কর্ম কোর্মা: একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু

Karma Korma review: কুলিনারি ওয়ার্কশপে বন্ধুত্ব হওয়া দুই বান্ধবী ঝিনুক ও সাহানা (ঋতাভরী চক্রবর্তী) ব্যক্তিগত জীবনে জর্জরিত। দুজনেরই বিস্তর অভিযোগ তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে।

কর্ম কোর্মা প্রতীম ডি গুপ্তের হইচইয়ে মুক্তি পাওয়া স্লো বার্ন সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার সিরিজ। ধীর আঁচে রান্না করে তৈরি করা সিরিজের, খাবারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নামে রাখা হয়েছে 'কোর্মা'। বন্ধুত্ব, আকাঙ্ক্ষা, প্রতারণা, প্রতিশোধের মেলবন্ধন এই সিরিজ। শুরু থেকেই প্রত্যাশার জন্ম দেয় সিরিজটি, কিন্তু সেই প্রত্যাশা কি ধরে রাখা গেল?

রান্না এবং রান্নাঘর এই সিরিজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রত্যেকটি এপিসোডের নাম দেওয়া হয়েছে তাই খাবারের নামে। ঝিনুক (সোহিনী সরকার) সাধ করে বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্টাল খাবার বানাত খাঁচায় বন্দি হওয়ার আগে। আবার, মুক্তির পরও মুক্তির স্বাদ নিতে পছন্দের বিভিন্ন খাবার বানিয়ে খায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মুক্তির স্বাদ যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চায়ের স্বাদ পাওয়ার মতোই আরামদায়ক, তৃপ্তিদায়ক, আনন্দদায়ক। খাবারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় রূপক ব্যবহার করা হয়েছে গাছেরও যেমন- দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মুক্তির আনন্দে গাছে ফুল ফোটে।

কুলিনারি ওয়ার্কশপে বন্ধুত্ব হওয়া দুই বান্ধবী ঝিনুক ও সাহানা (ঋতাভরী চক্রবর্তী) ব্যক্তিগত জীবনে জর্জরিত। দুজনেরই বিস্তর অভিযোগ তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে। একজনের স্বামী অত্যাচার করে তো আরেকজনের স্বামী সময় দেয় না। তাই দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির দুই নারী বন্ধু হয়ে ওঠে। ঝিনুকের স্বামী গোপাল দাস (প্রতীক দত্ত) কর্মহীন, মদ্যপ। স্ত্রী সারারাত ধরে ডাবিং করে বাড়ি ফিরলে তাকে মৌখিক এবং শারীরিক অত্যাচারিত হতে হয় স্বামীর কাছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ঝিনুকের মাথায় সবসময় চলে টাকার চিন্তা। অন্যদিকে বিখ্যাত ডাক্তার স্বামী অর্জুন সেনের (শতাফ ফিগার) 'ট্রফি ওয়াইফ' হলো সাহানা। স্বামী টাকা-পয়সা, শাড়ি-গয়না সব দিলেও দিতে পারে না সময়। টাকা-পয়সার চিন্তা নেই কিন্তু নিঃসঙ্গ জীবন তার।

আরও পড়ুন- ফ্যামিলি ম্যান ৩: অ্যাকশন, আবেগ, বিশাল ক্যানভাস সবই আছে, নেই শুধু আগের ম্যাজিক

ঝিনুকের স্বপ্ন রেস্টুরেন্ট খোলার, রান্না তার শখের জায়গা, ভালো লাগার জায়গা। খবরের কাগজে একটি খরচসাপেক্ষ লোভনীয় রান্না শেখার ওয়ার্কশপের অ্যাডভার্টাইজমেন্ট দেখে খুব লোভ হয় তার। নিজের কষ্ট করে রোজগার করে জমিয়ে রাখা টাকা দিয়ে সেখানে অংশ নেয়। সেখানেই তার আলাপ উচ্চবিত্ত সাহানা সেনের সঙ্গে। দুজন দুজনের সাংসারিক কষ্ট ভাগের জায়গা হয়ে ওঠে। তারপর একটু মজা করে বলা কথা 'আমার বরকে তুমি মেরে দাও, আর তোমার বরকে আমি' থেকেই গল্পের মূল রান্নার শুরু। সাহানা ও ঝিনুকের মিষ্টি বন্ধুত্ব তেতো হয়ে ফের মিষ্টি হওয়ার গল্প এটি।

একটি মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে গল্পের রেসিপি নিজের মূল ধারায় পা দেয়। গল্পে প্রবেশ করেন পুলিশ অফিসার ভূপেন ভাদুড়ী (ঋত্বিক চক্রবর্তী)। যিনি, ঘটনার তল পেতে নাছোড়বান্দা। আর সেই তদন্ত, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিশোধের লড়াই নিয়েই এগোতে থাকে সিরিজের রেসিপি।

