কবিতা: অমৃতা | আলোচনার বিভঙ্গে শ্রেষ্ঠ স্বগতকথন
Joy Goswami: যে গ্রন্থ শুধু কবিতার জন্য দহন বেছে নেবার কথা বলে, সেই গ্রন্থ ব্যক্তিকে অতিক্রম করে, উপলক্ষ্যকে অতিক্রম করে গাঢ় ইশারায় এক কবিতা অমৃতা হয়ে ওঠে না কি?
"কী কবিতা আর কী কবিতা নয়
এটা বলতে বলতে
ওরা আমাকে মাঠের শেষ কিনারে নিয়ে এল
যেখান থেকে দুটো ঘোড়া
দুই দিগন্তের দিকে রুখে যায় উদ্দাম ব্যথাময়
সেই ছুটে যাওয়ার ছন্দও, ওরা বলল, কবিতা নয়"কবিতা: শঙ্খ ঘোষ : ১৯৭৩
উপরের এই অক্ষরমালা উৎসর্গপত্রে এপিগ্রাফ হিসেবে ব্যবহার করেছেন জয় গোস্বামী তাঁর 'কবিতা :অমৃতা' বইতে। এই উদ্ধৃতি যে পাতায় তার ঠিক উল্টোপিঠেই ছাপা রয়েছে শঙ্খ ঘোষের 'লেখকের নিয়তি' থেকে দু'টি অনুচ্ছেদ ও পনেরোটি লাইন, মাঝের ধারাবাহিকতার ত্রিবিন্দু ইঙ্গিত-সহ। এই পৃষ্ঠাটি রয়েছে শিরোনামপত্র এবং ভূমিকার ঠিক মাঝখানটিতে। 'কবিতা: অমৃতা' বইয়ের বিষয় একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের কবি ও কথাশিল্পী অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতা ও উপন্যাস। কোনো একজন কবির লেখা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের এত দীর্ঘ কাব্যালোচনা (৫৭৯২১ মুদ্রিত শব্দ সম্বলিত) ইতঃপূর্বে জয় লেখেননি। এমনকি চার প্রজন্ম পরের কোনো কবির কবিতা নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কেউ করেছেন বলে জানা নেই। আর কোনো সমালোচনা গ্রন্হের সূচনায় কোনো এপিগ্রাফ কখনো ব্যবহৃত হয়েছে কিনা এ-ও আমাদের অগোচরে আজও। দু'পাতা জুড়ে শঙ্খ ঘোষের যে রচনাংশ দু'টি এপিগ্রাফ হিসেবে ব্যবহার করলেন জয়, তাঁর একটির বিষয় কবিতার স্বরূপ, অপরটি লেখক জীবনের একাকী ও একক উচ্চারণের স্বযাচিত নিয়তি। এপিগ্রাফের এই নির্বাচন আমাদের মনে করায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি ইস্তাহারে মুদ্রণ জগৎ থেকে চিরকালের মতো নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা লিখিতভাবে ঘোষণা করেছেন জয় এবং এই 'কবিতা অমৃতা' তাঁর ২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত গ্রন্থিত এবং অগ্রন্থিত লেখার গ্রন্থরূপ। তিনটি খণ্ডে প্রকাশিত ওঁর 'গোঁসাইবাগান' বইতে বাংলা ভাষার অগণিত কবির কবিতা নিয়ে অভূতপূর্ব এক আলোচনাপ্রবাহের যে দৃষ্টান্ত জয় রচনা করেছিলেন, সেই 'গোঁসাইবাগান' প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় জয় লিখছেন,
"মোটেই এ কোনো সমালোচনার বই নয়। প্রবন্ধ তো নয়ই। অনেকটা ঢিলেঢালা ভাবে এখানে কথাগুলো বলা।"
জানাচ্ছেন, এই কলামগুচ্ছ প্রবলভাবে তাঁর 'ব্যক্তিগত উপভোগের বিবরণ'। কিন্তু এই বইয়ের ভূমিকায় জয় ব্যবহার করলেন 'দীর্ঘকাব্যালোচনা' শব্দ দু'টি। আমরা প্রস্তুত হলাম একটি পূর্ণাঙ্গ সমালোচনাগ্রন্থের পাঠ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবার। অমৃতস্বরূপ অক্ষরমালা ,যাকে আমরা কবিতা নামে ডাকি, সেই কবিতা প্ৰকাশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন যখন সর্বার্থে সক্ষম এক কবি, তখন তাঁর এই স্বেচ্ছানির্বাসনের মুহূর্তে লেখা দীর্ঘ কাব্য-আলোচনার উৎস ও গন্তব্য কেবলমাত্র অমৃতা ভট্টাচার্যের রচনার নৈর্ব্যক্তিক পাঠ, এই অনুমানে স্থির থাকা হয়ত সম্ভব নয় 'কবিতা:অমৃতা' বইটির নিবিড় পাঠকের কাছে।
পাঠ পরিসর ও পাঠ পরামর্শ-এই দুই দিক থেকে জয় গোস্বামীর কবিতা-আলোচনার কৌশলটি বাংলা কাব্য সমালোচনার বিভিন্নমুখী ধারাগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের দুর্ভাগ্য বাংলা সাহিত্য সমালোচনায় বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন সমালোচকের হাত দিয়ে যে নানাবিধ দৃষ্টি ও বিশ্লেষণ প্রকৌশল ব্যবহৃত হয়েছে, তার ঘরানাগুলোকে নির্ণয় করে কোনো পাঠ্যরূপ বাংলা সাহিত্যপাঠের প্রাতিষ্ঠানিক আঙিনায় তৈরি হয়নি। 'বরং সাহিত্য সমালোচনা' এবং' সমালোচনা সাহিত্য' দু'টি শব্দবন্ধই যুগপৎ ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা সাহিত্যপাঠের প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে। এই দু'টি শব্দবন্ধের প্রথমটি নির্দিষ্টভাবেই 'সাহিত্যের সমালোচনা' আর দ্বিতীয়টি 'সমালোচনারূপ সাহিত্য'। