কনসার্ট থেকে বিয়েবাড়ি- নেই সেই আবাহন, হারিয়েই যাবে বিসমিল্লার 'পাগলা' সানাই?

Bismillah Khan Shehnai: ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হওয়া নিশ্চিত, তখন জওহরলাল নেহরু মনে করেছিলেন বিসমিল্লাহ খানের এই উপলক্ষ্যে সানাই বাজানো উচিত।

``হাত পেতে নিয়ে চেটে পুটে খাই

বিসমিল্লার পাগলা সানাই..

হাত পেতে নিয়ে চেটে পুটে খাই

স্মৃতি বিজড়িত পাগলা সানাই।...’’

বিসমিল্লার সানাই মন পাগল করে না, এমন বেরসিক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে এই মন উথাল পাতাল করা পাগলা সানাই আজ শুধুই স্মৃতি বিজড়িত? কারণ এককথায়, সানাই বাদকদের অবস্থা বিপন্ন। Struggle for existence- অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য লড়াইটাই মুশকিল। সানাইয়ে সুর তুলে মন মাতিয়ে দেওয়ার লড়াই থেকে সরে গিয়ে আজ তাঁদের দাঁড়াতে হচ্ছে প্রতিকূলতার সামনে। কনসার্ট বা বিয়ে বাড়ির আলো ঝলমল মেজাজের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করত সানাইয়ের সুর। আজ তা বিলীন হতে বসেছে। কনসার্ট বা বিয়ে বাড়ি – কোথাওই এখন সেভাবে আবাহন নেই সানাই বাদকদের। ফলে তাঁদের অবস্থা করুণ। কী করে এই অবস্থা থেকে তাঁরা বের হয়ে আসবেন, তার কোনও সুলুক সন্ধান নেই বললেই চলে।

দিল্লির চাঁদনি চকের কাটরা প্যায়ারে লালের পাশের ফুটপাথটি ছিল পুরোনো দিল্লির সানাই বাদকদের বুকিং স্পট। এখানেই তাঁরা অপেক্ষা করতেন বুকিংয়ে জন্য। আসতেন পৃষ্ঠপোষকরা। সানাইয়ের কনসার্ট সম্পূর্ণ হয় অন্য বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গতে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – তাশা, দুক্কাদ এবং নাক্কারা। সানাই বাদকদের সঙ্গে এই সহযোগীরাও এখানে অপেক্ষায় থাকেন বুকিং পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁরা জানিয়েছেন, বুকিং আগের চেয়ে কমে গিয়েছে। এখন অনেক অপেক্ষার পরও পৃষ্ঠপোষকদের দেখা মেলা ভার।

পুরোনো দিল্লির ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে কেউ কেউ এখনও নিয়মিতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করতে সানাই ব্যান্ডের সন্ধান করেন। এখানে মাঝেমধ্যে তাঁদের দেখা মেলে। কান্ত প্রসাদ সবেমাত্র একটি বিশেষ পবিত্র দিনে স্থানীয় জৈন মন্দিরে সানাই বাজিয়েছেন। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে বিয়ের মরসুম শুরু হয় এবং তিনি আশা করছেন তাঁর ক্যালেন্ডার ঝলমল করে উঠবে বুকিংয়ের দিনলিপিতে। কিন্তু কোথায় কী! এখনও পর্যন্ত, তাঁর কাছে মাত্র এক ডজন অনুরোধ রয়েছে। তাঁর কথায়, "একটা সময় ছিল যখন সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, পুরো এলাকায় সানাইয়ের সুর গুঞ্জন করত – এখন সেই দিন আর কোথায়? পাঁচটি কাটরার মধ্যে, আমরা কিছু সেরা সঙ্গীতজ্ঞদের নিয়ে গর্ব করতাম।" আজ ফতেপুরী, সদর বাজার, পাহাড় গঞ্জ, নবী করিম, পাহাড়ি ধীরাজ এবং সীতারাম বাজার জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৬০ থেকে ৭০ জন শিল্পী, জানান প্রসাদ। শিল্পীদের দুরাবস্থা- এই শিল্প থেকে তাঁদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার বড় কারণ।

