ভারতে কি জনগণের ভোটে সরকার গড়া হয়?

Vote Manipulation HIstory Of India: কিন্তু যার নির্বাচনী কারচুপি বন্ধ করার কথা, তার বিরুদ্ধেই যদি সরকারের হয়ে ভোট চুরির অভিযোগ ওঠে, তখন তা আশঙ্কার জন্ম দেয়।

‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’– ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই প্রবাদটি এখন খুবই প্রাসঙ্গিক। দেশের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলগুলি প্রায়শই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিজেদের সুবিধামতো প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, এ ব্যাপারে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকারের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। আবার এই দলই যখন বিরোধী আসনে বসে, তখন ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ তোলে। বর্তমানে দেশের ক্ষমতায় বিজেপি, তাদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রতিনিয়ত ভোট চুরির অভিযোগ আনছে। আবার কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, বিজেপিও তখন তাদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনেছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও একই ছবি দেখা যায়- তৃণমূল কংগ্রেস যখন বিরোধী দল হিসেবে ছিল, তখন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ভোট কারচুপির অভিযোগ করত। এখন তারা ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যে ভোট চুরিকে ‘শিল্প’-এর পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অথচ এরাই দিল্লিতে গিয়ে বিজেপিকে 'ভোট চোর' বলে আক্রমণ করছে। রাজনৈতিক দলগুলির এই দ্বিমুখী আচরণ ভারতীয় গণতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।

ভোট কারচুপির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভোট কারচুপির অভিযোগ বহু পুরনো এবং চলমান বিতর্ক। এই বিতর্কে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি একে অপরকে দোষারোপ করে আসছে। সম্প্রতি, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী কর্ণাটক, গুজরাত এবং বিহারে ভোট জালিয়াতির একাধিক অভিযোগ এনেছেন। তিনি দাবি করেন, বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির জয় ভোট চুরির কারণে। এই চুরিতে পাঁচটি ভিন্ন উপায়ের প্রমাণ মিলেছে। যার মধ্যে ১২ হাজার ডুপ্লিকেট এবং ৪০ হাজার ভুয়ো ভোটারের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। একইভাবে, গুজরাট কংগ্রেসের সভাপতি অমিত চাভড়া দাবি করেছেন, নবসারি লোকসভা কেন্দ্রে প্রায় ৩০ হাজার ভুয়ো ভোটার রয়েছে।

রাহুল গান্ধী আরও অভিযোগ করেন, বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ‘বিশেষ নিবিড় পুনর্গঠন’ (এসআইআর) প্রক্রিয়ার নামে ভোটার তালিকা থেকে প্রকৃত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। এর পরিবর্তে ভুয়ো নাম যোগ করে ভোট চুরির চেষ্টা চলছে। তিনি এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং দরিদ্র মানুষের ভোটাধিকার রক্ষার উপর জোর দিয়েছেন। সম্প্রতি আবার 'হাইড্রোজেন বোমা' ফাটানোর কথা বলে বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশের ইঙ্গিত দেন তিনি।

রাহুল গান্ধীর এই হুমকির পরপরই বিজেপি পাল্টা আক্রমণ করে। বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খের-এর বিরুদ্ধে দুটি ভোটার কার্ড ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন। বিজেপি তাদের এক্স হ্যান্ডেলে একটি ইনফোগ্রাফিক পোস্ট করে কংগ্রেসকে “নির্বাচনী জালিয়াতির জননী” আখ্যা দিয়েছে। সেখানে ১৯৫২ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একাধিক নির্বাচনী কারচুপির কথা তুলে ধরেছে। এর মধ্যে ১৯৫২ সালে ড. বি. আর. আম্বেদকরকে পরাজিত করার জন্য কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের ‘যোগসাজশ’, ১৯৫৭ সালে বিহারের বেগুসরাইয়ে প্রথম ‘বুথ ক্যাপচারিং’-এর ঘটনা, এবং ১৯৬৭ সালে জম্মু ও কাশ্মীর নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীদের 'মনোনয়ন বাতিল' করে ৬১টি আসনে কংগ্রেসের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভের অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, বিজেপি আরও দাবি করেছে যে ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী রায়বেরেলি লোকসভা আসনে কারচুপি করে জিতেছিলেন, যা জরুরি অবস্থার কারণ হয়েছিল। বিজেপির এই ঐতিহাসিক অভিযোগগুলি থেকে পরিষ্কার ভোট চুরিতে কংগ্রেসও সমান দক্ষ।

আরও পড়ুন- মোদিকে সিংহাসনে রাখতেই জাল ভোটার তালিকা?