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে আমাদের অবধারিত ভাবেই মনে পড়ে যায় 'প্রাচীন সাহিত্য' অথবা 'ছিন্নপত্রের' লেখক রবীন্দ্রনাথকে,যে রবীন্দ্রনাথের 'কুমারসম্ভব' বা 'রামায়ণ'-এর ব্যাখ্যানে আমরা যত না কালিদাস বা বাল্মীকিকে পাই, তার চেয়েও বেশি পাই রবীন্দ্রনাথকে। রোমান্টিক সাহিত্যতত্ত্বের দিক থেকে কবি যখন কাব্যের আলোচক তখন আলোচক-কবির আপন আলোতেই আমরা আলোচ্যকে দেখি। যুদ্ধ-উত্তর শিল্পকালের আত্মরহিত নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টির বিপরীতে আমরা সেখানে দেখি এক অমোঘ আত্মবিম্বন। আমাদের চোখ পড়ে আলোচক কবির মনের ভিতরের এক চলমান প্রক্রিয়ার দিকে।
'ভিতরের প্রক্রিয়াটি কী? সে হলো কবির আত্মসমালোচনা'। লিখছেন জয় ,'কবিতা অমৃতা' বইয়ের তেরো নম্বর পৃষ্ঠায়। তুলে আনছেন কিসলোভসকি-র 'ক্যামেরা বাফ' ছবিটির কথা। জয় লিখছেন, 'ফিল্মের একদম শেষে কিসলোভসকি দেখিয়েছেন, ওই ফোটোগ্রাফার আর বাইরের দিকে তাঁর ক্যামেরা তুলে ধরছে না--- বাইরের কোনো বিষয়বস্তু আর তাঁর উপজীব্য নেই তখন, সেই ফোটোগ্রাফার ক্যামেরা ঘুরিয়ে নেয় তাঁর নিজের দিকে। নিজেকে এবার দেখতে শুরু করে সেই ফোটোগ্রাফার।' জয় কিন্তু এই কথাগুলি লেখেন তাঁর আলোচ্য অমৃতা ভট্টাচার্যের প্রথম কবিতাটির প্রসঙ্গে, যে কবিতাটিকে আমাদের আপাতভাবে একটি বিবরণধর্মী কবিতা বলেই মনে হয়। এই কবিতাটি উদ্ধৃত করবার ঠিক আগে জয় কবি অমৃতা ভট্টাচার্যের একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। জয় সেই সাক্ষাৎকার স্মৃতিতে আমাদের জানান, অমৃতার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। বামফ্রন্টের শাসকদলের বিরোধিতা করায় সিপিআইএম-এর লোকেরা তাঁর বাবাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কয়েকদিন বাদে ফিরিয়ে দেয় মাথায় চৌদ্দটা সেলাই-সহ। তাই অমৃতার কবিতার নিচের কয়েকটি পংক্তিকে যথার্থ ভাবে বুঝতে হলে কবির এই ধরণের আত্মজৈবনিক তথ্য জরুরি বলে মনে করেন জয়। অমৃতা লিখেছিলেন,
'আজও বাবার হাতে
চিরুনি ধাক্কা খায়
সেলাইয়ের স্ফিত দেয়ালে;
চিরুনির সঙ্গে
ওই প্রত্যেক টা দেয়ালে ধাক্কা খায়
আমার চুপ করে থাকার বিলাসিতা।'
আমাদের মনে হতে পারে জয় যখন লিখছেন যে তার মতো সন্ধিৎসু পাঠকের জন্যে কবিদের একান্ত সাক্ষাৎকার জরুরি, জয় সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে জীবনী বিশ্লেষণের ঘরাণাটাই বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু তা তো নয়! ঠিক এর ছয়টি বাক্য পরেই তিনি লিখছেন 'নিজের দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে নেওয়ার কথা', মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে শঙ্খ ঘোষের কবিতাতেও পাওয়া যেত এরকম আত্মসমালোচনার স্বর। আমাদের তো এও মনে পড়ে ৪৬-এর দাঙ্গার পরে জীবনানন্দের সেই আহত উচ্চারণ, 'মানুষ মেরেছি আমি... তার রক্তে আমার শরীর ভরে গেছে।' কবির ব্যক্তিগত যাপিত জীবনের চাইতে কবির অন্তর্ভুবন বড় হয়ে ওঠার এই ছবি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্বের ইতিহাসে M.H. Abrams-এর মোড়-ঘোরানো বই 'The Mirror and the Lamp' এর কথা, যে বই আমাদের মনে করিয়ে দেয় কবিতা রচনা এবং ব্যাখ্যানের ক্ষেত্রে কবির আত্মজীবনের চেয়ে আত্মদীপন বেশি জরুরি। জয় লিখছেন,
'বাংলা কবিতায় দু'টি প্রধান ধারা দেখা যায়। একটি হলো, বিবরণ ধর্মী কবিতার ধারা অন্যটি সংকেতধর্মী কবিতার পথ। কখনও কখনও একই কবির দু'টি ভিন্ন সময়ে এই দু ধরণের কবিতাই লিখেছেন, এমন আমরা দেখতে পাই বাংলা কবিতার অনতিঅতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে।'
জয় অমৃতা ভট্টাচার্যের এমন কবিতার কথা বলতে চাইবেন এবার যেগুলো সংকেতধর্মী। এই সংকেতধর্মী কবিতা কেমন? জয় লিখলেন,
