হাতে দু'দিনের ছুটি? জল-জঙ্গল-পাহাড় একসঙ্গে পেতে আসতেই হবে যে ঠিকানায়

Jhargram Offbeat Tour: গাডরাসিনি পাহাড়কে দেবী হিসেবে পুজো করেন স্থানীয়রা। অগ্রহায়ন মাসে বিরাট পুজো হয় এখানে। কঠিন পথেই এই পাহাড় শিখরে হাজির হন বহু মানুষ।

পায়ের তলায় সর্ষে। এখান থেকে ওখানে। রাত পোহালেই তেপান্তর। বোধ শুরুর প্রথম থেকেই একাধিক লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল ঘোরা। কিন্তু সময় আর কই! ছোটবেলায় পড়াশোনা, পরীক্ষা। ঘুরতে ভালোবাসা লোকটির কথা আর শোনে কে! বড় হয়েও একই কাণ্ড! সময়, সঙ্গে টাকা! ইচ্ছা আছে ষোলআনা, কিন্তু অর্থ কই? সেটাও একটু এল, সময় কই! যদিও সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুরতে তো আমি যাবই। বরাবর একাকীত্ব যাপনের অঙ্গীকারে ঘুরতে যাওয়া অভ্যাস। একটু সময় পেলেই উড়ে বেড়াতে ইচ্ছা করে নিরন্তর। এদিনও হল তাই। হাতে মাত্র দেড়দিন। তবুও মন চাইছে ঘুরতে। তবে যাব টা কোথায়? ব্যাগ গুছিয়ে প্ল্যান শুরু। আশেপাশের সবকিছু খতিয়ে দেখা সারা। কিছু পছন্দের, কিছু আবার নৈব নৈব চ! বাকি রইল কী! জল-জঙ্গল-পাহাড় সঙ্গে নির্জনতা! অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক হল, এবার তাহলে অন্য ঝাড়গ্রাম। মাওবাদী-আতঙ্ক সঙ্গে আবার হাতির ভয়! যদিও এখন সবটাই নিয়ন্ত্রণে। হাতিও নাকি প্রায় বিচ্ছিন্ন জঙ্গলে এত এত মানুষের ভয়ে!

একদিন আগেই ঝটপট কাটলাম ট্রেনের টিকিট। গুগল-বাবার দয়ায় কীভাবে ঘুরব, কী কী করব এসব বেশি ভাবতে হয় না আর। সঙ্গী আরও চার। রওনা দিলাম রাত থাকতেই। বাড়ি থেকে অনেক দূরে হাওড়া স্টেশন। বাকি চারজনও পৌঁছে গেছে সময় থাকতেই। সকাল-সকাল ট্রেন কু ঝিক ঝিক ছন্দে চলতে চলতেই চা থেকে বাদাম, লজেন্স- টপাটপ চলল মুখ। অবশেষে পাহাড়-জঙ্গলের শহর! কাল পর্যন্তও যা ছিল ধর্তব্যের বাইরে! ট্রেনে বসেই আমরা একটি রিসর্টের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিলাম থাকার জন্য।

আরও পড়ুন- দুর্গ, ইতিহাস আর বিলাস যেখানে মাখামাখি, এই শীতে ছুটির গন্তব্য হোক নীল শহর

স্টেশনে নেমেই রাজুদার পুরনো মারুতি গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে গেলাম জঙ্গলে ঘেরা রিসর্টে। খানিক ফ্রেশ হয়েই তিন বন্ধু ঘুরতে বেরোলাম আশপাশের জঙ্গলে, সে এক অন্য অনুভূতি। শাল, সেগুন, ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে রোদ! আঁকিবুকি কাটছে রূপকথারা। স্টেশনের ওই মারুতি গাড়িই ভাড়া করে নিলাম পুরো দিনের জন্য। গাড়ির চালক কাম গাইড দাদা অসাধারণ আলাপী। শুরু হল পথচলা। একে একে কনকদুর্গা মন্দির, প্রকৃতির মাঝে ডুলুং নদী- ঘুরতে যাওয়া মানে নিজস্ব-যাপন। খানিকটা নিজের মতো থাকা। ঠান্ডা জলের স্রোতের কুলুকুলু শব্দ, নির্জনতায় কাটল অনেকটা সময়।

এরপর চিল্কিগড়, রাজবাড়ি চত্বর, মন্দির- আরও কত কী! খানিকটা নিরাশ হয়েই ফিরতে হল সেখান থেকে। সমাজবিরোধীদের আখড়া আর অবহেলায় পড়ে থাকা ঐতিহ্য দেখে। ঘুরলাম, যাপন করলাম অনেক কিছু। কিন্তু খাব কী! স্থানীয়দের কথা মেনেই পৌঁছে গেলাম ঝাড়গ্রাম শহরের কনকদুর্গা হোটেলে। এখানে না এলে বড় মিস! সেখান থেকে ভূরিভোজ সেরে আবার রওনা। এবার গন্তব্য সাবিত্রী মন্দির, চিড়িয়াখানা বা ডিয়ার পার্ক, ট্রাইবাল মিউজিয়াম, কেন্দুয়া, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। সন্ধ্যা হতেই রিসর্টে ফেরা।