ভোট চুরির এই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে একটি বিষয় পরিষ্কার- ভোট চুরি নতুন কিছু নয়, আগেও ছিল এবং এখনও আছে। শুধু বিতর্কটা নতুন করে মাথা চাড়া দিয়েছে। “ভোট চুরি" বা “নির্বাচনী জালিয়াতি” শুধু বুথ দখল বা রিগিং নয়। এটি ভোটার তালিকা থেকে ঠিক নাম বাদ দেওয়া, ভুয়ো নাম যোগ করা, কারচুপি এবং রাজনৈতিক দুর্নীতির মতো সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াকেও বোঝায়। এককথায়, মানুষের রায় পাল্টে দেওয়ার যেকোনো অপচেষ্টাই ভোট কারচুপি।

স্বাধীন ভারতে এই ভোট কারচুপির কৌশল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে

পেশিশক্তির যুগ (১৯৫০-১৯৮০): এই সময়কালে কাগজের ব্যালট পেপার ব্যবহৃত হত এবং কারচুপির প্রধান কৌশল ছিল বুথ দখল ও ব্যালট বাক্স ভরা।

প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার (১৯৭০-এর দশক): এই সময় শাসক দল সরকারি কর্মচারী এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাকে নিজেদের নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করত। ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল সংক্রান্ত এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের একটি বড় উদাহরণ।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কারচুপি (১৯৮০-২০০০): এই যুগে কারচুপির কৌশল আরও সূক্ষ্ম ও মনস্তাত্ত্বিক রূপ ধারণ করে। সরাসরি বুথ দখলের পরিবর্তে ভোটারদের মনে ভয় ঢুকিয়ে এবং বিরোধী দলের এজেন্টদের তাড়িয়ে দিয়ে ফলাফল প্রভাবিত করা হত। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে এই ধরনের কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল।

১৯৭২ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনকে ভারতের নির্বাচনী কারচুপির ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে দেখা হয়। বামফ্রন্ট এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলির অভিযোগ ছিল যে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটারদের হুমকি এবং কারচুপির মাধ্যমে কংগ্রেস নিরঙ্কুস সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। অন্যদিকে, ১৯৮৭ সালের জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভা নির্বাচনে জালিয়াতি, বিদ্রোহের জন্ম দেয়। এই ঐতিহাসিক অভিযোগগুলি প্রমাণ করে যে, নির্বাচনী কারচুপি কেবল বুথ দখল বা রিগিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক দুর্নীতির একটি জটিল রূপ।

ভোট কারচুপি রুখতে প্রযুক্তি: ব্যালট থেকে ইভিএম

ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন (১৯৫১-৫২) থেকে কাগজের ব্যালট পেপার ব্যবহার করে ভোট নেওয়া হত। এই পদ্ধতিটি শুধু ব্যয়বহুলই ছিল না, এর কারণে বুথ দখল এবং ব্যালট বাক্সে কারচুপির মতো বড় ধরনের ভোট জালিয়াতিও ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এই সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর ব্যবহারকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয় এবং ২০০৪ সাল থেকে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনে এটির ব্যবহার শুরু হয়। ইভিএম আসার ফলে বুথ দখলের মতো পুরনো জালিয়াতির উপায়গুলি অকেজো হয়ে পড়ে, যা ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন বলে ধরা হয়।

তবে, ইভিএম-এর স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি প্রায়শই অভিযোগ করে যে ইভিএম হ্যাক করে বা টেম্পার করে ফলাফল প্রভাবিত করা হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান-এর একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ইভিএমে যদি কেউ সরাসরি শারীরিকভাবে হাত দেওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে সেটির ভেতরের একটি ছোট যন্ত্রাংশ বা চিপ পরিবর্তন করে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব। ভারতীয় কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হরি প্রসাদও একই ধরনের অভিযোগ করে বলেছেন, মেশিনের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তির দ্বারা কারচুপি করা সম্ভব। তাই ইভিএমের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য সুব্রামানিয়াম স্বামী একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন, যার ফলস্বরূপ ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভোটার-ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপাট) ব্যবস্থা চালু হয় এবং ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে সারা দেশের বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।

নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে টি.এন. শেষনের কথা অবশ্যই বলতে হয়। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তিনি ১০০টিরও বেশি নির্বাচনী অনিয়ম চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেন। তিনি ভোটারদের জন্য পরিচয়পত্র চালু করেন এবং নির্বাচনী ব্যয়সীমা কঠোরভাবে নির্ধারণ করেন। তাঁর দৃঢ় পদক্ষেপগুলি সেই সময় নির্বাচন কমিশনকে একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা করে। যদিও রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিজেদের মতো করে ভোট চুরির নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করছে।

ভোট কারচুপির নতুন অস্ত্র: অর্থ ও প্রযুক্তি

একবিংশ শতাব্দীতে নির্বাচনী কারচুপির কৌশল পুরোপুরি বদলে গেছে। এখন পেশিশক্তির জায়গা নিয়েছে অর্থ ও প্রযুক্তি। আর্থিক কারচুপির প্রধান দিক হল রাজনৈতিক ঘুষ বা ‘ক্যাশ ফর ভোটস’। যেখানে সাংসদ ও বিধায়কদের অর্থ দিয়ে সমর্থন কেনা হয়, যা ২০০৮ সালের আস্থা ভোটের সময় জাতীয় স্তরে আলোড়ন ফেলেছিল। এছাড়া, ভুয়ো ভোটারের নাম যুক্ত করা বা বিরোধী দলের সমর্থকদের নাম বাদ দেওয়ার মতো প্রশাসনিক কৌশলও ব্যবহৃত হচ্ছে।