'...যে সব কবিতার মূল কোথাও কোথাও মনস্তত্ত্বের জটিলতার মধ্যে প্রবেশ করেছে। যেখানে কবিতার ভাষা সহজ ও সরল হলেও কবিতার অন্তর্বস্তু কবির চেতনার গভীরে চেপে রাখা কোনও স্তরের উন্মোচন সম্ভব করে।'
এখানে জয় উল্লেখিত 'মনস্তত্ত্বের জটিলতা' এবং 'চেতনার গভীরে চেপে রাখা স্তর' কি আমাদের মনে করিয়ে দেয় না বিশ শতকের শিল্প বিশ্লেষণে ফ্রয়েডীয় অবচেতনবাদের কথা? তাহলে আমরা দেখছি জয় এই সমালোচনাগ্রন্থের মাত্র ষোলোটি পাতার মধ্যে কাব্য সমালোচনার তিনটি প্রক্ষেপ আমাদের সামনে নিয়ে আসছেন। এক, সাহিত্যের জৈবনিক ব্যাখ্যান দুই, আত্মগত ভাববাদী (solipsistic) দৃষ্টির ব্যাখ্যান ও তিন বিশ শতকী অবচেতনবাদী সাহিত্য সমালোচনার ঘরানা। আসলে বাংলা কাব্য আলোচনায় জয় নিজস্ব যে ঘর রচনা করছেন বিগত তিনটি দশক ধরে ,সে ঘরের প্রকৃতি ও পরিসর তাঁর পূর্বজদের নির্মিত বা অনুসৃত ঘরানাগুলির চেয়ে আলাদা। এই বইটি পড়তে পড়তে আমরা কবি অমৃতার কবিতার ভুবনে জয়ের সাথে চলতে থাকি আর চলতে চলতে লক্ষ্য করি জয় সব অর্থেই সাহিত্যের পাঠ থেকে পাঠান্তরে যেতে থাকেন। যেতে যেতে আমাদের সঙ্গী করে নেন তাঁর নিজস্ব কাব্যদর্শনের এবং নানা ধারার শিল্পলোকের নানা যাত্রাপথের আলোর। বিস্মিত হয়ে দেখি সর্বাধুনিক সারস্বত চিন্তাজগতে সাম্প্রতিকতম আলোচনভঙ্গি তাঁর কাব্যালোচনার বিরল অন্তর্গত শক্তি হিসেবে জেগে উঠতে থাকে।

রবীন্দ্রকবিতায় মগ্ন জয় গোস্বামী
জয় আকৈশোর সঙ্গীতসন্ধানী, শাস্ত্রীয় ও বিগত দুই শতকে বাংলা গানের ভুবনের একান্ত পথিক। তাই তাঁর ছন্দ ও কাব্যজগতে বিচরণ বাংলা কবিতার গভীর গীতময় উৎসের সাথে লগ্ন হয়ে থাকে। পুরো "কবিতা অমৃতা" বইটি আমাদের এক সাংগীতিক গড়নের সম্মুখীন করে তোলে; প্রথমাংশ, মধ্যভাগ এবং শেষ পর্ব মিলেএই বই চরিত্রে ও চলনে শাস্ত্রীয় যন্ত্রবাদনের আলাপ-জোড়-ঝালা এই ত্রিপার্বিক বিন্যাসকে মনে করিয়ে দেয়। সেই সাংগীতিক গড়নের শরীরে বয়ে চলে গানের মত শব্দমালা। "নৈঃশব্দ্য যা দেখে .." অমৃতার 'বিশ্বাসী' শিরোনামের কবিতার এই শব্দগুচ্ছ জয়কে আলোড়িত করে। চারিপাশের এই সশব্দ জীবনে শ্রান্ত জয় লেখেন,
" মেসেজও একরকম শব্দ।...মেসেজ ছাড়া বাজে ফোন। সারাদিনে বারবার। কোনো পড়ার কাজে, লেখার কাজে মনোনিবেশ করব,তার সাধ্য কী আমার?..অতিরিক্ত ব্যবহারে শব্দ সারাদিন ধরে আমার উপর দিয়ে বয়ে যাবে স্রোতের মতো।...শব্দ, কেবল শব্দ "।
একটি আলোচনাগ্রন্হের শরীরে স্বগতকথনের এহেন স্বর ভাসে, শব্দের যমক অতিক্রম করে তা স্পষ্টত ছুঁতে থাকে আধুনিক semantics-এর দুনিয়া, সাহিত্যপাঠকের স্মৃতিভারে দোলা লাগে নি:শব্দের তর্জনীছোঁয়ায়, আমরা আলোচকের নিজস্ব রুদ্ধ কবিতার অমৃতের ঘ্রাণ পাই। সংস্কৃতি পাঠের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো শিল্পকাজের আলোচনা একটি আধুনিক দস্তুর। এই রীতিতে আলোচনাকালে উঠে আসে আন্ত:শৈল্পিক চলাচল, আর অমোঘভাবে আসে রাজনীতি। এই দীর্ঘ কাব্যালোচনায় জয় অনায়াস কথকতায় নিয়ে আসেন তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠ, বিশ শতকের modernist সাহিত্যতত্ত্ব, এলিয়ট-এর 'থ্রি ভয়েসেস অব পোয়েট্রি'র মূল প্রবন্ধ যে তিনি পড়েছেন শঙ্খ ঘোষের উল্লেখ থেকে প্রাণনা পেয়ে সেই ব্যক্তিগত স্বীকার অঙ্গীভূত হয় এই বইতে, যেমন অন্তর্গত হয় আলোচ্য কবি অমৃতার সাথে তাঁর তৎকালীন শব্দবিনিময়ের প্রসঙ্গ। এই উল্লেখগুলি এই গ্রন্থকে দেয় এক আত্মজৈবনিক আলো, আমরা দেখতে পাই প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার প্রাঙ্গণ থেকে বহুদূরে বড় হতে থাকা বাংলাভাষার এক ক্ষীণস্বাস্থ্য কবির বিশ্ববিদ্যার একলব্যসদৃশ স্বদীক্ষণ। এই আলোচনাগ্রন্থে তাঁর প্রসঙ্গপরিসর ছুঁয়ে যায় নাটক, নাট্যবিদ্যা, থিয়েটার ও অভিনয়কলা, অভিনয় দেখার স্মৃতি, রাগরাগিনী, বাংলা গানের আমূল ভুবন, ফিল্ম ও ফিল্ম স্টাডিজের খুঁটিনাটি, পুরাণ ও পুরাকল্প, বিজ্ঞান, গণিত, কোনো ছাত্রের ক্লাসরুমের শিখনঅভিজ্ঞতার ডায়েরি, এমনকি ক্রিকেটকেও। অমৃতা, তাঁর অনেক কবিতার উৎসমুখে বা অন্তিমে রাখেন বিষ্ণু