কনকদুর্গা মন্দির

কিন্তু সারাদিন যা দেখলাম সবকিছু ছাড়িয়ে গিয়েছিল ফেরার পথের একটি দৃশ্য। অন্ধকারের উজ্জ্বল আকাশ আর একঝাঁক তারা যেন তাড়া করছে আমাদের। যেন প্রতিমুহূর্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে এক ভিন্ন অনুভূতির কথকতা। লিখছে ভালো থাকার দৃষ্টান্ত। অবাক করা সেই দৃশ্য, চারিদিকে জঙ্গল, মাঝখানে রাস্তা আর খোলা ঝলমলে আকাশের তারা যেন এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাচ্ছে আমাদের। রাতে আর ঘুম কই! জীবনের সমস্ত গ্লানির অর্থযুক্ত বা অর্থহীন আলোচনা আর খুনসুটিতে কাটল গোটা রাত। সঙ্গে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। কপাল ভালো থাকলে নাকি হাতির ছোঁয়াও পাওয়া যায় রাতবিরেতে।

চিল্কিগড়

পরদিন সকাল সকাল রওনা। হাতে সময় বড্ড কম। এবারও সেই একই গাড়ি। শুধু চালক আলাদা। সকালের খেজুরের রস আর প্রাতরাশ সেরেই বেরিয়ে পড়লাম বেলপাহাড়ির উদ্দেশ্যে। রইল ঝোলা, চলল ভোলা! পাহাড়-জঙ্গলের হাতছানি সঙ্গে নিয়েই পৌঁছে গেলাম বেলপাহাড়ির খাঁদারানি হ্রদে। এখানে রয়েছে এক অন্য অনুভূতি। চারিদিকে পাহাড় আর মাঝখানে জলভর্তি হ্রদ। সে এক অসাধারণ দৃশ্য! এই হ্রদে নাকি জল খেতে আসেন গজরাজ! এরপর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পাহাড়ের মাঝখান থেকেই গেলাম গাডরাসিনি।

গাডরাসিনির অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম, পাহাড় চড়ার আগে যা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি আমরা! খাড়া পথ পেরিয়ে অনেক কষ্টে পৌঁছলাম বাসুদেব মন্দির। ভাবলাম এই বুঝি শেষ! কিন্তু কোথায় আর কী। ওই পাহাড়ি পথেও গুগল-বাবা জানিয়ে দিলেন এখানেই শেষ নয়, আছে আরও! এগিয়ে চলো বন্ধু।

বিরাট বিরাট পাথর আর খারাপ পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠতেই থাকলাম। চারিদিকে শুনসান। বহু উপর থেকে দেখছি শহর। সঙ্গে কাজ করছে মারাত্মক আতঙ্ক। যদি কিছু হয়ে যায়। এমন ভয় বহুদিন পরে পেয়েছিলাম আবার। একটু এধার-ওধার হলেই সোজা খাদ। এক জায়গায় গিয়ে হারালাম আমরা। সাপের আওয়াজ থেকে অজানা জন্তুর ডাক- অ্যাডভেঞ্চারের জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই মজুত সেখানে! অবশেষে শান্তি! একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় ছিলেন বাবা মোক্ষনাথ। অবিশ্বাস্যভাবে সেই মন্দিরে যখন আমরা পৌঁছলাম, সেখানে পুজো চলছিল। এক পুরোহিত খালি পায়ে ওই কঠিন পথ পেরিয়ে পুজো করতে আসেন রোজ। তাঁর মুখেই শুনেছিলাম ইতিহাস, জনশ্রুতি আর অভিজ্ঞতার কথা।

জানা যায়, গাডরাসিনি পাহাড়কে দেবী হিসেবে পুজো করেন স্থানীয়রা। অগ্রহায়ন মাসে বিরাট পুজো হয় এখানে। কঠিন পথেই এই পাহাড় শিখরে হাজির হন বহু মানুষ। এমনকী সন্ত্রাসের দিনেও নাকি এই পাহাড়ে আসেনি কোনও আঘাত! পুরোটাই দেবী গাডরাসিনির দয়ায় বলে দাবি স্থানীয়দের। সেখান থেকে গুহা, আরও কঠিন পথে রওনা দিয়ে সফল হলাম আমরা।

আরও পড়ুন- দিঘা-মন্দারমণি ফেল! এই ‘গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন’-ই এখন বাংলার সেরা উইকেন্ড ট্যুরিস্ট স্পট

এরপর তারাফেনি, ঢাঙ্গীকুসুম হয়ে লামাডিহি, বুড়িশোল জঙ্গল। কিষেনজির মৃত্যুস্থল। খানিকটা রহস্য, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা আর খাঁ খাঁ জঙ্গলের ফাঁকা রাস্তায় ছবি তুলে কাটিয়ে ফেললাম সারাটাদিন। ফিরতে হবে এবার। বিকেলের ট্রেনে ফিরলাম হাওড়া। উইকেন্ডের অন্যরকম অভিজ্ঞতা চাইলে চট করে ঘুরে আসাই যায় ঝাড়গ্রামে।

গিয়েছিলাম- হাওড়া থেকে সকাল ৬.৩৫ এর তিতলাগড় ইস্পাত এক্সপ্রেসে।

ফিরেছিলাম- ঝাড়গ্রাম থেকে বিকেল ৩.২৩-এর ওই একই ট্রেনে।

More Articles