কয়েক সপ্তাহেই একাধিক বোমা তৈরি! পারমাণবিক শক্তিতে আসলে কতটা দক্ষ ইরান?

Iran's Nuclear Power: IAEA-এর অনুমান, ইরান ২০ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম (যেখানে হিরোশিমাতে ফেলা ‘লিটল বয়ের’ ক্ষমতা ছিল ১৩-১৬ কিলোটন)

ইজরায়েলের আগ্রাসনে গাজা প্রায় মাটিতে মিশে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কারও তাতে রা নেই, একমাত্র ইরান ছাড়া। এদিকে ট্রাম্প মসনদে বসার পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীল নকশা। নিউক্লিয়ার চুক্তি নিয়ে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। ইতিমধ্যে তারা ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে।
২০১৫ সালে ট্রাম্প প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি (‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’, JCPOA) ছিন্ন করেন। সেই থেকে ইরান সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আর আলোচনায় বসবে না। পরবর্তীতে, ২০২১ সালে বাইডেনের সময় ভিয়েনাতে কয়েক দফা আলোচনা পরোক্ষভাবে হলেও কোনও মীমাংসা হয়নি। এর মধ্যে ইরান ব্যাপকভাবে তার পারমাণবিক কর্মসূচি চালায়।

সপ্তাহ দুয়েক আগে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, "আমরা ইরানকে পারমাণবিক বোমা রাখতে দিতে পারি না"। সাম্প্রতিক সময়ে ইজরায়েল ইস্যুতে ইরান ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে পড়েছে। পড়শি দেশ, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় ইরান আসাদ সরকারের পক্ষে ছিল, কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর পতনের পরে তেহরান কোণঠাসা হয়ে পড়ে; তাদের অর্থনীতিও এখন মারাত্মক সংকটে। এমতাবস্থায় ট্রাম্প আলোচনার প্রস্তাব দেন। পরিস্থিতির চাপে, ইরান আমেরিকার সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজি হয়।

সত্তরের দশকের শুরুতে ইরান পারমাণবিক অপ্রসার চুক্তিতে (Non-Proliferation Treaty, NPT) সই করে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক শক্তিকে শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইরানের বিপ্লবের পর আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) এবং ইরান একসঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে পাশ্চাত্যের দেশগুলো দাবি করে আসছে যে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র তাদের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন- পারমাণবিক শক্তি মানেই পারমাণবিক বোমা নয়: আজীবন বলতেন বিজ্ঞানী বিকাশ সিনহা

২০১১ সালের নভেম্বরে সংস্থাটি দাবি করে যে, ইরান একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার প্রায় এক দশক পরে ২০২২ সালে IAEA, ইরান পারমাণবিক উপকরণ নিয়ে কী করছে তা খুঁজে বার করার জন্য তদন্ত শুরু করে। যদিও প্রতিবারই ইরান দাবি করে এসেছে যে, শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের জন্য তারা তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু পাশ্চাত্য বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই স্বীকারোক্তি পছন্দ হয়নি। তাদের বক্তব্য, যে দেশের ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার এত সমৃদ্ধ, তাদের নিশ্চয়ই কোনও অভিসন্ধি আছে। অন্যদিকে, ইরানের ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াকরণের গল্পটিও দীর্ঘ এবং জটিল।

প্রকৃতিগতভাবে ইউরেনিয়ামের যে আইসোটোপ (U235) শৃঙ্খলিত পারমাণবিক বিভাজন বিক্রিয়ার (Controlled nuclear fission reaction) জন্য প্রয়োজন হয়, তা প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ইউরেনিয়ামের মাত্র ০.৭ শতাংশ, আর বাকি ৯৯.৩% U238, ইউরেনিয়ামের অন্য আইসোটোপ। পারমাণবিক চুল্লিতে U235-এর পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ব্যবহারের আগে আরও বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ (Uranium Enrichment) করা হয়। পারমাণবিক চুল্লিতে ব্যবহারের জন্য সাধারণত লো-এনরিচড ইউরেনিয়াম (LEU) ও হাই-অ্যাসে লো-এনরিচড ইউরেনিয়াম (HLEU) ব্যবহার করা হয়; এদের মধ্যে HLEU-এ সর্বোচ্চ ২০% পর্যন্ত U235 সমৃদ্ধ জ্বালানি থাকে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে এই সমৃদ্ধির পরিমাণ ৯০% এর বেশি হওয়া দরকার।

পারমাণবিক জ্বালানিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য সেন্ট্রিফিউজের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী। পারমাণবিক চুল্লিতে ইউরেনিয়াম ভর্তি পাত্রগুলি প্রতি মিনিটে পঞ্চাশ হাজার বার ঘুরতে থাকে, সেজন্য অপকেন্দ্র বলের দরুণ U238 পাত্রের পরিধির দিকে সরে যায়। এর জন্য অবশ্য U238-এর ঘনত্ব দায়ী (U235-এর তুলনায় বেশি ঘন)। ইউরেনিয়ামকে প্রথমে এই ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লোরাইড (UF6) গ্যাসে রূপান্তরিত করা হয়, তারপরে সেন্ট্রিফিউজের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বারবার এই প্রক্রিয়া চালানোর ফলে U235 আরও বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হয়।