দে, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বা পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের মতো পূর্বজ কবির নাম বা পংক্তির সঋণ উল্লেখ। আর জয় সেই উল্লেখের অভ্যন্তরে আমাদের নিয়ে যেতে থাকেন, নিয়ে যেতে থাকেন এক নির্ণয়ের দিকে। তিনি যেন সুদক্ষ সেতারির মতো বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের বিস্তারে প্রবেশ করেন, আমরা শুনে নিতে থাকি তাঁর কথকতায় কবিতার অবহমানের সপ্তস্বর। তিনি যখন দেখাতে থাকেন অমৃতার লেখায় ঐতিহ্য আর ব্যক্তিপ্ৰতিভার সার্থক রসায়ন সম্পূর্ণ হয়েছে, দীক্ষিত পাঠক বুঝে নিতে থাকেন এই দৃষ্টিপ্রদীপ কেবলমাত্র হাতে তুলে নিতে পারেন এক চিরশিশিক্ষু কবি যিনি একাধারে এলিয়ট-এর 'ট্র্যাডিশন এন্ড ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট' পাঠ করেছেন, প্রয়োগ ও প্রমাণ করেছেন তাঁর একা ও একক কাব্যজীবনে। আর দীর্ঘ কবিতাজীবনের স্বনির্দিষ্ট অবসরপ্রান্তে বসে চার প্রজন্ম পরের এক অনতিপঠিত কবির রচনার গভীর ও ব্যাপক বিশ্লেষণের মাঝে তাঁকে লিখতে হয়,
"আমাদের সাম্প্রতিক কবিতাসমাজে তো এমন লেখকদেরই প্রাধান্য যাঁরা নিজেরা নিজেরা সার্থক কবিতা রচনায় সক্ষম হলেও অন্যের ক্ষেত্রে ভুল খোঁজেন প্রথমেই।" (পৃষ্ঠা:৬৪) অমৃতার 'রজস্বলা' কাব্যের বিশ্লেষণে জয় নির্দেশ করেন মহাভারত ও পুরাণ এর কালপর্বের সাথে সমকালের সংযোগ নির্মাণের ইশারার দিকে। এই বই লিখতে লিখতে জয়কেও লিখতে হয় তাঁর সমকালবীক্ষার ছবি। লিখতে হয়:
"মানুষ এইরকম। 'ঘাসের ছুরি' হাতে তারা হাঁটে সন্তর্পণে। এখানে প্রত্যক্ষভাবে আমি ঘাসের দৃষ্টান্ত দিয়েছি ঠিকই, আসলে এইরকম ঘাসেই ক্রমাগত রূপান্তরিত করা হচ্ছে নবীন-নবীনাদের মন ,সমাজের সকল ক্ষেত্রে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রও তার বাইরে নয়। কেননা সমাজের ভেতর থেকেই তো উদ্ভূত হয় সংস্কৃতি"।
আর এই সূত্র ধরেই আমরা দেখব কীভাবে আধিপত্যের রাজনীতি, নারীবাদ, জেন্ডারচর্চা কীভাবে হয়ে ওঠে জয়ের বিশদ আলোচ্য। অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতায় যোনির রূপকল্প (যেমন,'ঝিনুক খোল ,বীর্য ধর') আলোচনায় জয় যেমন প্রয়োগ করেন Caroline Spurgeon প্রবর্তিত রূপকল্পনির্ভর টেক্সট বিশ্লেষণের পশ্চিমী ভঙ্গিটি, তেমনি ব্যবহার করেন ইভ এন্সলারের 'দ্য ভ্যাজাইনা মনোলগ' এর পাঠ। অমৃতার কবিতার সাথে নারীবাদের রাজনৈতিক বয়ানগুলির এক অন্বয় রচনা করতে করতে থাকেন আলোচক জয়। তিনি রাখেন ইনস্টিটিউট অব ক্রিশ্চিয়ান স্টাডিজের জ্যানেট সি ওয়াসেলিয়াসের প্রবন্ধ 'Gender Identity without Gender Prescriptions : Dealing with Essentialism and Constructionism in Feminist Politics' থেকে উত্তর আধুনিক নারীবাদী বয়ান সম্বলিত একটি সাড়ে পাঁচ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ উদ্ধার। লেখেন,
"আজকের দিনের নারীচিন্তক তথা নারী দার্শনিকরা কী ভাবছেন এই Essentialism নিয়ে সে কথার কিছু কিছু চিন্তাংশ অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতার বইটি পড়লে মনে জাগরিত না হয়ে পারে না "।
Luce Irigatory-র 'The Sex Which is not One' উদ্ধৃত করে জয় আমাদের মনে করিয়ে দেন "Female sexuality has always been conceptualised on the basis of masculine parametres". . জয় যখন আমাদের দেখান অমৃতার কবিতায় আঙুলের রূপকল্পের (বেঁচে থাকে আঙুলে স্বীকৃতি)। উত্তর আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাখ্যান সম্ভব, পাঠ পরামর্শ হিসেবে তিনি রাখেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক অনূদিত দেরিদার 'অব গ্রামাটোলজি' গ্রন্থের, আমরা চমকে উঠি জয়ের দুরূহ দর্শনপাঠের বিচ্ছুরণে,আমাদের মনে পড়ে যায়, 'অফ গ্রামাটোলজি'তে দেরিদা লিখছেন :
"Finger or wand is here a metaphor.Not that it designates another thing.It concerns God .God has no hand ,he needs no organ. Organic differentiation is the property and the misfortune of man."
