কাতারের ট্যাক্সিচালক থেকে আইএসআই এজেন্ট! কীভাবে পাক গুপ্তচরকে ধরল ভারত?

Pakistani Spy: ২০২৪ সালের জুন মাসে এক মাসের জন্য ট্রাক্সি চালক আনসারি পাকিস্তানে যান। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ভারতে সিএএ-এনরসি বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করে তাঁকে উগ্রপন্থী করে তোলা হয়।

তখনও পহেলগাঁও হামলা ঘটেনি। এমনকী ঘটার কোনও আশঙ্কাও দেখা দেয়নি। তবে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনা তো চলছিলই। সম্প্রতি জানা গিয়েছে জ্যোতি মালহোত্রা নামে একজন ভারতীয় ইউটিউবার পাকিস্তানকে ভারতের সংবেদনশীল তথ্য পাচার করছিলেন। তিনি কাশ্মীর হামলার আগে পহেলগাঁও-ও গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ জ্যোতির একার বিরুদ্ধে নেই। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দেখা যাচ্ছে, ভারতে বহু সংখ্যক পাক গুপ্তচর কাজ করে চলেছেন। এমনই দুই গুপ্তচর হাতে এসেছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের। তিন মাস ধরে গোপনে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআই-এর সঙ্গে যুক্ত একটি উচ্চস্তরের গুপ্তচর চক্রকে ভেঙে দিয়েছে বলে দাবি। এই গুপ্তচর চক্র সম্ভবত দিল্লিতে বড় কোনও সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অংশ ছিল। আপাতত সেই চক্রের দুইজন গ্রেফতার হয়েছে। প্রথমজন, আনসারুল মিয়া আনসারি। তিনি পাকিস্তানি গুপ্তচর। আর গ্রেফতার হয়েছেন আখলাক আজম। ভারতে এই গুপ্তচরদের নানা কাজের, ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। অভিযোগ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর গোপন নথিপত্র হাতানোই ছিল এই গুপ্তচরের কাজ।

ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহের জন্য দিল্লিতে একজন গুপ্তচর পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে পাকিস্তানের আইএসআই। এই তথ্যটি হাতে আসে ভারতের গোয়েন্দাদের। এই তথ্যের সূত্র ধরে এগোতেই গোয়েন্দারা জানতে পারেন, দিল্লিতে আক্রমণ চালানোর জন্য আইএসআই নানাবিধ তথ্যের সন্ধান করছে। পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল পালাম বিমান বাহিনী ঘাঁটি, সিজিও কমপ্লেক্স এবং আর্মি ক্যান্টনমেন্ট, দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে হামলা চালানোর।

আরও পড়ুন- পাকিস্তানের গুপ্তচর! কে এই ভারতীয় ট্রাভেল ভ্লগার জ্যোতি মালহোত্রা?

ভারতীয় গোয়েন্দা দলও বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে ফাঁদ পাতে। আনসারি তখন নেপালে। গত ফেব্রুয়ারিতে নেপাল হয়ে পাকিস্তানে ফেরার পথে দিল্লিতে গ্রেফতার করা হয় আনসারিকে। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অধীনে মামলা দায়ের করা হয়। মে মাসে চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে। আনসারিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, এই গোটা পরিকল্পনার নেপথ্যে পাকিস্তানি হাই কমিশনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা উঠে এসেছে। মোবাইল ফোনে অভিযুক্ত আনসারি এবং পাকিস্তানে তাঁকে নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের মধ্যে অপরাধমূলক কথোপকথনও পাওয়া গেছে বলে জানান গোয়েন্দারা।

এরপর গত মার্চ মাসে একটি অভিযানে আখলাক আজমকে গ্রেফতার করা হয়। আখলাক নিজে গুপ্তচর নন। ভারতে নিযুক্ত গুপ্তচরদের সহায়তায় আখলাক আজমের ভূমিকা উঠে এসেছে। জানা যায়, আনসারি ২০২৪ সালের জুনে পাকিস্তানে যান। এক মাস সেখানে ছিলেন, বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেন। এই সময়েই আইএসআই-এ তাঁর নিয়োগকারী কর্মকর্তার সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ হয়। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সংবেদনশীল তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয় আনসারুল মিয়া আনসারিকে। আর তাঁকে সহায়তার জন্য নিয়োগ করা হয় আখলাক আজমকে।

তদন্তে জানা যাচ্ছে, দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মীদের অনেকের সন্দেহজনক যোগাযোগের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আইএসআই কর্মকর্তা মুজাম্মিল এবং এহসান-উর-রহিম ওরফে দানিশ গুপ্তচরবৃত্তির উদ্দেশ্যে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। সম্প্রতি হরিয়ানার হিসারের ইউটিউবার তথা পাকিস্তানের গুপ্তচর জ্যোতি মালহোত্রার সঙ্গে দানিশের যোগাযোগ প্রকাশ্যে এসেছে।

গত জানুয়ারিতে, ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে খবর আসে যে আইএসআই এজেন্ট হয়ে একজন নেপাল হয়ে দিল্লিতে ঢুকতে চলেছে গোপন সামরিক নথি সংগ্রহের জন্য। পালাম বিমান বাহিনী ঘাঁটি, সিজিও কমপ্লেক্স এবং দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষাস্থান লক্ষ্য করে আসন্ন আক্রমণ পরিকল্পনা নিশ্চিত করার পর, গোয়েন্দা সংস্থা ফাঁদ পাতে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় আনসারিকে সংবেদনশীল নথিপত্রসহ গ্রেফতার করা হয়।

আরও পড়ুন- সন্ত্রাসের সুতো আইএসআই-এর হাতে! পাক জঙ্গিদের কীভাবে মদত জোগায় গুপ্তচর সংস্থা?

পরবর্তী তদন্তে জানা যায়, আখলাক আজমের কীভাবে সহযোগিতা করতেন আনসারিকে। আনসারির গুপ্তচরবৃত্তিতে আসার পথটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আনসারি স্বীকার করেছেন, ২০০৮ সাল থেকে কাতারে ট্যাক্সিচালক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। সেখানেও একজন আইএসআই হ্যান্ডলারই তাঁকে নিয়োগ করেছিল। ২০২৪ সালের জুন মাসে যখন এক মাসের জন্য আনসারি পাকিস্তানে যান, সেখানে তাঁকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ভারতে সিএএ-এনরসি বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করে তাঁকে উগ্রপন্থী করে তোলা হয়। চলতে থাকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষণ। সেখানেই নেপাল হয়ে দিল্লিতে ঢুকে সামরিক গোপন নথি সংগ্রহ এবং সেগুলি ISI-এর কাছে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আনসারিকে। আনসারির দায়িত্ব ছিল চুরি করা নথিগুলির একটি সিডি তৈরি করা যাতে নিরাপদে তা পাঠানো যায়।

বর্তমানে তিহার জেলের উচ্চ-নিরাপত্তা শাখায় বন্দি আছেন আনসারি ও আখলাক। অন্যান্য বন্দিদের যাতে এঁরা কোনওভাবেই প্রভাবিত না করতে পারেন সেই দিকে কড়া নজর রাখছেন জেলকর্তারা।

More Articles