যদি ফিরে তাকাই উৎপলকুমার বসুর চলার পথে?
Remembering Utpal Kumar Basu: মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়া ও হঠাৎ নিজেকে সরিয়ে নেবার এই খেলাটি বেশ পছন্দই করতেন তিনি। এ ধরনের দুষ্টুমিতে ভরা ছিল তাঁর অস্তিত্ব।
আমার, আমাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন উৎপলদা। তাঁর সম্পর্কে আমার প্রায় সব কথা বলা হয়ে গেছে অতীতে প্রকাশিত তিনটি রচনাতে। তবে ওই ‘প্রায়’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত, ‘সব কথা’ বলতে কি কিছু বোঝায়? আর ‘কথা কি ফুরায়?’ আমি বরং একটু ফিরে তাকিয়ে দেখি কী কী যেন লিখেছিলাম। প্রথম রচনাটিতে আমি উৎপলকে, মূলত কবি উৎপলকে আবিষ্কারের চেষ্টায় নিরত থেকেছি। বস্তুত যোগসূত্র পত্রিকার সেই সংখ্যাটির ‘বহু পৃষ্ঠা ছিনিয়ে নিয়েছেন উৎপলকুমার বসু’—একথা লিখছেন সম্পাদক ও তাঁর সহযোগীবৃন্দ। তাঁরা আরও লিখেছিলেন, ‘উৎপলের মস্তিষ্কে আজও একফোঁটা মেদ জমেনি।’ লক্ষ্য করবেন, কবির হৃদয় নয় মস্তিষ্ক। অনেক খ্যাতিমান অনুসন্ধিৎসু ওই সংখ্যায় নানাভাবে খুঁচিয়েছেন উৎপলকে। আমিও দেখছি অনুরূপ খোঁচড়দের অন্যতম ছিলাম। তাঁকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছি নদীর স্রোতে, সমুদ্রতরঙ্গে, প্রকৃতির অন্যান্য অঞ্চলে, মানুষ পাড়ায়। দেখেছি কোথাও উৎপল সুস্থিত নন। আপেক্ষিত স্থিরতা একটু যেন পাওয়া গিয়েছিল প্রান্তবর্তী ব্যক্তিমানুষে—চাষী নয়, প্রেমিক নয়, মধ্যবিত্ত তো নয়ই। লিখেছিলাম,‘যদি সত্য সাক্ষ্য দিয়ে থাকে তার কবিতা তাহলে সমাজহীন এক ভিন্ন মানুষের পাশে কখনো কখনো— বস্তুত বারে বারেই তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়…সেইরকম কোনো কোনো একক মানুষের কাছে বেশ ধৈর্যশীল বকের মতোই দেখা গেছে তাঁকে…তাঁর বইয়ের উৎসর্গপত্রে যে আসে সে হল উৎপলের ছেলেবেলার, অজানা, অদেখা, সকলকে সাবধানকারী নিশাচর মানুষটি, তাঁর ঘুমহীন রাত্রির চৌকিদার।’
কোথাও কি, খুবই ব্যক্তিগত বিবেচনাবোধ তাঁকে তাড়িত করে? কিন্তু অত্যন্ত সচেতন মস্তিষ্ক উৎপলের— ‘হারামজাদা বুদ্ধিবৃত্তি, শুয়োরর বাচ্চা বিবেচনাবোধ’ বলে গাল পাড়েন তিনি, বলেন, ‘নোটো পাখি ছুঁয়েও দেখবে না এসব’। তবু আমার জানতেই ইচ্ছে করছিল উৎপলের কেন নদীস্রোত আসে না অথচ সমু্দ্র আসে যার তিনি অন্তর্বর্তী নন, তীরবর্তী, কেন প্রকৃতি শব্দটি আসে অথচ তার থেকে ঝরে পড়ে এমন অপ্রকৃতি, কেন মানব সমাজ আসে না অথচ আসে প্রান্তিক ব্যক্তি মানুষ।
আমার দ্বিতীয় রচনাটিতে দেখতে পাচ্ছি উৎপলকুমার বসুর এক দার্শনিক অন্দরমহল—একাধারে কবি ও দার্শনিক। যে অন্দরমহল থেকে নির্গত হয় এই লাইনগুলি—
একদিন যখন সময় হবে বোসো এই কাব্যের পাশে। একে ভাঙা টেবিলের মতো তুমি কাছে টেনে নাও… একে দিয়ে ভূতের বেগার খাটাও যেমন খুশি।
অথবা
‘‘আমার লেখা শেষ পর্যন্ত সেইসব ঠগবাজ পড়বে যাঁরা হেঁসেলে মদের বোতল লুকিয়ে রাখে।’’
আরও পড়ুন
কবিতা লেখে মানেই নকশাল! উত্তর কলকাতার কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু কথা
আগের রচনাটির সময় আমার মনে হয়েছিল এগুলি অভিমানের কথা। কিন্তু পরবর্তী কালে বোধ হল এ যেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর শূন্যতা। শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রথম ও শেষ পাতাগুলির মধ্য থেকে যে নির্যাসটুকু বেরিয়ে এসেছিল তা সাজালে দাঁড়ায়—
—এমন কিছুই করে উঠতে পারিনি।
—ব্যাকরণ ও বিদ্রোহ জুড়ে এক সেতু
যার নাম নশ্বরতা।
—কবিতার মৃত্যু হয়।
—তার আদিঅন্তহীন রহস্যের সামনে
আমাদের নীরবতা।
—(তবু) আমি কি সৃষ্ট পৃথিবীরই গান গাইছি?
