জার্নালিজম পড়ে বিয়েবাড়ির ক্যামেরাম্যান!

Wedding Photography: আমাদের না লিখতে পারা কলম আজ কালিকাপুরের কনে আর যাদবপুরের বরের গপ্পে বাইলাইন পায়।

আমরা যারা ক্লাস সিক্সে গৌতম ভট্টাচার্য, দেবাশীষ দত্তকে পড়ে সাংবাদিক হতে চাইলাম, চাইলাম লাহোরের প্রেসবক্সে থেকে উঁকি মেরে ইমরান খান আর ক্রিজের সচিন-কাইফকে কভার করতে, তাদের কেউ কেউ স্বপ্নভঙ্গের ভেলায় চেপে আজ বিয়েবাড়ির ক্যামেরাম্যান! বছরের শুরুতে লাল পঞ্জিকা হাতড়াচ্ছি, ধর্মতলার ক্যামেরা গলি থেকে একবুক আশা নিয়ে বেরোচ্ছি ধানবাদের বিয়েবাড়ি কভার করব বলে।

আমাদের কেউ কেউ বরখা দত্তকে দেখে ভেবেছিল কার্গিল যাবে, সুমনকে দেখে আঙুলটা উঁচিয়ে কেউ দিয়েছিল তার প্রথম স্মার্টফোনের ওয়ালপেপার। দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি আমাদের শিহরিত করেছিল! শেখর গুপ্তার 'ওয়াক দ্য টক', জয়ন্ত ঘোষালের 'দিল্লি থেকে বলছি' দেখতে আর পড়তে গিয়ে যাদের স্বপ্ন রাইটার্সের অলিন্দ থেকে ইমরান খানের ব্যালকনি পর্যন্ত অবাধে যাতায়াত করত, তাদেরকেই একদিন কলেজের পঁয়ত্রিশ নম্বর ঘরে প্রফেসরের মুখ থেকে শুনতে হলো, "জার্নালিজম পড়ে বিয়েবাড়িতে মানুষকে হাসতে বলিস? লজ্জা করে না?"

বিয়েবাড়িতে রাত জাগা ক্যামেরা, লাইট, ঠান্ডা খাসির মাংস জাগিয়ে রাখল এই মফসসলের ছেলেদের। পরদিন ক্লাসে গিয়ে প্রফেসর বললেন, "এটা ঘুমোনোর জায়গা? বিয়েবাড়িতে গিয়ে ঘুমাও।"

নভেম্বরের ১৭ তারিখ এলেই আমাদের উপস্থিতির হার কমে গেল ক্লাসে। গায়ে হলুদ শেষ করে সেমিস্টারের পরীক্ষা, সেই পরীক্ষার পর রুদ্ধশ্বাসে পেরোলাম বিটিরোড, বেলঘড়িয়ার ফিডার রাস্তা। টুজি স্মার্টফোনে হিস্ট্রি অফ জার্নালিজম পড়তে পড়তে আগুনে পড়ল খই, একটার পর একটা কুসুমডিঙা পেরনোর লাল-সবুজ ছবি রেকর্ড করতে গিয়ে আমরা একটু একটু করে ভুলে গেলাম মাস্টার ব্লাস্টারের শারজায় মরুঝড়, ব্রায়ান লারার চারশো, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষ ব্রিগেড, স্টেফি গ্রাফ-আন্দ্রে আগাসিকে। চিরতরে মৃত্যু হলো উইম্বলডন নামের একটা স্বপ্নের!

আরও পড়ুন- কনসার্ট থেকে বিয়েবাড়ি- নেই সেই আবাহন, হারিয়েই যাবে বিসমিল্লার ‘পাগলা’ সানাই?

এজেসি বোস রোডে গণশক্তি, পোদ্দার কোর্টে চব্বিশ ঘণ্টা, চাঁদনী চকে আনন্দবাজার-প্রতিদিন ঘুড়ে বেরিয়েছি। বায়োডাটার পর বায়োডাটা জমেছে, সদ্য শেখা অ্যাডোবিতে নকশা বেড়েছে সেই বায়োডেটার। তবু একবারের জন্য কেউ উঠিয়ে ফোন করেনি। পরীক্ষা নেয়নি। ডাকেনি একটা চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য। রাজনীতি আর তাঁবেদারির ফস্কাগেরোর জনঅরণ্যে আমাদের বলা হয়ে ওঠেনি মানিকবাবুর সিনেমার মতো 'আর ইউ আ কমিউনিস্ট?'-এর উত্তর।

একবার এক পরিচিত সিনিয়র সাংবাদিককে ফোন করে একটি চাকরি চেয়েছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, "ববি হাকিম তোকে চেনে? তুই ফোন করলে চিনতে পারবে তো? কিংবা ববি হাকিম ছাড়াও যে কোনও একটা রাজনৈতিক দলের নেতার নাম বল, যে তোকে চেনে। ফোন করলে সাক্ষাৎকার দেবে।" উত্তরে সেদিন একটাও নাম বলতে পারিনি। তাই পাল্টা উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, "তাহলে তোকে কেন চাকরি দেবে বর্তমান-প্রতিদিন?"