ইভিএম আসার পর শারীরিক জালিয়াতি কমলেও, ডিজিটাল মাধ্যমের উত্থান নতুন ধরনের সমস্যার জন্ম দিয়েছে। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনকে “প্রথম হোয়াটসঅ্যাপ নির্বাচন” বলা হয়, কারণ ভুয়া খবর ও গুজব ছড়াতে এই মাধ্যমটি ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ডিপফেক-এর মতো প্রযুক্তি এই চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়েছে, যা জনগণের মতামতকে সূক্ষ্মভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ৪৪%-এর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। ‘অস্বীকৃত’ রাজনৈতিক দলগুলির (আরইউপিপিএস) আয়ের ৯৪% আসে অজানা উৎস থেকে, যা দিয়ে তারা ফৌজদারি মামলাযুক্ত প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় মেটায়। এই অবৈধ টাকা বা ‘স্ল্যাশ মানি’ ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য এক নতুন ও জটিল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

নির্বাচনী হিংসা: গণতন্ত্রের উপর আঘাত

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল জনগণের মতামতের সঠিক প্রতিফলন। কিন্তু যখন সেই মতামতকে ছাপিয়ে ভোট চুরি বা ভোট জালিয়াতি প্রাধান্য পায়, তখন গণতন্ত্রের পবিত্রতা নষ্ট হয়। এই জালিয়াতির সবচেয়ে করুণ পরিণতি হল নিরপরাধ মানুষের জীবনহানি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বিহারে ১৯৮৯ সালের ভাগলপুর দাঙ্গা বা ১৯৯৭ সালের লক্ষ্মণপুর বাথে গণহত্যার মতো ঘটনাগুলি আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতির উদাহরণ। ২০১৯ সালে অন্ধ্র প্রদেশে তেলেগু দেশম পার্টি এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে চারজনের প্রাণহানি হয়।

আরও পড়ুন- মোদির পাখির চোখ সিঁদুর! দুর্নীতির ইস্যু নিয়ে মাথাব্যথা নেই?

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী হিংসার ইতিহাস দীর্ঘ। বামফ্রন্ট শাসনকালে ‘বৈজ্ঞানিক কারচুপি’র নামে বুথ দখল ও ভোটারদের হুমকির অভিযোগ ছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ডেরেক ও’ ব্রায়েন দাবি করেছিলেন, ১৯৯০-এর দশকে রাজনৈতিক হিংসায় প্রায় ৪০০ জন নিহত হন। ২০০০ সালে নান্নুরে তৃণমূলের ১১ জন ভূমিহীন কৃষককে হত্যার ঘটনাটিও এর অন্যতম উদাহরণ।

২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক হিংসার ধরন আরও ‘স্থায়ী’ এবং ‘কাঠামোগত’ হয়েছে, অর্থাৎ এটি এখন আর কোনো নির্দিষ্ট নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মোট ৩০ জন এবং ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ২৭ জন নিহত হন। সর্বশেষ, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল সবচেয়ে বেশি হিংসাপূর্ণ, যেখানে মোট মৃতের সংখ্যা ছিল ৪৮ জন। এই পরিসংখ্যানগুলি থেকে বোঝা যায়, ভোট চুরি করতে গিয়ে নির্বাচনী হিংসা এখন শাসক এবং বিরোধী দলগুলির মধ্যে এক তীব্র সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে।

ভারতে নির্বাচনী কারচুপির দীর্ঘ ইতিহাস থেকে বলা যায়, ব্যালট পেপারের যুগ থেকে ইভিএম-এর যুগে, ভোট চুরির ধরন বদলেছে কিন্তু মূল লক্ষ্য একই রয়েছে, যেভাবে হোক ভোটের ফলাফল নিজেদের পক্ষে এনে ক্ষমতা দখল করা। তবে নির্বাচনী অনিয়মের এই প্রবণতাগুলি গণতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। কখনও কখনও মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। দেশের নির্বাচন কমিশন, সুপ্রিম কোর্ট এবং নাগরিক সমাজের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া অনেকটাই স্বচ্ছ ও শক্তিশালী হয়েছিল। কিন্তু যার নির্বাচনী কারচুপি বন্ধ করার কথা, তার বিরুদ্ধেই যদি সরকারের হয়ে ভোট চুরির অভিযোগ ওঠে, তখন তা আশঙ্কার জন্ম দেয়। এখনও অনেক কাজ বাকি। তাই গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ সুস্থ ও কার্যকর রাখার জন্য অর্থ, পেশিশক্তি এবং ডিজিটাল মাধ্যমে ভোট চুরির বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনী সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যতে এই নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই ভারতের ‘গণতন্ত্র’-কে তার মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করতে হবে।

More Articles