ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে লড়াই কি এখানেই শেষ?

Brij Bhushan: তবে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ উঠেছিল, সাক্ষীদের প্রভাবিত করার বা প্রমান লোপাট করার চেষ্টা করছেন তিনি।

বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ তথা কুস্তি ফেডারেশনের প্রাক্তন সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিং-কে পকসো মামলা থেকে রেহাই দিল আদালত। জানা গিয়েছে, অভিযোগকারী এবং তাঁর বাবা স্বীকার করে নিয়েছেন, তাঁরা ভুয়ো অভিযোগ করেছেন। তাঁদের এই বয়ানের ভিত্তিতেই দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, এই মামলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। ইকোনমিক টাইমস-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গতবছর এক শুনানিতে অভিযোগকারী নিজে জানিয়েছিলেন, তদন্ত নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। এই মামলা যদি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তিনি তাঁর বিরোধিতা করবেন না। তবে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ উঠেছিল, সাক্ষীদের প্রভাবিত করার বা প্রমান লোপাট করার চেষ্টা করছেন তিনি। উল্লেখ্য, গত লোকসভা ভোটের আগে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে দিল্লির যন্তর মন্তর-এ দীর্ঘদিন প্রতিবাদ করেছিলেন কুস্তিগিরেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন- সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগট, বজরং পুনিয়ারা। বিজভূষণের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কারণে তাঁকে কুস্তি সংস্থার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরে ব্রিজভূষণেরই ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় সিং দায়িত্ব পান। যা নিয়ে আপত্তি ছিল কুস্তিগিরদের। এমন অবস্থায় গত বছর ২৪ ডিসেম্বর ভারতীয় কুস্তি সংস্থাকে সাসপেন্ড করেছিল কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রক। যদিও পরে তা তুলে নেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে কি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন বাহুবলী ব্রিজভূষণ?

ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে ৬ জন মহিলা কুস্তিগির  যৌন হেনস্থার অভিযোগ করেছিলেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে দিল্লি-পুলিশ চার্জশিট দাখিল করেছিল। অভিযোগকারীদের মধ্যে একজন নাবালিকাও ছিলেন। তার জন্য ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে পকসো ধারাতে মামলা করা হয়েছিল। আদালতে চার্জশিট দেওয়ার সময়েই পকসো মামলাটির বাতিলের আর্জি জানিয়ে আদালতে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল দিল্লি পুলিশ। এ বিষয়ে অভিযোগকারী নাবালিকা এবং তাঁর পিতাকে নোটিস দিয়েছিল আদালত। এই নিয়ে তাঁদের জবাব জানতে চাওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালের অগস্ট মাসে তাঁরা সশরীরে হাজিরাও দিয়েছিলেন। এখন প্রতিবেদনে দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, ওই অভিযোগকারী নাবালিকা এবং তাঁর বাবার বক্তব্যের ভিত্তিতেই মামলাটি বাতিল করার অনুরোধ করা হয়েছে।

কিন্তু ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে এই মামলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এরপর সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্টেও লড়া যেতে পারে। কারণ, ২০২৪ সালের মে মাসে, দিল্লির রাউজ অ্যাভিনিউ আদালত এই মামলায় পর্যাপ্ত প্রমাণ দেখে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে চার্টশিট তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিল। প্রধান মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (এসএমএম) প্রিয়াঙ্কা রাজপুত ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে আইপিসি-র ধারা ৩৫৪ (মহিলার মর্যাদায় আঘাত করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ বা অপরাধ মূলক বল), ৩৫৪-এ (যৌন নির্যাতন), এবং (অপরাধমূলক হুমকি) এর অধীনে অভিযোগ দায়ের করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিচারক বলেছিলেন যে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিষয়টি যেমন বিদেশে টুর্নামেন্ট চলাকালীন হয়েছে, তেমনই ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান দফতর, ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর আবাস-এও হয়েছে বলে অভিযোগ। এমনটাও অভিযোগ রয়েছে যে, প্রথমে দিল্লি পুলিশ এফআইআর দায়ের করেনি, বাধ্য হয়ে কুস্তিগীররা সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন। শীর্ষ আদালতের নির্দেশের পর এফআইআর দায়ের করেছে পুলিশ। আন্তজার্তিক অলিম্পিক্স কমিটি, আইওসি ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হেনস্থার অভিযোগগুলির নিরপেক্ষ তদন্তও দাবি করেছিল।