লিখছেন,
"... Thus is explained the anonymity of Him who inclined the axis of the world with his finger ".
(The Essay on the Origin of Languages ,Of Grammatology ,trans :Gayatri Chakravorty Spivak, Motilal Banarsidass,Delhi ,1994 ,p.257)
কাব্য আলোচনার এই দার্শনিক/রাজনৈতিক পাঠ দর্শন ও মানবীবিদ্যার দীক্ষিত চর্চকের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু যা সম্ভব নয় সে কথা বলি। অমৃতারএই ধরণের একটি নারীকেন্দ্রিক কবিতার (ঋণশোধ) ছন্দ ও অন্ত্যমিলের প্রয়োগ বিশ্লেষণ করতে করতে জয় লেখেন:
"চমকপ্রদ মিল প্রয়োগ দ্বারা অনেক সময়েই অন্য অন্য কবি পাঠকের বাহবা পান বটে, তবে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিলপ্রয়োগ আর মিলন থাকছে না। কেন? জোর করে যদি পুরুষ নারীর সঙ্গে মিলিত হয় তাকে বলে ধর্ষণ। ধর্ষণে একপ্রকার বলপ্রয়োগ ঘটে,অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রেও এমন বলপূর্বক প্রয়োগ আমরা দেখি না,তা নয়। অমৃতা সে রাস্তায় যান নি। কারণ তিনি নারী"।
ভাষা ও শব্দচয়নের নারীবাদী ব্যাখ্যান আমরা ইতঃপূর্বে বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্য আলোচনায় দেখেছি। কিন্তু ছন্দের নারীবাদী বিশ্লেষণ? জয়ের আগে কেউ করেছেন! মনস্বী কবি ছাড়া কারো পক্ষে এই বিশ্লেষণ সম্ভব? যে জয় বারে বারে ভালো কবিতার পায়ে ফিরে যান সর্বসমর্পণের আনতি নিয়ে, সেই জয় পারেন ছন্দকেও মানবীমনের দিক থেকে দেখতে, লিখতে। কবিতা বিষয়ে এমনতর লেখাগুলি জয়ের কাছে, এই গ্রন্থেরই অন্য পর্বের এক স্বীকারোক্তিতে, 'পূজাপুষ্পের' মতন। ("আমার মন এই 'জ্যোৎস্না আজ বিধবা' উচ্চারণটি সারাজীবন প্রাণে ধরে রাখবে-- পূজাপুষ্পের মতন।" পৃষ্ঠা ১২৫)
আরও পড়ুন
অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী, তাঁর 'ভাষা,অর্থ, সত্য' বইতে লিখছেন যতি ও নানারকম চিহ্নক-এর কথা, লিখছেন মুদ্রিত ও ডিজিটাল টেক্সট এ নানা সংকেত, স্পেস-এর ব্যবহারের এমন তাৎপর্যের কথা যা শব্দ-অতিক্রমী বার্তা বয়ে আনে। জয় অমৃতা ভট্টাচার্যের কবিতার যতি ও স্পেস-এর ব্যবহারে কীভাবে এক কাব্য ইশারা তৈরি হচ্ছে তার আলোচনা করেন কবিতার গঠন স্থাপত্যের নন্দনতত্ত্ব ছুঁয়ে, পূর্বজ কবিদের, বিশেষত: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার স্পেস ও পংক্তির পুনরাবর্তন ব্যবহারের সাথে একটি নিবিড় তুলনামূলকতায়। এই আলোচনায় জয় নিজে আসেন পশ্চিমী দুনিয়ার আধুনিক সেমিওটিক্সের খুঁটিনাটি।
আর এই তীব্র টেকনিক্যাল বিশ্লেষণের পাশেই তিনি রাখেন তাঁর রাজনৈতিক সমকালের বোধ। লিখতে থাকেন :
"অমৃতা ভট্টাচার্যের যে দুটি কবিতা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি , যেখানে এমন সব চিন্তাবীজ আছে যা আমাদের গাজার শিশুহত্যা থেকে নাৎসি জার্মানির হাতে শিশুহত্যার ঘটনাকে এক করে দিতে পারে।"
বইয়ের ভূমিকায় জয় লিখছেন:
"এই বইটি লিখেছি, অমৃতা ভট্টাচার্যের লেখার বিভিন্নমুখী চিন্তাবিদ্যুতের স্রোতধারার অভিঘাত আমাকে আলোড়িত করেছে বলে।"