তারপর একদিন ইন্টারনেটের ব্যবহার সহজ হলো বাঙালির কাছে। পাড়ার মা মনসা স্টুডিও নয়, বরং ফেসবুক ঘেঁটে কেউ কেউ খুঁজল 'বেস্ট ওয়েডিং ফটোগ্রাফার ইন কলকাতা'। আমরাও সেই তালিকায় নাম লেখালাম। ভাড়ার ক্যামেরা একদিন নিজের হলো। ফেসবুকের নীল দেওয়ালে টুংটাং মেসেজে বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, শিলিগুড়ি, কলকাতা থেকে মানুষ খোঁজ নিল, জানতে চাইল, "আপনাদের রেট কত?"

লাইক বাড়তে শুরু করল ফেসবুকের পাতায়। আমরাও লাইক করে ফেললাম মোটা অঙ্কের টাকা, পুরুতের মন্ত্রপাঠের সঙ্গে মিশে যাওয়া বিসমিল্লাহর সানাইকে। 'যা কামাই সব ইএমআই'-এর যুগে ক্যামেরার পেছনে লাইট ধরে একদিন নিজের ডিএসএলআর কিনে ফেলল বামুনগাছির পাপাই সাহা, নন্দীগ্রামের শিবশঙ্কর গিরি, হৃদয়পুরের রাজ পাল।

আরও পড়ুন- সমলিঙ্গে বিয়ে করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় দাবি নয়

জয়ন্ত ঘোষাল, শেখর গুপ্ত, প্রণয় রায়, গৌতম ভট্টাচার্যরা বুড়ো হয়েছেন আজ। সাংবাদিকরাই আজ ঠিক করে দিচ্ছেন চট্টগ্রাম ভারতের সঙ্গে থাকবে না কি বাংলাদেশের। যে মেট্রোরেল সকাল সাড়ে দশটায় থামার কথা ছিল, স্বপ্ন ছিল হেঁটে যাব প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে, আজ সেই মেট্রো অগ্রহায়ণের শুরুতে এসপ্ল্যানেড থেকে ক্যামেরা গলি যায়। আমাদের না লিখতে পারা কলম আজ কালিকাপুরের কনে আর যাদবপুরের বরের গপ্পে বাইলাইন পায়।

সেই গল্পে ঠান্ডা খাসির মাংস থাকে। শিলিগুড়ি থেকে সরসুনা— কত মানুষের উৎসবে মিশে যাওয়া থাকে। হঠাৎ পাওয়া অপমান থাকে। মাঝরাতে খোঁজ থাকে "ম্যাডাম আমরা কোথায় থাকব?" নামক একটা আজব প্রশ্নের। কত মানুষের আপন করে নেওয়াও থাকে। থাকে "তুমি বিয়েবাড়ির ছবি তোলো। তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব না" নামের একটা অতি সরলীকরণ অপমান। তবু কিছুই কি পাইনি আমরা? নিশ্চয়ই পেয়েছি।

আজ কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে বাঙালি এই বিয়েবাড়ির ক্যামেরাম্যানদের পেছনে। বিয়েবাড়ির ভিডিও নয়, ওয়েডিং ফিল্ম বানাই আমরা। ২০১১-২০১২ সালে শিয়ালদহ-হাওড়া স্টেশনে মধ্যরাত্রে দাঁড়িয়ে আমরা শাটল ট্যাক্সি খুঁজতাম ২০ টাকার বিনিময়ে। আজ আমাদের মধ্যে কেউ কেউ গাড়ি কিনেছে। নইলে ওলা-উবরে ফিরছে হরিদেবপুর থেকে হৃদয়পুর। আমাদের তোলা ছবি ফেসবুক থেকে অবলীলায় চুরি করেছে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট! তবু সেই একটা আক্ষেপ 'আমরা সাংবাদিক হতে পারলাম না'! এটা কি স্বপ্নের মৃত্যু? না কি সব পেলে নষ্ট জীবন?

More Articles