আর তৃতীয় পুস্তিকাটিতে সত্যই একথা সেকথা। যেমন তার একটি—
‘‘আমাদের মনে আছে কয়েকজন দল বেঁধে সাদার্ন এভিনিউ দিয়ে ঘরমুখো হাঁটছি—হঠাৎ উৎপল দলছুট। বললেন, আমি একটু মাসির বাড়ি ঘুরে যাই। আমরা পরস্পর চোখ থারি—উৎপলবাবুর ‘ন–মাসিরা (সলমা জরির কাজ, ১৮ নং কবিতা) কতো জায়গায় যে ছড়িয়ে রয়েছেন।’’
সাহিত্য হোক বা জীবনযাপনে, নিজেকে এইরকম অপসারিত করা উৎপলের অন্তর্গত। মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়া ও হঠাৎ নিজেকে সরিয়ে নেবার এই খেলাটি বেশ পছন্দই করতেন তিনি। এ ধরনের দুষ্টুমিতে ভরা ছিল তাঁর অস্তিত্ব। তবে একথা সেকথা–তে অনেকটা স্থান জুড়ে ছিল উৎপলকুমার বসুর গদ্যের কথা। অত্যন্ত ভিন্নধর্মী তাঁর গদ্যরচনা। তার মধ্যে কয়েকটি: বাবুরাম প্রচার শিল্প, নরখাদক, টকিও লন্ড্রি, ধুসর আতাগাছ, টুকরো পুস্তক সমালোচনাগুলি, ‘ব্যক্তিত্ব’ শিরোনামের হাল্কা চালে গভীর মতপ্রকাশ ইত্যাদি। এককথায় অসাধারণ। একটি দু’টি উদাহরণ : কমল চক্রবর্তীর উদ্দেশ্যে চিঠি—
‘‘এ কি করেচো গা, কমলবাবু, আগের সংখ্যাটি পড়া শেষ না হতেই আরেকটি, ঈ যে, ‘নিয়মিৎ’ হয়ে উঠলো।’’
(ধূসর আতাগাছ শিরোনামের লেখাটির শুরু)
অজয় হোমের একটি বই ‘চেনা অচেনা পাখি’–র পুস্তক সমালোচনা শেষ করছেন এ বাক্যটি দিয়ে—
‘‘পাখির খাঁচায় পাখি না থাক, পাখির বই অন্তত একটা থাকুক।’’
টুকরো টুকরো মণিমুক্তার মতো কিছু গদ্য রচনা। ছোট ছোট লেখায় সহজ ভঙ্গির চালে চলতে চলতে অকস্মাৎ ছুরির ফলার মতো এক একটি বাক্য ছিটকে ওঠে এবং তা সমগ্র রচনাটির ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়। উৎপলকুমার বসুর আর একটি দিক —অনুবাদ। তিনি কবি হিসেবে ‘সাফোর কবিতা’ নামে একটি ছোট পুস্তিকা করেছিলেন। প্রকাশক ভাষালিপি। সেটির অনুসরণ করে আমি নিজে একটি বই করেছি ‘সাফো ও তাঁর কবিতা’, প্রকাশক ভাষালিপি। কিন্তু যা অত্যন্ত আশ্চর্য হবার মতো তা হল উৎপল অনুবাদ করেছেন দু’টি ভারী দার্শনিক প্রবন্ধ, ইমানুয়েল কান্ট–এর Enlightenment যার তিনি অনুবাদ করেছেন ‘জ্ঞানদীপ্তি’, আর ফ্রেডরিশ নীৎসের ‘The Birth of Tragedy’ অথবা ‘ট্রাজেডির জন্ম’। নীৎসের রচনাটির প্রতি উৎপলের আকর্ষণ বোধগম্য। কিন্তু কেন কান্ট? তিনি নিজে কারণ হিসেবে বলছেন, সর্বত্র আধুনিকতা, যুক্তিবাদ, বিমূর্তন–প্রক্রিয়া নিয়ে তর্ক উঠলে এই লেখাটির উল্লেখ হয়। সেজন্য এর বিতর্কিত চরিত্র এবং প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে এটি বাংলায় অনুবাদ করা হল। তবু, এ দুঃসাহস বৈকি।
আরও পড়ুন
বাদল সরকারের ‘প্রবাসের হিজিবিজি’-তেই ধরা আছে তাঁর তাবৎ কাজের নানা সূত্র
নিজেকে উৎপল লেখালেখির লাইনের লোক বলে মনে করতেন না, বরং তাঁর নিজের ব্যাখ্যান মতো ক্রাফট–এ, হাতের কাজে তাঁর উৎসাহ বেশি বলতেন। বলেছেন, ‘‘বাড়ির জুতো–টুতো পরিষ্কার করার দায়িত্বও আমার উপর ছিল।’’ আমরা জানি তাঁর হাতের লেখাটি কেমন সুন্দর ও সুনিপুণ ছিল এবং নোটবইতে অক্ষরগুলি কেমন সাজানো থাকতো, তা কেমন দৃষ্টি–সুখকর ছিল। তিনি একথাও বলেছেন—
‘‘যতক্ষণ না একটা লেখাকে ভিসুয়ালাইজ করতে পারি সে পাতায় কেমন দেখাবে, ছাপায় কেমন দেখাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার নিজের পক্ষে লেখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।’’
কবি কারিগর লোচনদাস চলে গেলেন একটু অবেলায়, আমাদের অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে ফেলে রেখে।
‘‘পড়ে রইল ভাঙা চশমা, ছেঁড়া পাতা দু’টুকরো পেনসিল আর ফাটা শ্লেট, খড়িগুঁড়ো, উলটানো দোয়াতের কালি, যেন রাক্ষস নেমেছে পথে।’’
(শ্রেষ্ঠ কবিতা)
Whatsapp
