ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট মেলালেই ভোটারদের ভোট সঠিক জায়গায় যাবে?

VVPAT Slip Counting: সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, প্রতি বিধানসভা পিছু দুটো করে ভিভিপ্যাট গোনা হবে ২০১৯ সালে। দুটো করে মেশিন গুনলেই ইভিএম নিয়ে মানুষের বিশ্বাস ফিরবে?

২০১২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সে দেশের নির্বাচন কমিশন একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচনের দিন যারা বিভিন্ন কারণে ভোট দিতে পারবেন না, তা সে মেশিন খারাপ থাকার জন্য হোক বা নথি ভুল হওয়ার কারণে, সে দেশের নির্বাচন কমিশন বলে, সমস্ত মানুষের ভোটদান সুনিশ্চিত করার জন্য, তাঁদের প্রভিশনাল ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। তারপর যদিও সেই ভোট গোনা হবে কিনা সেই নিয়ে তাঁরা কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। আদৌ কি ওই ভোট গোনা হয়? দেখা গেছে, মিডটার্ম নির্বাচনে প্রায় ২০% এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রায় ৩০% এই প্রভিশনাল ভোট গোনাই হয়নি। যে কোনও নির্বাচন যদি হাড্ডাহাড্ডি হয় তাহলে এই সংখ্যাটা নেহাত নগণ্য নয়। এই তথ্যটি ২০১৮ সালের। সূত্র- অক্টোবর ২০১৮, নিউইয়র্কার.কম।

আমেরিকা যখন প্রশ্ন করা শুরু করেছে, জার্মানি যখন এই প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া নির্বাচন প্রক্রিয়া বাতিল করেছে, এমনকী বাংলাদেশও যখন ব্যালটে নির্বাচন করেছে, তখন ভারতের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত ব্যস্ত এটা প্রমাণ করতে যে, ভারতীয় গণতন্ত্র অটুট। ২০১৯ সালে যে সুপ্রিম কোর্ট এডিআর এবং অন্যান্য সংগঠনের তরফে ইভিএম সংক্রান্ত মামলা শুনতেই চায়নি, সেই সুপ্রিম কোর্টই কিন্তু ২০২৪ সালের আগে এই মামলা শোনে। দু’দিন ধরে বিরোধীদের এবং নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য শোনার পরে, আপাতত রায়দান স্থগিত রেখেছে শীর্ষ আদালত। অনেক প্রশ্ন উঠেছে সেই শুনানির সময়। ইভিএম কি সত্যিই প্রযুক্তি দিয়ে প্রভাবিত করা সম্ভব? তাহলে কি আমাদের ভোটের কোনও মূল্য নেই? কোনও গোপনীয়তা নেই? যে সরকার গড়ার জন্য ভোট তার কোনও দামই নেই? নির্বাচন কমিশনও এই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছে। তাই এবারের নির্বাচনে একটা নতুন যন্ত্র সমস্ত বুথে, সমস্ত মেশিনের সঙ্গে জোড়া হয়েছে। ভিভিপ্যাট বা ভোটার ভেরিফায়েবেল পেপার ট্রেল। এই প্রথম যে ভিভিপ্যাট মেশিন যুক্ত করা হলো এমনটা নয় কিন্তু এবার আরও জোরালো দাবি উঠেছে যে ভিভিপ্যাট এবং ইভিএমের ভোট মিলিয়ে দেখে তবেই যেন ফল ঘোষণা হয়। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব আইনের ৫৬ নম্বর ধারায় বলা আছে, যদি কখনও ভিভিপ্যাট স্লিপ এবং কন্ট্রোল ইউনিটের ভোটে পার্থক্য দেখা যায়, তখন ভিভিপ্যাটের স্লিপকেই মান্যতা দেওয়া হবে।

অনেকের কাছেই ভিভিপ্যাট বিষয়টা নতুন। তাই এই যন্ত্র নিয়ে কিছু সাধারণ তথ্য জেনে রাখা উচিত। এটা অনেকটা কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত প্রিন্টিং মেশিনের মতো। কোনও ভোটার তাঁর পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পর এই মেশিন দিয়ে বোঝা সম্ভব আদৌ তাঁর ভোট ঠিক জায়গায় পড়েছে কিনা। ৭ সেকেন্ড অবধি এই কাগজের স্লিপটি দেখা যাবে তারপর এটি ভিভিপ্যাট মেশিনের স্টোরেজে চলে যাবে। কিন্তু  এর পরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

