দিল্লি ক্রাইম ৩: বার্তার ভারে চাপা পড়ল থ্রিল?
Delhi Crime season 3 Review: ভারতে গর্ভাবস্থায় কেন লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি, তা এই সিরিজ আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কিন্তু, সত্যিই কি তাতে কোনো লাভ হয়?
'দিল্লি ক্রাইম'-এর তৃতীয় সিজন সম্পূর্ণরূপে নারীকেন্দ্রিক। এখানে মিত্রপক্ষ, শত্রুপক্ষ এবং অপরাধের শিকার সকলেই মেয়ে। এখানে মেয়েরাই মেয়েদের বন্ধু, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। ২০১২-এর বেবি ফলক কেসের উপর ভিত্তি করে তৈরি এই সিরিজ নারী পাচারের ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। বিভিন্ন মেয়েরা- বেবি নূর, খুশি, সমাজের অদৃশ্য বোঝা, শুধুমাত্র বিক্রয়যোগ্য দ্রব্য। এটিই সিরিজের মূল থিম। কিন্তু, এই সিজন দর্শকদের উদ্দেশ্যে সামাজিক বার্তা প্রচারে সফল হলেও, দর্শকদের প্রত্যাশা কি পূরণ করতে পারল?
পুরুষতন্ত্রের কাঠামোকে স্বীকার করেই এই সিজনে নারীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হয়েছে। সিরিজটির শুরুই হয় এমন একটি দৃশ্য দিয়ে, যেখানে পুরুষদের ইচ্ছে হয়েছে বিয়ে করার, তাই মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের সঙ্গে। মেয়েগুলোর জোরপূর্বক বিয়ে দিচ্ছে একজন মহিলা। মেয়েদের পাচার করা হচ্ছে। করছে একজন মহিলা। আবার সেই মেয়েদের উদ্ধারও করছেন একজন নারী বা বলা ভালো একদল নারী। পুরুষরা পুরো সিরিজ জুড়ে স্রেফ সহায়কের ভূমিকায়।
রিচি মেহতার স্ক্রিপ্ট বাহবা কুড়নোর যোগ্য। এই স্ক্রিপ্টের কারণেই দর্শকদের মনে পাচার হওয়া মেয়েদের প্রতি সংবেদনা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি জাগে, তাদের প্রতি হওয়া অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার উপলব্ধি না করতে পারলেও সমবেদনাটুকু উপলব্ধি করানোও প্রাপ্তি বটে। এখানে পুলিশ অফিসাররাও এই ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত অপরাধীদের শুধুমাত্র কাজের জন্য দায়সারাভাবে ধরতে চায় না। বরং এই অপরাধকে ব্যক্তিগতস্তরে অনুভব করে, ওই মেয়েদের প্রতি হওয়া অন্যায়, অবিচারকে উপলব্ধি করে ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে আইনি পথ অবলম্বন করে তাদের শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে। দিল্লি ক্রাইমের এই সিজন রাজ্যের সীমানা পেরিয়েছে। এবার ভিকটিমরা শুধুমাত্র দিল্লির নয়, দেশজুড়ে বিভিন্ন শহরের, বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তরের। কারণ মেয়েদের প্রতি হওয়া অন্যায় কোনো রাজ্যের গণ্ডি মানে না, এটি একটি জাতীয় সমস্যা, স্থানীয় না।
আরও পড়ুন - ফ্যামিলি ম্যান ৩: অ্যাকশন, আবেগ, বিশাল ক্যানভাস সবই আছে, নেই শুধু আগের ম্যাজিক
ভারতে গর্ভাবস্থায় কেন লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি, তা এই সিরিজ আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কিন্তু, সত্যিই কি তাতে কোনো লাভ হয়? ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগের হত্যা ঠেকানো যায় ঠিকই। কিন্তু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তিলে তিলে যে হত্যা হয়, সেটা কি ঠেকানো যায়? এখনও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে, জন্মের পর যখন পরিবার সংবাদ পায় কন্যাসন্তান হওয়ার, তাদের প্রতিক্রিয়া কারুর জন্মের সংবাদ নয়, মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার মতো থাকে। তাদের চিন্তা, "মেয়ে সংসারে দুটো