আরও পড়ুন- ফিতের ফাঁদে ‘বিকাশ’! উদ্বোধনের প্রতিযোগিতায় নাস্তানাবুদ সরকারের দেশ

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি বেনারসের লোক সুরকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে মিশ্রিত করেন। তাঁর সানাইয়ের স্বর তরঙ্গ গঙ্গার ধাপ পেরিয়ে মন্দিরের নহবতখানা ছুঁয়ে দেশের সীমানা পার করে বিশ্বজুড়ে এই বাদ্যকে অমর করে তুলেছে। এইভাবে, মন্দির, বিবাহ অনুষ্ঠান সহ আন্তর্জাতিক আর্ট ফোরামগুলিতে অনুরণনিত হতে শুরু করে বিসমিল্লাহর সানাই। সাংবাদিক রেহান ফজল লিখেছিলেন, ”১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হওয়া নিশ্চিত, তখন জওহরলাল নেহরু মনে করেছিলেন বিসমিল্লাহ খানের এই উপলক্ষ্যে সানাই বাজানো উচিত। স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা যুগ্ম-সচিব বদরুদ্দীন তায়াবজিকে খান সাহেবকে দেওয়া হয়েছিল বিসমিল্লাহ খানকে দিল্লিতে আসার আমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্ব। বিসমিল্লাহ অবশ্যই এই উপলক্ষ্যে সানাই বাজানোর সুযোগ পেয়ে খুব উত্তেজিত ছিলেন। কিন্তু তিনি পণ্ডিত নেহরুকে জানিয়েছিলেন, তিনি লালকেল্লায় হাঁটার সময় সানাই বাজাতে পারবেন না।” নেহরু তাঁকে বলেছিলেন, ”আপনি সাধারণ শিল্পীর মতো লাল দুর্গে হাঁটবেন না। আপনি আগে যাবেন। আমি এবং পুরো দেশ আপনার পিছনে পিছনে যাব।” বিসমিল্লাহ খান ও তাঁর সহযোগীরা রাগ কাফির মাধ্যমে স্বাধীনতার সকালে স্বাগত জানান দেশবাসীকে। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যে শিল্প, আজ তা বিপন্ন কেন?

সানাই বাদকরা মনে করছেন, সানাইকে ক্লাসিক্যাল সার্কিটে এতটাই প্রান্তিক করা হয়েছে যে, এটির 'শুভ' ট্যাগের কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়া সঙ্গীত উত্সবে খুব কমই প্রদর্শিত হয়। খুব কম লোকই বাদ্যযন্ত্র শিখতে পছন্দ করেন এবং খুব কম লোকই এটি আয়ত্ত করতে পারেন। সানাই আয়ত্ত করা মুখের কথা নয়। অনেক অধ্যবসায় প্রয়োজন। কোনও সঙ্গীত স্কুল বা কলেজে পাঠ্যক্রমের মধ্যে এটি অন্তর্ভুক্ত নয়। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বেশিরভাগই বারাণসীতে আছেন আর বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন।

``প্রতিটি প্রজন্মে আপনি তিন থেকে চার জনের বেশি পূর্ণাঙ্গ সানাই বাদক খুঁজে পাবেন না,‘’ মনে করেন অশ্বিনী, যাঁর ঠাকুরদা ছিলেন সানাই আইকন অনন্ত লাল এবং বাবা খ্যাতিমান সানাই বাদক দয়া শঙ্কর। তিনি বলেন, "এটি একটি চ্যালেঞ্জিং এবং মেজাজের যন্ত্র।‘’ তিনি আরও জানান যে, প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়াটি এত কঠিন যে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে শিখতে ছেড়ে দেয়। শেষবার সানাইয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়, 'দ্য ডাইকোটমি অফ ফেম'– এর হাত ধরে।  সানাইকে সাধারণত লক্ষ্ণৌ-বারাণসী এলাকার একটি যন্ত্র হিসেবে ধরা হয়, যদিও পশ্চিমে, বিশেষ করে মহারাষ্ট্র, উত্তর কর্ণাটক এবং গুজরাট, বিশেষ করে বরোদায় এর শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে।