সকলের অভিনয়ই প্রত্যাশা পূর্ণ করে, কয়েকটি জায়গা বাদ দিলে। সোহিনী সরকারকে বিশেষ প্রশংসা করতে হয় তার মধ্যেও। একটি অতি সাধারণ, ভীত, আত্ম সংশয়ে পূর্ণ মেয়ে ঝিনুক। মুক্তি পেতে চায় নিজের দম বন্ধ করা জীবন থেকে। সোহিনী সেই চরিত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু মাঝে মাঝে অত্যধিক 'বোকা' হওয়ার চেষ্টা একটু চোখে লাগে।

বেশ কিছুদিন পর মিষ্টি মেয়ের চরিত্র ছেড়ে একটু ধূসর চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঋতাভরী চক্রবর্তী নামকরা উচ্চবিত্ত সুপ্রতিষ্ঠিত ডাক্তার স্বামীর সঙ্গে বাধ্যত দম বন্ধ পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকা স্ত্রীর ভূমিকায়। তার দম বন্ধ করা জীবন থেকে সেও মুক্তি পেতে চায়। প্রাণ খুলে বাঁচতে চায়। এই চরিত্রে রয়েছে একাধিক স্তর। কিন্তু, সমস্ত স্তর পরিষ্কার করে দেখানো হয় না। যা, একাধিক প্রশ্নচিহ্ন রেখে দেয় দর্শকের মনে।

শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত বুদ্ধিমান পুলিশ অফিসার ভূপেন ভাদুড়ী (ঋত্বিক চক্রবর্তী) মুচিপুকুর থানার ওসি। মৃত্যুর তদন্ত শুরু করেন তিনিই। তাঁর চরিত্রে রয়েছে একাধিক দিক। মায়ের সঙ্গে থাকলেও, জীবনে ভীষণ একা। একাকীত্ব কাটাতেই হয়তো কথা বলেন তাঁর গাছেদের সঙ্গে। কিন্তু, সেই দৃশ্যগুলি একটু বিরক্তিকরই হয়ে ওঠে। ভূপেন ভাদুড়ীকে যেন খানিকটা জোর করেই দায়িত্ব দেওয়া হয় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কৌতুক দিকটিও তুলে ধরার। তবে, তার সহায়ক কানাইয়ের (দুর্বার শর্মা) সঙ্গে তাঁর দৃশ্য গুলি দেখতে বেশ ভালোই লাগে।

গল্পে এবং গল্পের পরিবেশনায় অপটুতা বিশেষ লক্ষ্যণীয়, কিছু কিছু দৃশ্যের অকারণ সংযোজন বিরক্তির কারণ হয়। কয়েকটি দৃশ্য ভীষণ ক্লিশে। কয়েকটি ঘটনার বা দৃশ্যের কারণও বোঝা যায় না। ঝিনুক, অর্জুন সেনের নাম সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজার চেষ্টা করে মোবাইল ফোনে, কিন্তু মোবাইল ফোনে কাজ হয় না বলে কম্পিউটারে খোঁজে। যে একটি অপরাধ করতে চলেছে, সে হিস্ট্রি থেকে ডিলিট না করেই চলে আসে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সত্যিই কি মোবাইলে সেই কাজটি হওয়া অসম্ভব? একবার আড়াল থেকে বক্রদৃষ্টিতে দেখে, তার পাসওয়ার্ডও মনে থেকে গেল, কিন্তু কাঁচের সিসি থেকে নিজের আঙুলের ছাপ মুছতে ভুলে গেল? এত বড় অ্যাপার্টমেন্টে সিসিটিভি নেই? কারুর অকারণ গতিবিধি (লিফটের আশেপাশে ঝিনুকের ঘোরাফেরা) রেকর্ড হয় না? সিকিউরিটি গার্ড অনায়াসে একজন বহিরাগতকে ঢুকতে দেয় কোনোরকম যাচাই না করেই? লিফট ব্যবহার করতে দেয় এতটা সহজে? অর্জুন সেন কোন ফ্লোরে থাকে, তা-ই বা ঝিনুক জানে কীভাবে? ইত্যাদি বিভিন্ন দৃশ্যের বিভিন্ন প্রশ্নের অধরা উত্তর নিয়েই ভীষণ ক্লিশে ভাবে শেষ হয় এই সিরিজ। অত্যন্ত ভালো একটি সিরিজ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হলেও, শেষ পর্যন্ত একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু হয়েই রয়ে গেল।

More Articles