ব্যাটের অভাবে স্পিন শিখেছিলেন,বড় সুযোগের অপেক্ষায় বাংলার ছেলে করণ
Karan Lal rises as Bengal’s new power-hitter : করণ বাংলার প্রথম ক্রিকেটার যিনি সমকালীন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রিকেট খেলছেন। নিজেকে মেলে ধরতে পারলে এবং আরও রান করলে হয়তো অনেক বড়ো জায়গার দরজা খুলে যাবে তা...
বিগত কয়েক বছরে বাংলার ক্রিকেটের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন তাদের কাছে করণ লাল নামটা নতুন নয়। রাজ্য দলের হয়ে নিজের কেরিয়ারের শুরুতে তেমন সাফল্য না পেলেও শেষ কয়েক বছরে ছোট ফরম্যাটে তিনি বাংলার সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম।
বছর চারেক আগের কথা। বাংলার হয়ে সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে অভিষেক হয় একটা ছিপছিপে চেহারার জুনিয়র ক্রিকেটারের। তখন ভারতীয় অনুর্ধ-১৯ দলের হয়ে চ্যালেঞ্জার ট্রফি খেলে সদ্য এসেছেন তিনি এবং বাংলার ক্রিকেট সাৰ্কিটে তখন তিনি বেশ পরিচিতি পেয়েছেন "ইন্ডিয়া মেটেরিয়াল" হিসেবে। কিন্তু সেই সময়টা অন্যরকম। তখন স্কিলসেটের বিচারে বেশ পিছিয়ে খড়্গপুরের এই যুবক। হাতে একটা ব্যাকফুট পাঞ্চ ছাড়া আর তেমন কোনো বলার মতো শট নেই। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো অত্যুক্তি মনে হওয়াই দস্তুর এবং পারফরমেন্স উচ্চমানের না হওয়া সেই দস্তুরতার মাত্রা বাড়িয়ে ব্যাপারটাকে যে আকাশছোঁয়া করে তা বলা বাতুলতা।

করণ বুঝেছিলেন নিজের উন্নতির জন্য তাকে প্রচুর শট তৈরি করতে হবে
সেই সময় সাদা বলের ক্রিকেটে সাধারণ মানের পারফরমেন্স তাঁকে পিছিয়ে দিয়েছিলো বেশ কিছুটা। লাল বলের ক্রিকেটেও ফল ছিল না আশানুরূপ। লোয়ার অর্ডারে রান না পেলে ওপেনিং করতে পাঠানো হয় তাঁকে। স্বভাবতই ওপেনিংয়ে নতুন বল সামলে রান করতে ব্যর্থ হন তিনি এবং বাদ পড়েন রঞ্জি দল থেকে।
কেরিয়ারের প্রথম দুই বছর সাদামাটা গেলে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিজেই নেন করণ লাল। যেকোনো ক্রিকেটার বা কোনো পেশাদারের উন্নতির শিখরে পৌঁছনোর একমাত্র রাস্তা হলো নিজেকে ভেঙেচুরে তৈরি করা এবং সময়ের চাহিদা বুঝে সাধারণের থেকে এগিয়ে থাকার জন্য যতটা প্রচেষ্টা প্রয়োজন ততটা করা। করণ বুঝেছিলেন নিজের উন্নতির জন্য তাকে প্রচুর শট তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ বর্তমান টিটোয়েন্টি ক্রিকেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে ধরণের শট হাতে রাখা প্রয়োজন তা করতে হবে তাঁকে। সেই মতো নিজের হাতে আনলেন রিভার্স সুইপ, সুইচ হিট ইত্যাদি অত্যাধুনিক শট, বাড়ালেন নিজের ডাউন দ্য গ্রাউন্ড রেঞ্জ এবং ফলাফলও পেলেন সরাসরি। ২০২৪-২৫ মরশুমের সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফিতে রান সংগ্রাহকদের লিস্টে ৩৩৮ রান নিয়ে পঞ্চম স্থানে শেষ করেন করণ। মেরেছিলেন মোট ১৮টি ছক্কা।
আরও পড়ুন:দ্রাবিড় শিখিয়েছেন: যত্ন করে হারতে শেখাটাও জরুরি
কিন্তু ক্রিকেটজীবনের শুরুর দিন থেকে তাঁর যাত্রা সহজ ছিল না। খড়্গপুরের একটি স্কুলে ক্লারিক্যাল চাকরি করতেন বাবা। দুই দিদি ছিলেন পড়াশোনায় তুখোড়। অন্য মধ্যবিত্ত বাবার মতোই করণের বাবাও চাইতেন ছেলে পড়াশোনায় ভালো হয়ে একটা গোছানো কেরিয়ার তৈরী করুক। কিন্তু ২০১১ সালে ঘটে এক দুর্ভাগ্যের ঘটনা। হঠাৎই মৃত্যু হয় করণের বাবার। তিনি বাড়ির একমাত্র রোজগেরে হওয়ায় অথৈ জলে পারেন করণরা। পাশাপাশি বাবা খুব কাছের মানুষ হওয়ায় করণ মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েন। তবে মা প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি। তিনি পরের বছর করণকে নিয়ে যান কোচিং সেন্টারে। সেখানেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় তার।