আরও পড়ুন- যারা ফিতে কাটছে পারিশ্রমিক নিয়ে, বেশ করছে! শিল্পীদের সময়ের দাম আছে বইকি

২০ শতকের প্রথম দিকের অন্যতম সেরা সানাই বাদক ছিলেন শঙ্কররাও গায়কোয়াড়, যাঁর নাতি প্রমোদ এখন একজন বিশিষ্ট সানাই শিল্পী। এঁদের হাত ধরে সানাই অনেক দূর এগিয়েছে। ইতিহাস বলে মুঘল ও রাজপুতদের নহবতখানায় সানাইয়ের উপস্থিতি ছিল। রিস ফ্লোরা, একজন অস্ট্রেলিয়ান পণ্ডিত এবং সানাই বাদক। তিনি অনন্ত লালের কাছে সানাই বিদ্যা শিখেছিলেন। তিনি তাঁর গবেষণা পত্র 'সাম্প্রতিক দশকে সাহনাইয়ের স্টাইল: নহোবত থেকে গায়াকি আং'-এ যন্ত্রের শিকড় সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে লিখেছেন। তিনি নহবতকে এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অংশের রাজকীয় ড্রাম-পাইপ ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। পুরোনো ধাঁচের নহবত পরিবেশনা এখন শুধুমাত্র কয়েকটি দরগায় টিকে আছে। আজমেরে মইনুদ্দিন চিশতি এবং মুন্দ্রার মুবারক শাহ মুরাদ বুখারির মাজারে সানাই এবং নাক্কারার সমন্বয়ে একটি বিশেষ সঙ্গীত মূর্চ্ছনার রেকর্ডের অস্তিত্ব রয়েছে।

কখন এবং কীভাবে সানাইয়ে বড় বিবর্তন এল?

'দ্য অরিজিনস, ইভোলিউশন অ্যান্ড প্রেজেন্ট অফ ক্লাসিক্যাল সানাই'-এর উপর তাঁর এমফিল প্রবন্ধে, সঞ্জীব শঙ্কর উল্লেখ করেছেন যে সানাই বাদকরা প্রশিক্ষণের জন্য হিন্দুস্তানি কণ্ঠশিল্পীদের কাছে যাওয়া শুরু করার পরে সানাইয়ে তাঁদের প্রভাব পড়তে শুরু করে। এতে সানাই বাদ্যে একটা বড় পরিবর্তন আসে। এ প্রসঙ্গে তিনি নন্দলালের উদাহরণ দিয়েছেন, যিনি বেনারস ঘরানার কণ্ঠশিল্পী বড়ে রামদাস মিশ্র এবং ঠুমরি, খেয়াল ও ধ্রুপদের একাধিক ওস্তাদ ও পণ্ডিতদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বিসমিল্লাহ খানও লখনউয়ের কণ্ঠশিল্পী আহমেদ হুসেন খানের শাগির ছিলেন।

বিসমিল্লাহ খানই ধ্রুপদী মঞ্চে এবং চলচ্চিত্রে তাঁর আবেগপূর্ণ ও আবেদনময় কাজের মাধ্যমে এই শিল্পকে সম্বৃদ্ধ করেছেন। সেইসঙ্গে সানাই বাদকদের ভরসা জুগিয়েছেন। আজও পাগলা সানাইয়ের নাম বিসমিল্লাহ। আজকের সানাই বাদকরা চেয়ে থাকেন বিয়ের মরসুমের দিকে। যে শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, তারপরও এই বাদ্যযন্ত্র কেন ভারবাহী হয়ে থাকবে, কেন তার গৌরব নিয়ে এগিয়ে যাবেন না শিল্পীরা? তাঁদের এই বিপন্নতার মধ্যে দাঁড়িয়েও কি একবার কণ্ঠ ছেড়ে বলা যায় না,

``বিস্ময় আজ গেলো না আমার

স্বপ্নে এখনও যৌথ খামার

তোমার জন্য গানই বানাই

তোমার জন্য রইল সানাই।‘’

More Articles