টাকা রোজগার করে আনতে পারবে না, কিন্তু তার পেছনে কেবল খরচ হবে। বিয়ের সময় পণ দিতে হবে..." ইত্যাদি ইত্যাদি। দিল্লি ক্রাইমের এই সিজনে সমাজের এই ঘৃণ্য দিকটিই তুলে ধরা হয়েছে। এখানে মেয়েগুলোর পরিবারই তাদের বিক্রি করে দেয় অপরাধীদের কাছে। কয়েকজনের ক্ষেত্রে আবার গল্পটা একটু আলাদা, চাকরির লোভ দেখিয়ে অপরাধীরা তাদের ডেরায় নিয়ে আসে মেয়েদের। অর্থাৎ, তাদের ক্ষেত্রে পরিবার বিক্রি না করলেও, তাদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পরিবারের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। যেন মেয়ে হারিয়ে গিয়ে মুক্তি দিয়েছে তাদের। বা হয়তো, মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার পর কিডন্যাপ, ধর্ষিত, বা বিয়ে করে ফিরে এলে, সমাজের কাছে 'লজ্জা'র মুখে পড়ার চেয়ে মেয়ের না ফিরে আসাই ভালো। এতগুলি মেয়ের মধ্যে শুধুমাত্র সোনম নামক একটি মেয়ের ঠাকুমাকে থানায় অভিযোগ জানাতে দেখা যায়। অতএব, গল্পটা আলাদা হলেও গল্পের সারমর্ম কিন্তু এক। গল্পের উপসংহারও এক। কাউকে বিয়ে দেওয়া হয় বরপক্ষের থেকে মোটা টাকা নিয়ে আবার কাউকে পাচার করে দেওয়া হয় দেশের বাইরে।
বর্তিকা ও মিনা দুজনেই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও নেতৃত্ব দেন নিজ নিজ কর্মস্থলে, কিন্তু ঊর্ধ্বতন পুরুষদের অধীনেই থাকেন। মেয়েদের বিক্রি করা যায়, চুরি করা যায়—এটাই এই সমাজে মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। নীতি সিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা দেখি বিবাহিতা পুলিশ অফিসারের দাম্পত্য ভাঙার যন্ত্রণা। বিক্রিত মেয়েদের ক্ষেত্রে আমরা দেখি অসহায়তার যন্ত্রণা। এক মুদ্রার দুই পিঠ এখানে একইসঙ্গে সমান্তরালভাবে দেখানো হয়েছে। সিরিজে নারীদের সকল দিক—পুলিশ, অপরাধী, অপরাধের শিকার তুলে ধরে স্টিরিওটাইপ ভাঙার চেষ্টা করা হয়।
পুলিশ অফিসার বর্তিকা চতুর্বেদী (শেফালি শাহ) সিরিজের মেরুদণ্ড। বর্তিকা চতুর্বেদীর পদোন্নতি হয়েছে, তিনি এখন DIG, কিন্তু শাস্তিস্বরূপ তাঁর বদলি হয়েছে উত্তর পূর্ব ভারতের অসমে। সেখানেই ট্রাক বোঝাই পাচার হওয়া মেয়েদের উদ্ধার করেন তিনি। জানতে পারেন সদ্য আরও একটি ট্রাক বোঝাই করে মেয়েদের পাচার করা হয়েছে। তারা রয়েছে দিল্লিতে। তারপর সেই কেস নিয়েই দিল্লিতে ফেরা। এবং এরপর থেকেই থ্রিলের শুরু।

বর্তিকা চতুর্বেদীর (শেফালি শাহ) চরিত্রটি নিয়ে বলতে হলে, এখানেই শেষ করা যাবে না। দিল্লি আসার পর থেকেই তাঁর পারিবারিক চাপ, কর্মক্ষেত্রে লড়াই আমরা দেখতে পাই। এই সিজনে বর্তিকাকে পুলিশ অফিসারের কঠোর রূপে কম, মমতা ভরা মায়ের রূপে বেশি দেখা গেছে। কিন্তু আগের মতো গভীরতা যেন আর নেই। কয়েকটি গভীর আবেগ প্রকাশের দৃশ্যে, তাঁর বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। আগের সিজনগুলির মতো তাঁর অভ্যন্তরীণ সংঘাত প্রকাশ পায় না, শুধু চেনা পরিচিত, গতে বাঁধা কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পারিবারিক একটি দৃশ্যে, তার স্বামীর সঙ্গে তর্ক অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
পুলিশ অফিসার নীতি সিং (রসিকা দুগাল) বিবাহবিচ্ছেদের যন্ত্রণা ও কাজের চাপ সামলাচ্ছেন শক্ত হাতে। এই সিজনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। তাঁর চরিত্রে মেয়েদের প্রতি সমাজের প্রত্যাশা ও ব্যক্তিগত সংগ্রামের ছবি সুন্দর করে আঁকা। নীতি সিং বিবাহবিচ্ছেদের মতো একটি সংবেদনশীল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু এই বিষয়ক কয়েকটি দৃশ্যে নীতির সেরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