গত লোকসভা ভোটের আগে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দিল্লির যন্তর মন্তর-এ দীর্ঘদিন যে প্রতিবাদ করেছিলেন কুস্তিগিরেরা, সে সময়ও দীর্ঘ দিন পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ। শেষে বাধ্য হয়ে যন্তর মন্তরে টানা ৪০ দিন ধর্না করেন বজরং, সাক্ষীরা। তখন এই পুরো ঘটনায় দেশের ক্রীড়া মন্ত্রী কোনো বয়ান দেননি। নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধনের দিন আন্দোলনরত কুস্তিগীরদের মিছিল পুলিশ আটকে দেয়, তারপর মাটিতে ফেলে, চ্যাংদোলা করে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। এরপর আবার ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর, জাতীয় কুস্তি সংস্থার নির্বাচনে জয় লাভ করে ব্রিজভূষণের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সঞ্জয় সিং, যা প্রতিবেদনের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেই ক্ষোভে কুস্তি থেকে অবসর নেয় ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিক্সে পদকজয়ী প্রথম মহিলা প্রাক্তন কুস্তিগীর সাক্ষী মল্লিক। যন্তর মন্তরে আন্দোলনের সময় এই সাক্ষী-কেই টেনেহিঁচড়ে প্রিজন ভ্যানেও তোলা হয়েছিল। সে সময় হরিদ্বারে গঙ্গার জলে পদক ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। নারী কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা এবং আন্তর্জাতিক স্তরের খেলোয়াড়দের প্রতিবাদের পর কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে ছিল বিজেপি সরকার।

১২ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন ব্রিজভূষণ। এর পর যখন ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন সঞ্জয় সিং, সে সময় অনেকেই বলেছিলেন, জিতলেন ব্রিজভূষণই। কারণ, তিনি ব্রিজভূষণেরই ঘনিষ্ঠ এবং ব্যবসার অংশীদার। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর ব্রিজভূষণই কেন্দ্রীয় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন, "যাঁদের ভোটের ফলে শিক্ষা নেওয়ার, তাঁরা নিক! কুস্তিতে তাঁদের দাপট ছিল এবং আগামীতেও থাকবে। এটি সমস্ত দেশের পালয়ানদের জয়।" প্রশ্ন উঠেছিল, যাঁর জন্য অলিম্পিক্স পদকজয়ীদের ঘাড় ধরে প্রিজন ভ্যানে তোলা হলো, যাঁর জন্য হরিদ্বারে গঙ্গার জলে পদক ভাসিয়ে দিতে গেলেন কুস্তিগিরেরা তাঁরই ঘনিষ্ঠ কে ক্ষমতায় বসানো দেশের পালয়নদের জয় হতে পারে? শেষে সাক্ষী বলেছিলেন, আর কখনও মাঠে নামবেন না। এই নিয়ে ব্রিজভূষণ থেকে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে, তিনি সাংবাদিকদের বলেন- "তাই নাকি? কী জানি! এর সঙ্গে আমার কি যোগাযোগ আছে?"

গুজরাত দাঙ্গায় বিলকিস বানোর ধর্ষক এবং পরিবারের ১৪ জন সদস্যকে খুনে ১১ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে মুক্তি দিয়েছে সে রাজ্যের বিজেপি সরকার। গুজরাটের বিজেপি সরকার তাদের মালা পরিয়ে বরণ  করেছিল। অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই কিন্তু ওই রেমিশনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিলমোহর দিয়েছিল। পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস জাতীয় প্রেসিডেন্ট কবিতা শ্রীবাস্তব বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে গুজরাত সরকারের সঙ্গে অপরাধীদের যোগসাজশ ছিল। যদি গুজরাট সরকার বিলকিস বানোর জন্য ন্যায় বিচার চাইত, সুপ্রিম কোর্টের কাছে তার আগের রায়ের বিষয়ে জানতে চাইতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে গুজরাত সরকারের সঙ্গে দোষীদের মধ্যে যোগসাজশ ছিল।”

More Articles