১। যদি দেখা যায় একজন ভোটার তাঁর প্রদত্ত ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তাহলে নির্বাচন কমিশন কী করবে? এখনও অবধি যা জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন সেই ভোটারকে সবার উপস্থিতিতে পুনরায় ভোট দিতে বলবে। এবার যদি ঠিক হয় তাহলে কি তাঁর আগের করা অভিযোগটি মিথ্যে বলে গণ্য হবে? গণতন্ত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী কে? যে ভোট দিচ্ছে সে, না নির্বাচন কমিশন? গণতন্ত্রে একজন ভোটারই যে সবচেয়ে শক্তিমান তা মনে করিয়ে দিতে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বা নির্বাচন কমিশনের ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি দিয়ে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও তবে একজন ভোটারকে কেন প্রমাণ করতে হবে তাঁর অভিযোগ সত্য এবং সে মিথ্যেবাদী নয়?

২। যদি দেখা যায় বারবার একই অভিযোগ উঠছে, তাহলে না হয় নির্বাচন কমিশন তখনকার মতো নির্বাচন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখবে কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে ইভিএমে ভোট বিষয়টাই এখনও সড়গড় হয়নি ভোটকর্মীদের কাছেই সেখানে কতজন মানুষ ভিভিপ্যাট মেশিনের দিকে খেয়াল রাখবেন বা
রাখলেও তা নিয়ে অভিযোগ করবেন? এতে কি চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয় থাকছে না? একবার একটি বুথে এই ধরনের অভিযোগ উঠলে কি সেই ইভিএম মেশিনটাই প্রশ্নের মুখে পড়ে না?

অনেকে বলছেন, ইভিএম সংক্রান্ত ভয় অমূলক। এই মেশিন নিয়ে সবসময়ই কোনও না কোনও বিরোধী দল প্রশ্ন তুলেছে কিন্তু শেষ বিচারে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে এই মেশিনকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। সত্যিই কি তাই? তাহলে গত রাজস্থান, ছত্তিশগড় কিংবা মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে এমন অভিযোগ কেন এসেছে যে ইভিএম মেশিন হোটেলের ঘরে পাওয়া গেছে? সবটাই মিথ্যে অভিযোগ?

এর পরে আসছে ভিভিপ্যাট স্লিপ গোনার বিষয়টি, যা নিয়ে নির্বাচন কমিশন এখনও ঐক্যমত্যে আসতে পারেনি। প্রাক্তন আইপিএসদের মধ্যে থেকে ৭৩ জন প্রস্তাব দিয়েছে, প্রতি বিধানসভার অন্তর্গত ৫০ শতাংশ ভিভিপ্যাট গুনতে হবে। নির্বাচন কমিশন দিল্লির স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের কাছে এই বিষয়ে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। যতদূর জানা যাচ্ছে, তারা একটা রিপোর্ট জমাও করেছে ২০১৯ সালেই। এর মধ্যে প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার ডঃ এসওয়াই কুরেশি একটি অনলাইন পোর্টালে তাঁর নিজস্ব মত লিখেছিলেন। বলেছিলেন, ক্রিকেটের মতো, রানার্স আপ দুটো দলের তরফ থেকে বেছে নেওয়া হোক যে কোনও দু'টি ভিভিপ্যাট মেশিন, সেই দুটো মেশিনের স্লিপ গোনা হোক তাতে সময় বাঁচবে এবং মানুষের প্রশ্নেরও নিরসন হবে। যদিও এটা কতটা বাস্তবসম্মত সেই প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ। 

এরপরেও কয়েকটা বিনীত কথা।

ক) ভারতের গণতান্ত্রিক নির্বাচন কোনও টি২০ ক্রিকেট ম্যাচ নয়. দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তের একজন অত্যন্ত সাধারণ নাগরিক অন্তত একদিনের জন্যও নিজেকে এবং নিজের ভোটকে মূল্যবান মনে করেন। ক্রিকেটীয় বিচারপদ্ধতির সঙ্গে এর পরীক্ষা পদ্ধতি মিলিয়ে ফেলাটা কি অতি সরলীকরণ নয়?

খ) এই গণতন্ত্রে যে মানুষ নোটাতে ভোট দেবেন তাঁর ভোটেরও কি সমান মূল্য থাকে না? সুতরাং শুধু রাজনৈতিক রানার্স আপ দলগুলো যা চাইবে সেটাকেই মান্যতা দেওয়া হবে কেন? এও কি একধরনের আধিপত্যবাদী চিন্তা চাপিয়ে দেওয়া নয়?