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের এই প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করা হয় এবং প্রতিটির সঙ্গে প্রতিটি যোগ করা থাকে; অনেকটা যেন একটার আউটপুট আর একটার ইনপুটে ঢুকছে। প্রতিটি পর্যায়েই আরও সমৃদ্ধ UF6 পরবর্তী পর্যায়ে স্থানান্তরিত করা হয়, আর অবশিষ্টাংশ দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রতিটি সেন্ট্রিফিউজের সমৃদ্ধকরণের মাত্রা পরিমাপের জন্য সেপারেটিভ ওয়ারক ইউনিট (SWU) নামক একক ব্যবহৃত হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম থেকে ১ কেজি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপযুক্ত ইউরেনিয়াম উৎপাদনের জন্য প্রায় ২৫০ SWU ইউনিটের প্রয়োজন হতে পারে।

২০০৬ সালে, ইরান 164 IR-1 সেন্ট্রিফিউজ (প্রতিটির বাৎসরিক ক্ষমতা প্রায় ০.৮ SWU) ব্যবহার করে প্রায় ৩.৫% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। আবার ২০১০ সালে, IAEA দাবি করে যে নাটানজ ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্লান্টে ইরান IR-1 সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করে ১৯.৭৫% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরি করেছে এবং ২০১৩ সালের মধ্যে দেশটি ৩.৫% মাত্রার LEU প্রায় ৭.৬ টন এবং ১৯.৭৫% মাত্রার ০.২ টন LEU গ্যাস মজুদ করে ফেলেছে।

২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির সময় তেহরানকে বেশিরভাগ সেন্ট্রিফিউজ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছিল, বিনিময়ে তাদের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি ইরান ৩.৬৭% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করতে পারবে, এবং সর্বাধিক ৩০০ কেজি LEU মজুদ করতে পারবে। ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে আসার আগে পর্যন্ত ইরান সমস্ত শর্তই মেনে চলছিল, কিন্তু মার্কিন সরকার চুক্তি থেকে সরে আসায় তারা পারমাণবিক কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়, এমনকী কয়েক বছরের মধ্যে তারা তাদের পারমাণবিক চুল্লিগুলোতে ৬০% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রস্তুত করে ফেলে। এখানেই শুরু হয় মূল আতঙ্ক।

আরও পড়ুন- নেতানিয়াহু ট্রাম্পের নাগালের বাইরে! প্রমাণ ইরান আক্রমণ

আগেই আমরা জেনেছি, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ৯০% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক, কিন্তু ৬০% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করেও এই কাজ করা সম্ভব। আর IAEA অনুমান করছে তেহরানের কাছে প্রায় ৭০ কেজি পরিমাণ ৬০% HEU রয়েছে, যা থেকে পাঁচ থেকে আটটি পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব!

IAEA-এর অনুমান, ইরান ২০ কিলোটন ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম (যেখানে হিরোশিমাতে ফেলা ‘লিটল বয়ের’ ক্ষমতা ছিল ১৩-১৬ কিলোটন); তাদের আরও দাবি, ইরান শক্তিশালী অথচ হালকা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ক্রমশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে।

২০১৫ সালে ইরান যখন পারমাণবিক চুক্তিতে সাক্ষর করে, তখন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপযোগী এক কেজি U235 প্রস্তুত করতে ইরানের সময় লাগত এক বছর, সেখানে বর্তমানে লাগে এক সপ্তাহ!

পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি কেবল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ওপরে নির্ভর করে না, এর পাশাপাশি বিস্ফোরক, ডেটোনেটর, অস্ত্র এবং ফায়ারিং সিস্টেম, উচ্চ শক্তি সম্পন্ন নিউট্রন, বিস্ফোরক লেন্সের প্রয়োজন পড়ে। পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণেরও (যেমন আমাদের পোখরানে হয়েছিল) দরকার হয়— এককথায় এক লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুসারে, সমৃদ্ধকরণের পাশাপাশি নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকটিও ইরান দক্ষতার সঙ্গে সামলে নিয়েছে এতদিনে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে কাঁচামাল থেকে হামলা করার মতো পারমাণবিক বোমা বানাতে তেহরানের সময় লাগবে সপ্তাহ তিনেক!

এখন পর্যন্ত ইরান সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। কিন্তু তার কাছে যে এই অধিক পরিমাণে HEU মজুদ রয়েছে, বা তাদের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ যে এত শক্তিশালী, সেজন্যই ইজরায়েল এতখানি চিন্তিত। সেই আশঙ্কা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে পাশ্চাত্যে, বিশেষ করে ট্রাম্পের দিকে। সেজন্য তেল আবিবের বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রীতিমতো হুমকি দিচ্ছেন ইরানকে— “কূটনৈতিক পথে যদি সমস্যার সমাধান না হয়, যদি সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন হয় তাহলে আমরা সেই পথে হাঁটব।"

More Articles