করছিলেন তারা। সাহিত্য অকাদেমি যতই কারণ না-দর্শাক, বোঝাই যাচ্ছে যে, এই প্রতিবাদের কাছেই মাথা নত করেছে সাহিত্য অকাদেমি।
সাহিত্য অকাদেমির নানা কাজকর্ম নিয়ে কিন্তু এ-বাংলায় নিকট অতীতে প্রতিবাদ হয়েছে বিস্তর। গতবছর তো সাহিত্য অকাদেমি বাংলা সাহিত্যের জন্য পুরস্কারটিই প্রদান করেনি! অভিযোগ উঠেছে যে, এমনকি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ না জানিয়ে বছরের পর বছর অকাদেমির অনুষ্ঠানগুলিতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা পরিচালক মণ্ডলীর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কবি, ঔপন্যাসিককেই। কিছুদিন আগেই পাটনাতে হয়ে যাওয়া ‘উন্মেষা’ অনুষ্ঠানটি সম্পর্কেও একই অভিযোগ উঠেছে। সাহিত্যজগত থেকেই অভিযোগ উঠেছে যে, বিভিন্ন কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার জন্যও এক-দু-জন কবি ছাড়া আর কোনো কবিকে সাহিত্য অকাদেমিকে খুঁজে পাচ্ছে না। বিগত কয়েক বছরে সাহিত্য অকাদেমির অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রগুলির দিকে নজর রাখলেই বোঝা যায়, অভিযোগগুলি নেহাতই সারবত্তাহীন নয়। শুধু অভিযোগই নয়। সাহিত্য অকাদেমির এই সমস্ত কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবাদও হয়েছে। অথচ এই ধরনের স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠলেও সাহিত্য অকাদেমি তাদের সিদ্ধান্তে থেকেছে অনড়। একই কাজ এই প্রতিষ্ঠানটি করে চলেছে নানা অনুষ্ঠানে। অর্থাৎ সাহিত্যিকদের অভিযোগের কোনো গুরুত্বই সাহিত্য অকাদেমির কাছে নেই। কিন্তু গুরুত্ব রয়েছে মৌলবাদী চাপের। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে?
আরও পড়ুন
সংখ্যার রাজনীতিতে জাভেদ আখতাররাই চিরশত্রু
কিছুদিন আগেই প্রায় একই ধরনের আর একটি ঘটনাও ঘটে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। আরেকটি সরকারি অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে গেছে। মুসলিম মৌলবাদীদের চাপের কাছে মাথানত করে একইভাবে জাভেদ আখতারকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য একটি আলোচনার সভা স্থগিত করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উর্দু আকাদেমি। এ-রাজ্য অতীতে সাক্ষী থেকেছে ধর্মীয় অনুভূতি আহত হচ্ছে– এই দোহাই দিয়ে বই নিষিদ্ধ করার, একজন লেখিকাকে এ-রাজ্য থেকে বিতারণের। কিন্তু, অল্প সময়ের মধ্যে পরপর অনুষ্ঠান বন্ধ করার এই যে-একটি ধারা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তা অবশ্যই নতুন। এক সময় মনে করা হত পশ্চিমবঙ্গ মুক্তচিন্তার আঁতুর ঘর। অনেক সম্মানই যেমন আমরা গত কয়েক বছরে খুইয়েছি, তেমন এই সম্মানটুকুও আজ হৃত হওয়ার মুখে। এমনটা হলো কেন? যে-রাজ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পরেও সেভাবে কোনো দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টিই হয়নি, সেই রাজ্যে দুই ধর্মের মৌলবাদীদের এতখানি দাপট আজ তৈরি হলো কীভাবে? নিঃসন্দেহে এর জন্য দায়ী এ রাজ্যের শাসক ও প্রধান বিরোধী দল। দু-টি দলই কেবলমাত্র নির্বাচনী বৈতরণী উতরে যাওয়ার লক্ষ্যে বেশরম ঔদ্ধত্যে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে চলেছে ধর্মীয় তাসটিকে। স্বীকার করা দরকার যে, এই ক্ষেত্রে যতখানি নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল বাম দলগুলির, অনেকসময়ই সেই ভূমিকা তারাও পালন করতে পারেনি। মৌলবাদী চাপের বিষফলটি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে জন্ম নেওয়া তাই সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র।
শ্রীজাতর যে-কবিতাটি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে সেই কবিতাটি সম্পর্কেও দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন। যোগীরাজ্যে কবর খুঁড়ে তুলে আনা একটি মৃতদেহকে ধর্ষণের প্রেক্ষিতে লেখা এ-কবিতা। ওই কবিতাটি নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে গেলে অবশ্যই মনে রাখা উচিত এই কবিতাজন্মের প্রেক্ষিতটিকেও, তার বীভৎসতাটিকেও। এই কবিতায় শ্রীজাত লিখেছিলেন,
“আমাকে ধর্ষণ করবে যদ্দিন কবর থেকে তুলে –/কন্ডোম পরানো থাকবে, তোমার ওই ধর্মের ত্রিশূলে!”