এএসআই সিমরন (যুক্তি থারেজা) একটি চমক এই সিজনে। নিজের কাজে দক্ষ, মিষ্টি স্বভাবের একটি মেয়ে। কিন্তু, এই চরিত্রকে বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে, এই আকর্ষণীয় চরিত্রটি স্রেফ তদন্তের একটি অংশ হয়েই রয়ে যায়।
মিনা তথা বড়ি দিদি (হুমা কুরেশি), গল্পের প্রধান খলনায়িকা। মেয়ে হওয়াই নিজের পরিবারই হত্যার চেষ্টা করে তাকে। বিয়ের পর, স্বামীর কাছেও অত্যাচারিত হয়ে অবশেষে, এই নারী পাচারের জগতে প্রবেশ করে। তার অপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও, তা ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। এই দ্বৈততা চরিত্রকে বরং আরও বেশি জটিল করে তোলে। চরিত্রটির পূর্ণ সুযোগ ছিল, দর্শকদের সহানুভূতি কুড়োনোর, কিন্তু তাকে সেই সুযোগটুকুই দেওয়া হয়নি। এমনকি, শেষ এপিসোডে, মিনার স্বীকারোক্তির দৃশ্যে, যেখানে তার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণের দিকটা জানানো হয়, সেখানেও তার গভীরতা দেখানো হয় না। এমনকি, তার স্বীকারোক্তিটিও অতি অতি সাধারণ। সম্ভবত, মিনাও এই একই চক্রের শিকার, সম্ভবত মিনাও খুশি, সোনম এবং বাকি পাচার হওয়া মেয়েদের মতোই একজন। অত্যাচারিত, নিপীড়িত, অন্যায়ের শিকার মিনা তাই সুযোগ পেয়ে নিজের অত্যাচারী স্বামীকে খুন করে হয়ে ওঠে বড়ি দিদি। কারণ তার মনে হয়, এটিই একমাত্র উপায় নিজে এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার। মিনার ভালোবাসা, আঘাত পাওয়া, দুঃখ, কষ্ট, রাগ, ঘেন্নার মতো অনুভূতি ছিল হয়তো, কিন্তু বড়ি দিদির নেই। বড়ি দিদির কাছে মেয়েগুলি স্রেফ বিক্রয়যোগ্য বস্তু, রক্ত মাংসের মানুষ নয়। আর এই সমস্তটাই কেবল অনুমান, ঠিক যেন সিরিজ থেকে বাদ দেওয়া কিছু দৃশ্য।

কুসুম (সায়নী গুপ্তা)-এর চরিত্রটির দর্শকের মনে দাগ কাটার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও সেই সুযোগ বা স্ক্রিন টাইম কোনোটাই দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন দৃশ্যে তাকে দেখে মানসিকভাবে অস্থির মনে হয়, কিন্তু তাঁর চরিত্রের আলো আঁধারি সম্ভাবনাগুলি সেক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি মেলে ধরার অবকাশ ছিল।
ভিমলা সিং (জয়া ভট্টাচার্য) বা কল্যাণীদেবীর (মিতা বশিষ্ট) মতো সহযোগী চরিত্রগুলো অপরাধ এবং অপরাধের তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তাদের চরিত্র গুলিকেও মেলে ধরার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
অর্থাৎ এক কথায়, সকলের অভিনয় মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু সকলে নিজের নিজের চরিত্র ভালোভাবে ফুটিয়ে তুললেও গল্পে সেই চরিত্রগুলিকে ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়নি। সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও, এই সিজনে দিল্লি ক্রাইমের আগের সিজনগুলির রূঢ়তা (rawness) দেখতে পাওয়া যায়নি, যা আগের সিজনগুলির আকর্ষণ ছিল। এই সিজনটি যেন অনেক গুছিয়ে বানানো। গল্প সামাজিক বার্তা প্রচারে সফল হলেও, থ্রিলারের চার্ম হারিয়েছে। সাসপেন্সের অভাবে দর্শকের আগ্রহ কমে। সামাজিক বার্তা জোরালো হলেও, তা কখনও কখনও স্রেফ প্রচারমূলক, এতে বাস্তবতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সমাজে মেয়েদের 'বোঝা' ভাবার ধারণা ভাঙার চেষ্টা প্রশংসনীয়, কিন্তু প্লট টুইস্টে পূর্বের মান নেই। লেখনীতে নতুনত্বের অভাব, তদন্তের ছন্দ পুরনো।

Whatsapp