গ) এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টের কাছে জানিয়েছে যে, ইভিএম গোনার পর যদি ৫০% ভিভিপ্যাট তাঁদের গুনে ফলাফল ঘোষণা করতে হয় তাহলে আরও ৬ দিন বেশি সময় লাগবে। প্রায় ৫০ দিনের এই রাজসূয় যজ্ঞে আর ক'টা দিন বেশি গেলে কি খুব ক্ষতি হবে? 

তবে সাম্প্রতিককালে ডঃ এসওয়াই কুরেশি কিন্তু ১০০ শতাংশ ভিভিপ্যাট গোনার পরামর্শই দিয়েছেন। যখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভিভিপ্যাট মেশিন আনতে বাধ্য হলো নির্বাচন কমিশন, তখন তাঁদের কাছে প্রচুর পরিমাণে ইভিএম মেশিন ইতিমধ্যেই ছিল। প্রত্যেকটি ব্যালট ইউনিটকে যদি একটি ল্যাপটপ হিসেবে গণ্য করে বোঝা যায়, তাহলে তার কার্যপ্রণালী বুঝতে সুবিধা হবে। সেই ব্যালট ইউনিটে যদি কোনও ব্যক্তি ভোট দেন, তা চলে যেত কন্ট্রোল ইউনিটে। আর কোনও কেবল বা তার নেই। ভিভিপ্যাট আনার পরে, তাহলে সেটাকে কোথায় যুক্ত করতে হতো? ওই কন্ট্রোল ইউনিটের পরে। অর্থাৎ পরপর সাজালে কী দাঁড়ানো উচিত ছিল?

ইভিএম > কন্ট্রোল ইউনিট > ভিভিপ্যাট

যেহেতু আর কোনও কেবল বা তার যুক্ত করার পোর্ট নেই, তাই কী করা হলো?

ইভিএম > ভিভিপ্যাট > কন্ট্রোল ইউনিট

তাহলে এবার একজন ব্যক্তি যদি ভোট দেন, তাঁর ভোট দুটো জায়গায় রক্ষিত হচ্ছে। একটি ভিভিপ্যাটের স্লিপ হিসেবে, আর একটি কন্ট্রোল ইউনিটে। এবার একজন মানুষ, দেখতে পাচ্ছেন (খুব কম সময়ের জন্য হলেও) যে স্লিপটি গোনা হচ্ছে না, আর যেটি কন্ট্রোল ইউনিটে যাচ্ছে (অথচ দেখা যাচ্ছে না) সেটি
গোনা হচ্ছে। এই প্রশ্নও তো উঠতে পারে, ভিভিপ্যাট আমার হয়ে ভোট দিয়ে দিচ্ছে না তো? তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া গেল, ব্যালট ইউনিটকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয় কিন্তু ভিভিপ্যাট যে প্রভাবিত হচ্ছে না, তার নিশ্চয়তা আছে কি? 

নির্বাচন কমিশনের উচিত আরও বেশি করে স্বচ্ছতা, গোপনীয়তা রক্ষা করা। কোনওমতে একজন শাসকের হাতে দেশকে তুলে দিতে পারলেই নির্বাচন
কমিশনের দায় এবং দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী বেশি সংখ্যক মানুষকে নির্বাচনে অংশ নিতে আহ্বান জানান তখন নির্বাচন কমিশনের কাজ আরও কঠিন এবং দায়িত্বশীল হয়ে পড়ে। একে একে যখন প্রায় সমস্ত সংস্থার স্বশাসন নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে তখন তাকে রক্ষা করার দায় তো এই
প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরই বর্তায়। না হলে নির্বাচন প্রক্রিয়া আস্ত প্রহসন। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, প্রতি বিধানসভা পিছু দুটো করে ভিভিপ্যাট গোনা হবে ২০১৯ সালে। দুটো করে মেশিন গুনলেই ইভিএম নিয়ে মানুষের বিশ্বাস ফিরবে? হয়তো নির্বাচন কমিশন সব রকমের প্রযুক্তিগত চেষ্টা করছে কিন্তু ভারতের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ আরও গণতান্ত্রিক করার দায় এবং দায়িত্ব আখেরে তাদের উপরই বর্তায়।

More Articles