নিজে যেহেতু সামান্য কবিতা রচনার প্রয়াস করে থাকি, তাই এটুকু বলা যায় যে, আমি এই কবিতা লিখলে হয়ত এখানে ত্রিশূলে কনডোম পরানোর ইমেজটি ব্যবহার করতাম না। কিন্তু একটি কবিতার যখন জন্ম হয়, তখন প্রতিটি শব্দ লেখার সময় কবি কি সম্পূর্ণভাবে স্বনিয়ন্ত্রণে থাকেন? কবিতা রচনা একটি ঐশী প্রক্রিয়া। অনেক সময় কবিতাটির কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করা ছাড়া একজন কবইর আর অন্য কোনো উপায়ই থাকে না। কবিতা রচনার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণভাবে কবির নিয়ন্ত্রণাধীন এমনটি ভাবলে ভুল ভাবা হবে। এবং খুব নিরপেক্ষভাবে যদি বলতে হয় তাহলে মানতেই হয় যে-বীভৎস ঘটনার প্রেক্ষিতে এই কবিতাটি লিখেছিলেন শ্রীজাত, সেই বীভৎসতার উলটোদিকে তাঁর প্রতিবাদকে রাখতে গিয়ে তিনি আর একটি চরমপন্থা গ্রহণ করেছেন। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস খুঁজলে এই ধরনের চরমপন্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হওয়া কবিতা বা গল্পের সংখ্যা নেহাত কম হবে না। পাঠক হিসেবে তাই শ্রীজাতর ওই কবিতাটিকে একটি মহৎ কবিতা না বললেও, অবশ্যই একটি জরুরি কবিতা হিসেবে আমি চিহ্নিত করব। জানি, অনেকেই এই প্রেক্ষিতে বলবেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে এ-রাজ্যে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনায় হিরন্ময় নীরবতা অবলম্বন করেছেন শ্রীজাত। ঠিক। নীরবতা অবলম্বনের মধ্যেও যদি একটি প্যাটার্ন লক্ষ করা যায় তা অবশ্যই প্রতিবাদযোগ্য ও আপত্তিজনক। কিন্তু সেই কারণেও তো ২০২৫ সালে একটি কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রতিবাদ ২০১৭ সালে লেখা একটি কবিতার জন্য করা যায় না।
আরও পড়ুন
জাভেদ আখতারের আমন্ত্রণ বাতিল: উদারপন্থীদের নীরবতায় মৌলবাদের উত্থান
শ্রীজাত এবং জাভেদ আখতারকে নিয়ে ঘটে যাওয়া দু-টি ঘটনাতেই যেটি সবচেয়ে আশঙ্কার তা হলো এই দুই ক্ষেত্রেই অনুষ্ঠান বাতিল বা স্থগিত করেছে দু-টি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান। সরকার এ-কাজ করলে তার এক অর্থ হয়। চরিত্রগতভাবেই রাষ্ট্র একটি নিষ্পেষণের যন্ত্র। কিন্তু একটি সাহিত্য প্রতিষ্ঠান মৌলবাদী চাপের কাছে মাথা নত করলে মুক্তচিন্তার মানুষদের দাঁড়াবার আর কোনো ঠাঁই থাকে না সে-সমাজে। দুঃখের এটাই যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলির মাথায় যাঁরা বসে আছেন তাঁরা সকলেই কবি, গদ্যসাহিত্যিক, নাটককার। এঁরা কোথায় একজন কবির পক্ষে দাঁড়াবেন মৌলবাদী শক্তির বিপ্রতীপে, তা নয় এঁরাই মৌলবাদী শক্তির হাত শক্ত করছেন এভাবে অন্যায় চাপের কাছে মাথা নত করে! পাঞ্জাবি ভাষার কবি সুরজিৎ পাতর একটি কবিতায় লিখেছিলেন,
“যে-সমস্ত বিচারকেরা ন্যায়বিচারকে হত্যা করে/তাদের সম্বন্ধে আমি অনেক শুনেছি/আমি ধর্মের রক্ষাকর্তাদের সম্বন্ধেও শুনেছি/যারা নিজেরাই ধর্মের পবিত্র আত্মাটিকে হত্যা করে/এইটাই আমি আগেই শুনিনি/এখন এটাও শুনে নিলাম/আমাদের সময়ে ভয়ে কাঁপতে থাকা কবিরাও/কবিতার হন্তারক হয়ে গেছে।”
এর চেয়ে বড়ো সত্য কথা এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য জগত আর আকাদেমিগুলি সম্পর্কে আর হয় না।
(লেখকের মতামত ব্যাক্তিগত)

Whatsapp