আমরা লেখকের এই কৈফিয়তকে সম্মান জানিয়েও বলব, এই আলোড়ন একটি গভীর ও ব্যাপক গ্রন্থরচনার উদ্দীপক ও উপলক্ষ্য। অমৃতার রচনার বিশ্লেষণে, নিষ্ঠা ও নিবিড়তায়, কোনো ফাঁক রাখেননি জয়। কিন্তু জয়ের আত্মনির্বাসন মুহূর্তে প্রকাশিত এই বইয়ে বিশদ জ্যোৎস্নার মতো জয় বিছিয়ে রাখেন তাঁর নিভৃত অন্তর্ভুবন। কবিতা ও উপন্যাস আলোচনার কথকতা বুনতে বুনতে জয় এমন কিছু উল্লেখ, উচ্চারণ আর অনুষঙ্গ মিশিয়ে দেন এই লেখায়, আমরা দেখতে পাই পাঁচ দশক কবিতার দুনিয়ায় বসবাসী এক সপ্ততিপর কবিকে, যিনি প্রতিষ্ঠার পরিসর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন এক সুনম্র দৃঢ়তায়। তিনি মুদ্রণমোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করছেন সম্পূর্ণ সক্ষম অবস্হায় (এখানে মনে রাখতে চাই 'সক্ষম' শব্দের উৎস অর্থটিকেও , ক্ষমার সহিত, এই অর্থটি), কিন্তু নিজের সাধনা থেকে সরে আসছেন না। বরং পেশাদার প্রকাশনজগতের চাহিদাযোগানের দড়াদড়ি ছিঁড়ে বসতে চাইছেন নিরালায় তাঁর লেখার একান্ত আসনে।
এই বইয়ের ১৭পাতায় ব্যক্তিগত পাঠস্মৃতি, জীবনস্মৃতি প্রসঙ্গে জয় লেখেন,
"আমার যেমন মনে পড়ছে অস্ট্রিয়ার লেখিকা ইলিয়েনিক-এর কথা"।
ইলিয়েনিক ২০০৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পান, কিন্তু তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য স্টকহোমের সেই সাড়ম্বর অনুষ্ঠানে যেতে চাননি। সুইডেনের দূতাবাসে একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে, পরে তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করেন।আমাদের মনে পড়ে কবি জয় গোস্বামী ২০১৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দের হাত থেকে ভারতীয় জ্ঞানপীঠ প্রদত্ত 'মূর্তিদেবী পুরস্কার' গ্রহণ করার রাষ্ট্রীয় প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন, নম্র বিনয়ে তিনি সরকারি প্রস্তাবককে জিজ্ঞেস করেন, রাষ্ট্রপ্রধানের বদলে কবি শঙ্খ ঘোষের হাত থেকে তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করতে পারেন কিনা। ইলিয়েনিকের নিভৃতবাসিনী কবিসত্তার উল্লেখ করছেন আর এক কবি যিনি তাঁর প্রতি অর্পনীয় একটি সম্মানপুরস্কারের আধার হিসেবে রাজসভায় রাজপুরুষের হাতের বদলে বেছে নেন তাঁর পিতৃপ্রতিম পূর্বজ কবির হাতখানি, আমাদের মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের 'পুরস্কার' কবিতার কথা। মুদ্রণদুনিয়া থেকে স্বেচ্ছা-অবসরের পরে সাংবাদিক অর্ক দেবকে দেওয়া একটি পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে জয় উল্লেখ করেন "আত্মমোহমদ" শব্দটি, উল্লেখ করেন তাঁর পেশাদার সাহিত্য জীবনে দেখা অনেক লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক এই আত্মমোহমদের প্রভাবে ক্রমশঃ ক্ষীয়মান হয়ে পড়েন নিজের লেখায়। এই বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণের পরিশেষে জয় 'বিধিসম্মত সতর্কীকরণ' শিরোনামে যে বয়ানটি যোগ করেন, সেখানেও লেখেন,
"প্ৰতিভাবান কবি ও লেখকদের জীবনে আসে নিশিডাক।"
জয় এই পরিশিষ্ট লিখছেন ২০২৪-এর ১০ ডিসেম্বর। আর এই অবশ্যম্ভাবী নিশিডাককে উপেক্ষা করার অঙ্গীকার নিয়েই জয় নিজেকে নিজের লেখার প্রকাশবাসনা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেন ঠিক এর এক বছর আগে, তাঁর কবিজীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবার মুহূর্তে, একটি প্রকাশিত ইস্তাহারে। 'কবিতা :অমৃতা' বইটির ঠাসবুনট গড়নের মধ্যে একটি রুপোলি সুতোর রেখায় গাঁথা হতে থাকে জয়ের একান্ত অক্ষরমালা। ফিরে ফিরে আসে নির্বাসিত এককের স্বর, আসে একাকী যক্ষের বাকপ্ৰতিমা, বারবার আসে গ্যালিলিওর জীবনের উল্লেখ, সেই সাথে আসে নিজের ভূমিকায় স্বেচ্ছাঅবসিত শম্ভুমিত্রের রেফারেন্স ও রূপকল্প। এই বইয়ের ২৬ পৃষ্ঠায় অমৃতার একটি কবিতার ব্যাখ্যায় একটি অনুচ্ছেদের শেষে জয় লেখেন,
"...মানুষ তো কখনো যক্ষের জীবন নিয়েও বাঁচে ..."
ঠিক তার পরের অনুচ্ছেদ শুরু করেন জয় এই ভাষায়..
" যেমন গ্যালিলিও বেঁচেছিলেন..."