সেখান থেকে সিএবির হয়ে জুনিয়র স্তরে প্রথম ম্যাচ। সেখানে করণ পেয়েছিলেন মৈনাক সেনগুপ্ত, প্রণব নন্দীর মতো কোচের সান্নিধ্য। তাঁরা দুজনেই নিজের স্বাভাবিক খেলায় ফোকাস করাকে মূলমন্ত্র করেছিলেন এবং সেইখান থেকেই প্রথম ভারতীয় অনুর্ধ-১৯ দলে ডাক পাওয়া।
তবে সেই করণের সঙ্গে আজকের করণের পার্থক্য প্রায় আকাশ-পাতাল। আজকের করণ নিজের যোগ্যতায় ছাপিয়ে গিয়েছেন সব বাধা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শেষ দুটো বছরের মুস্তাক আলী ট্রফি মিলিয়ে মেরেছেন মোট ৩৩টি ছক্কা। চলতি বছরের বেঙ্গল প্রিমিয়ার লিগে তিনি হয়েছেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, মেরেছেন সর্বোচ্চ ছক্কাও। বাংলার হয়ে একটা কঠিন ম্যাচে রয়েছে ম্যাচ জেতানো শতরান, রয়েছে একটি ঝকঝকে ৯৪ এবং আরো অনেক ঝোড়ো ইনিংস সূচনা যা দিয়ে ম্যাচে একটা 'আর্লি অ্যাডভান্টেজ' পেয়েছে বাংলা।
আরও পড়ুন: রাজার মুকুট রাজার সাজ, রাঁচিতে রাজাই পরলেন আজ
কীভাবে দিনের পর দিন নিজেকে ভেঙেচুরে তৈরি করেছেন করণ? নিজেই বলেছেন তিনি সেই কথা। প্র্যাক্টিসে একশোটি ছক্কা প্রতিনিয়ত মারার চেষ্টা করেন করণ। এর ফলে যেমন রেঞ্জ হিটিংয়ের অভ্যাস হয়, তেমনই মাসল মেমোরিতে ব্যাপারটা চলে আসে। ফলে যে কোনো ভালো বোলিংয়ের বিরুদ্ধে ছক্কা মারা বা বড়ো রান করা সহজ হয়ে যায়। সদ্য হিমাচল প্রদেশ ম্যাচে একটি ইনিংসে ১০টি ছক্কা মেরেছেন করণ, যা সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফির ইতিহাসে বাংলার কোনো ব্যাটারের একটি ইনিংসে সর্বোচ্চ।
ছোট থেকে করণের পছন্দ ছিল ব্যাটিং। তবে বাবার মৃত্যু এবং আর্থিক সমস্যার জন্য ব্যাটিংয়ের উপযোগী কিটব্যাগ না থাকায় অ্যাকাডেমিতে স্পিন বোলিং করণের হাতের পাঁচ দাঁড়ায়। কিছুদিন পর তার মা টাকা জমিয়ে ব্যাট এবং অন্যান্য সরঞ্জাম কিনে দিলে তখন ব্যাটিংয়ে মনোনিবেশ করেন করণ। সেই যে স্পিন বোলিং শুরু করেছিলেন সেই অভ্যেস তিনি কাজে লাগিয়েছেন পরবর্তী কেরিয়ারেও। বরিশার হয়ে ক্লাব ক্রিকেটে স্পিন বোলিং করে বেশ কিছু উইকেট পেয়েছেন করণ। তবে বাংলার হয়ে এখনও তাঁর বোলিং মুনসিয়ানা দেখানো বাকি। যে কোনো সময়ে তার বোলিং-য়ের টার্ন এবং উইকেট থেকে বাউন্স পাওয়ার ক্ষমতা তাকে দলের একজন নির্ভরযোগ্য বোলার হিসেবে তৈরি করতে পারে।

আইপিএলের দরজায় দাঁড়িয়ে বাংলার নতুন তারকা করণ লাল
সামনেই আইপিএল নিলাম। সেখানে বাংলা থেকে শর্টলিস্ট হওয়া আটজন ক্রিকেটারের একজন করণ। এর মধ্যে নভেম্বরে কলকাতা নাইট রাইডার্স ক্যাম্পে ভালো করেছেন করণ। একটা প্র্যাক্টিস ক্যাম্পে ব্যাট হাতে ৫২ রান এবং রাহুল ত্রিপাঠির মতো বড়ো ব্যাটারের উইকেট পেয়েছেন করণ। আপাতত তিনি আরসিবি ক্যাম্পে। মাত্র দু'দিনের মধ্যেই নিলাম এবং পছন্দ হলে কোনো একটা দল তাঁকে নির্বাচন করতেই পারে।
আরও পড়ুন:বিশ্বকাপ নয়, গলি ক্রিকেটেই লুকিয়ে দেশের প্রাণভোমরা
এর আগে বাংলার কোনো ক্রিকেটার নিলামে উঠলে হয়তো তাকে নিয়ে আশার মাত্রা এতটা হতো না। হয়তো তাঁর সক্ষমতা নিয়ে কথা হতো বিভিন্ন মহলে তবে করণ নিজের ক্ষমতা এবং পারফরমেন্সকে সমান লাইনে এনে নিজের দাবি বাড়িয়েছেন। করণ বাংলার প্রথম ক্রিকেটার যিনি সমকালীন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রিকেট খেলছেন। নিজেকে মেলে ধরতে পারলে এবং আরও রান করলে হয়তো অনেক বড়ো জায়গার দরজা খুলে যাবে তাঁর জন্য।
Whatsapp