পূর্ণ একটি অনুচ্ছেদ জুড়ে জয় লিখতে থাকেন ব্রেশটের নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্যালিলিওর কথা, 'গৃহবন্দি, সম্মানচ্যুত' গ্যালিলিও, জয় লিখতে থাকেন,
"প্রিয় ছাত্র আন্দ্রেয়ার হাতে সেই পাণ্ডুলিপি গোপনে তুলে দিতে সক্ষম হচ্ছেন গ্যালিলিও এবং সেই পাণ্ডুলিপি রওনা হচ্ছে রোমের সীমান্ত পেরিয়ে বাইরের পৃথিবীর দিকে।"
...জয় তো তাঁর নির্বাসনী লেখায় জানিয়েছেন, একা ঘরে কবিতাই লিখবেন তিনি। এই পাণ্ডুলিপি কি ঘরের সীমান্ত পেরিয়ে বাইরের পৃথিবীর পথে পৌঁছে যাবে না কোনোদিনও? মুদ্রণের বাসনা মনে না রেখে যে কবিতা লিখে চলেছেন জয়, সেই শুদ্ধ আগুনের মতো লেখা যদি কোনোক্রমে পাঠকের করতলে এসে ধরা দেয়, তবে কি ক্ষুণ্ন হবে কবির নির্বাসনা? গ্যালিলিওর জীবনের এই উল্লেখের ঠিক পরেই জয় শম্ভু মিত্রের গ্যালিলিওর ভূমিকায় অভিনয়ের কথা বলেন আমাদের। মনে করিয়ে দেন এই নাট্যের অভিনয়ে শম্ভু মিত্র কেমন বুনে দেন এক যক্ষজীবনের ইশারা। বইয়ের ১৪৭ পাতায় আসে শম্ভু মিত্রের 'সম্পৃক্তি' নামের অভিনয়কলা বিষয়ক লেখাটির উল্লেখ। শম্ভু মিত্র বারে বারে অভিনয়বিদ্যার আলোচনায় ব্যক্তির নিজের সঙ্গে এবং সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের যে সন্ধানের কথা বলেন, জয় সেই কথাটি বসিয়ে নিতে চান কবি ও কবিতার পরিসরের কেন্দ্রে। তত্ত্বের আঙিনায় জয় যা করলেন তাঁকে আমরা সমালোচনাবিদ্যার অন্যতম পরিভাষায় বলতে পারি paradigmatic shift. কিন্তু এখানেই তো থামলেন না জয়। তিনি লিখলেন,
"মনে রাখতে হবে ১৯৮৩ সালে এই প্রবন্ধ লিখছেন শম্ভু মিত্র,একথা আমি আগে উল্লেখ করেছি। কেন এই বিশেষ সালের উল্লেখ করতে হল আমাকে? কারণ ১৯৮১ সালে ব্রেশটের 'গ্যালিলিও গ্যালিলাই'-এর গ্যালিলিও চরিত্রের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শম্ভু মিত্র সম্পূর্ণ করে এসেছেন তাঁর নাট্যজীবন"..
কেন জয় লিখছেন এই কথাগুলি, কাব্য ও সাহিত্য আলোচনা বিষয়ে তাঁর ভাষায় তাঁর 'শেষতম' বইতে? লেখালেখির দুনিয়ার রোশনাই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার সময়কালের এই লেখায় দিনান্তের প্রণামের স্বর অশ্রুত থাকছে না যে আর! একটি অনুপুঙ্খ সমালোচনা গ্রন্থকে আশ্রয় করে আসলে কথা বলছেন এক পঞ্চাশ বছর কবিতা অপরাধের সাথে লগ্ন থাকা এক স্বযশ কবির ভিতরভুবনের একলা "আমি"। 'কবিতা: অমৃতা' সমালোচনা গ্রন্থটি তাঁর সেই একলা আমিটির গভীর আবরণ। সেই আবরণের আধারে গ্যালিলিও- শম্ভুমিত্র আর্কেটাইপের শরীরে নিজেকেও করুণ সমর্পণে মিশিয়ে দিচ্ছেন জয়। আত্মমোক্ষণের এই পথে, অমৃতার কবিতার দুটি জায়গায় 'যক্ষ' শব্দটি ব্যবহারের সূত্রে বারবার তাঁর লেখায় আসছে সেই যক্ষপ্রতিমা, সেই প্রতিমা একটি সমালোচনা গ্রন্থে বুনে রাখছে কবিতার স্বর, বইয়ের উপান্তে, ১৬০ পাতায় জয় লিখছেন..
"নেশা যেন এক অপেক্ষমান যক্ষ এখানে ..."।
এই বইয়ে জয় অমৃতার রচনার কোনো কোনো শব্দ বা শব্দবন্ধকে ব্যবহার করেন তাঁর উড়ানবিন্দু (take off point) হিসেবে, তারপর চলতে থাকে সেই শব্দ বা সংকেতকে ব্যবহার করে তাঁর সবিস্তার কথকতা, আর কথকতার চলনের ভঙ্গিতেই কথার মোড় ঘুরে যায় এমন সব উল্লেখে বা ইশারায়, আমাদের মনে পড়ে যায় আধুনিক ইউরোপীয় সমালোচনাতত্ত্বের নিউ ক্রিটিসিসমের প্রবর্তক I.A .Richards-এর কথা, আমরা দেখতে থাকি 'আলোচ্য কবিতা' নয়, 'আলোচনা'টি নিজেই হয়ে ওঠে এক ধরণের 'text of tension', হয়ে ওঠে self referential বা আত্মইঙ্গিতময়।
"১৯৭৭ সালের পর থেকে আমি যতবার হাসপাতালে গেছি,শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করেছি, যতবার আমি নানাভাবে জীবনে অপমানিত হয়েছি, ততবার আমার মনে পড়েছে,"
লিখছেন জয়,
" Hear me,oh brooding night ,from whose womb I came for punishment .."

ইস্কাইলাসের 'ইউমেনিদাইস' নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের ট্র্যাজিক অস্তিত্বপরিসরের এই উল্লেখ প্রসঙ্গে আবার আসে শম্ভু মিত্রের নামোল্লেখ, চল্লিশ বছরকাল ধরে শম্ভু মিত্রের অভিনয়ের আলোয় জীবনকে দেখা, শম্ভু মিত্রের নাট্য নির্বাচনে যে বারেবারে কোণঠাসা, প্রান্তিকায়িত (marginalised) অসামান্য একক ব্যক্তিমানুষের যাপনযন্ত্রণা ও সাধনপিপাসার, সংকটের, সংঘাতের, সঙ্কল্পের অবিকল্প বয়ান উঠে আসে, তার সাথে ভগ্নস্বাস্থ্য, ত্যক্তজীবিকা, মুদ্রণবিছিন্ন তবু নিজের সাধনায় এই মুহূর্তে অবিচল জয়ের যে একাত্মীভবন সম্ভব হয়, তার চিন্হ ধারণ করে রাখে এই বই। ১৮৮৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র 'বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন' নামে একটি অনুজ্ঞাবাচক বয়ানে নবীন লেখকদের যশ ও অর্থের লোভ এবং, নিম্নরুচির মনোরঞ্জনের ফাঁদ সম্পর্কে সতর্ক করেন। তার ১৪০ বছর পর জয় এই বইইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণের পরিশেষে যুক্ত করছেন "বিধিসম্মত সতর্কীকরণ" নামে একটি রচনায়। অভিজ্ঞ শিক্ষকের সংবেদনা ফুটে ওঠে যখন জয় লেখেন, "...কবি ও লেখকের মনে যে আত্মসন্দেহ, নিজের কাজ নিয়ে যে আত্মপ্রশ্ন সদাজাগ্রত থাকা জরুরী---- সেই আত্মসন্দেহ প্রভূত বিজ্ঞাপনের মদিরায় নিমজ্জিত হয়ে প্রথমে নিষ্ক্রিয় পরে স্থবির হয়ে যায়। এ-ও একধরনের 'মার'।" এই 'মার' শব্দটি জয় নিচ্ছেন বুদ্ধজীবন থেকে, বোধিলাভের পথে তপস্যারত সিদ্ধার্থকে ধ্যানভ্রষ্ট করতে নানা প্রলোভন নিয়ে যে হাজির হয়েছিল, বুদ্ধজীবনকথায় তার নাম 'মার'। চার প্রজন্মের অনুজ একজন কবির কাব্য আলোচনা নিয়ে একটি ২২৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের শেষে এক প্রবীণ পূর্বজ কবি যখন এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন, তিনি তখন সমালোচকের নৈর্ব্যক্তিকতার দায়কে অতিক্রম করে যান, কাঁধে তুলে নেন অন্য এক ভার। কবির দায় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'তোমায় যজ্ঞে দিয়েছ ভার'। সেই ভার এক গুরুদায়িত্ব। নিজের কাজটি করে যাওয়ার দায়। নন্দিত হলেও দায়, নিন্দিত, লাঞ্ছিত হলেও দায়। নিন্দাঅপবাদে নির্মোহ থেকে রবীন্দ্রনাথও আমৃত্যু বহন করেছিলেন এই দায়ভার, নি:সঙ্গ অগ্রপথিকের মতো।
এই পূর্ণাঙ্গ সমালোচনাগ্রন্থে (অমৃতার কবিতায়' অগ্নি আমি' এই শব্দবন্ধের সূত্রে) এবং এর এক বছর আগে লেখা মুদ্রণজগৎ থেকে নিজের স্বেচ্ছানির্বাসন ঘোষণার সেই ক্ষীণাবয়ব পুস্তিকায় জয় মহাভারতে উল্লিখিত তিনটি অগ্নির কথা বলেন। মহাভারতের বনপর্বে যুধিষ্ঠিরকে অগ্নির সাথে পরিচয় করাবার সময় ঋষি বলেছিলেন, যে অগ্নি আশ্রম রক্ষা করেন তিনি বৈশ্বানর, যে অগ্নি নববধূর সাথে স্বামীগৃহে আসেন তিনি দক্ষিণ অগ্নি, আর যে অগ্নি আত্মাকে দহন করে প্রজ্জ্বলিত হন তিনি কবি। এই আত্মদহনেই তার মুক্তি। বাসনাহীন হওয়াই যদি নির্বাসনের উৎস অর্থ হয়, তবে পড়ে থাকে নিজেকে দগ্ধ করে নিজের জীবনকেই আহুতি দেবার সামর্থ্যটুকু চেয়ে নেবার।
ঋকবেদ যে সাগ্নিকতার কথা বলে, সারাটা জীবন ধরে যে আহুতি দিতে দিতে চলার কথা বলে, তার শেষ আহুতি অন্তেষ্টি। সেখানে আমার আহুতিঅক্ষম শরীরটিকে অগ্নিতে অর্পণ করেন আমার একান্ত স্বজন। কিন্তু কবির একান্ত স্বজন তো কবি নিজেই। তিনি নিজেই তো অগ্নিস্বরূপ। তাই জয়ের এই লেখা পড়তে পড়তে আমাদের রবীন্দ্রনাথের গান মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় তাঁর একটি চাওয়া, "বিশ্বধ্যাতার যজ্ঞশালায় আত্মহোমের বহ্নিজ্বালায় জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে!" যে গ্রন্থ শুধু কবিতার জন্য এই দহন বেছে নেবার কথা বলে, সেই গ্রন্থ ব্যক্তিকে অতিক্রম করে, উপলক্ষ্যকে অতিক্রম করে গাঢ় ইশারায় এক কবিতা অমৃতা হয়ে ওঠে না কি?

Whatsapp
