রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকে অপমান, ব্রহ্মচারী অমোঘ লীলাকে যে 'শিক্ষা' দিচ্ছে ইস্কন
Amogh Lila Prabhu, ISKON: দিন কয়েক আগেই অমোঘ লীলার একটি ভিডিও সামনে আসে, যেখানে তাঁকে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের বেশ কিছু বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা করতে দেখা যায়।
ফেসবুক, ইউটিউবের মতো মাধ্যমে একটু খুঁজলেই মিলবে একাধিক অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও। যাকে আমরা সহজ শব্দে বলি মোটিভেশনাল স্পিচ। আগে গুরুর মন্ত্র পেতে মঠ, আশ্রমের ইত্যাদি প্রভৃতির ঠাঁই লাগত। নেটমাধ্যমের সৌজন্যে সেসব এখন অতীত। ঘরে বসেই মিলতে পারেন জীবনকে দিশা দেখানোর মন্ত্র। 'জীবনের মানে কী?' 'কী কী করলে খুলে যাবে ঐশ্বরিক সৌভাগ্য' বা 'কী কী না করলে অপ্রসন্ন হবেন ভাগ্যদেবতা', সব কিছুরই সুলুক সন্ধান দিতে পারে এখন সোশ্যাল মিডিয়া। প্রযুক্তির জেরে ভক্তেরা যেমন ঘরে বসে গুরুমন্ত্র পাচ্ছেন, গুরুরাও তেমনই পৌঁছে যাচ্ছেন ঘরে ঘরে। তাতে তাঁর ধর্ম বা নীতি প্রচার যেমন হচ্ছে, খুলে যাচ্ছে রুজির পথও। ইউটিউব বা ফেসবুকের মতো মাধ্য়মে যে ভিউয়ের সঙ্গে রোজগারের একটা সহজ সমানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে, তা কে না জানে।
আরও পড়ুন: ইস্কন : কৃষ্ণচর্চা নাকি স্রেফ ধর্মব্যবসা? জানুন আসল সত্য
তবে এই সোশ্যাল মিডিয়ার একটি সমস্যাও রয়েছে। যে কোনও কিছুই মগজে এবং স্মরণে প্রমাণ-সহ রেখে দেয় সোশ্যাল মিডিয়া। ফলে সেখানে একবার বেফাঁস কিছু বলে ফেললে বা করে ফেললেই মহা ফাঁপড়। কে কোথায় তার প্রমাণ সংগ্রহ করে বসে থাকবেন, তা বলা মুশকিল। আর এমনই বেফাঁস কথা বলে বিপদে পড়লেন অমোঘ লীলা প্রভু নামে এক ইসকনের সন্ন্যাসী।
সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো জনপ্রিয় মুখ অমোঘলীলা। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের মোটিভেশনাল ভিডিও নিয়ে সামনে আসেন তিনি। জীবন কী? জীবনে বাঁচার সহজ পন্থা কী? কোন বিশ্বাসে মিলবে মোক্ষ, এমন নানা কিছু নিয়েই কথা বলে থাকেন এই সন্ন্যাসী। দিন কয়েক আগেই অমোঘ লীলার একটি ভিডিও সামনে আসে, যেখানে তাঁকে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের বেশ কিছু বক্তব্যের সরাসরি বিরোধিতা করতে দেখা যায়। বিষয়টি ভাইরাল হতে দেরি হয়নি।
গুরুমত, মতাদর্শের বাইরে গিয়ে রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ এমন দু'টি নাম, যার সঙ্গে মানুষের শ্রদ্ধা এবং আবেগ জড়িয়ে আছে। ফলে নবীন ব্রহ্মচারীর এই সমালোচনা অনেকেই ভালো চোখে নেননি। স্বাভাবিক ভাবেই খাপও বসে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। অমোঘলীলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও ওঠে।
এ দেশে সুবিচারের দাবি উঠুক না উঠুক, শাস্তির দাবি উঠতে দেরি হয় না। অমোঘ লীলার ভিডিওটি ভাইরাল হতে না হতে নড়েচড়ে বসে ইস্কন। তারা খোলাখুলি ভাবেই জানিয়ে দেয়, ব্রহ্মচারী অমোঘলীলা যা বলেছেন, সেই বক্তব্য একান্ত ভাবে তাঁর। এর সঙ্গে না ইসকনের কোনও যোগ রয়েছে, না সমর্থন। এমনকী ইতিমধ্যেই শাস্তির কথাও ঘোষণা করে দিয়েছেন ইস্কন কর্তৃপক্ষ। আগামী এক মাস তথা তিরিশদিনের জন্য অমোঘলীলাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইন্টারন্যাশলান সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস (ইস্কন)।
এখানেই শেষ নয়। শাস্তির পাশাপাশি প্রায়শ্চিত্যেরও তো প্রয়োজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন বক্তব্য এবং মানুষের সামনে ইসকনের মাথা হেঁট করার জন্য তাঁকে পাঠানো হচ্ছে নির্বাসনেও। প্রায়শ্চিত্যের জন্য তাঁকে যেতে হবে ব্রজধামে, রাধিকার গ্রাম বারসানায়। সেখানে গিয়ে অনুশোচনার আগুনে পুড়ে ঝলসে পরিশুদ্ধ হয়ে আলতে হবে তাঁকে। ইতিমধ্যেই ইস্কনের তরফে এই মর্মে জারি করা হয়েছে নির্দেশিকা। পাশাপাশি রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা তাদের এই সিদ্ধান্তের কথাও জানিয়ে দিয়েছে।
চল্লিশ পেরিয়েছেন অমোঘলীলা। তিনি শুধু ইসকনের একজন সন্নাসীই নন, ইস্কনের নিউ দিল্লির দ্বারকা শাখার ভাইস প্রেসিডেন্টও। সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণের আগে তাঁর নাম ছিল আশিস অরোরা। জন্ম লখনউয়ে। আশিসের বাবা ছিলেন 'র' অফিসার। বদলির চাকরি হওয়ায় নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে ছোটবেলাটা কেটেছে তাঁর। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর যোগ দেন একটি মার্কিন বহুজাতিক সংস্থায়। সেসময় থেকেই আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝোঁকেন আশিস, যোগ দেন ইস্কনে। অল্পদিনেই জনপ্রিয়তা, সুবক্তা হওয়ার সুবাদে প্রবচনকারী হিসেবেও খ্যাতি পান আশিস ওরফে অমোঘ লীলা। সেই সূত্রেই ইউটিউব এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে প্রায়শই মোটিভেশনাল বক্তব্য রাখতে দেখা যায় তাঁকে। এর আগেও একাধিক ধর্মগুরুর বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন অমোঘলীলা। আর এবার আক্রমণ শানান রামকৃষ্ণ আর বিবেকানন্দের বিরুদ্ধে। আর সেটাই খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি ভক্তেরা। ওই দুই মহাপুরুষের বক্তব্যের অপব্যখ্যা করেছেন এই অর্বাচিন সন্ন্যাসী, এমনই অভিযোগ উঠেছে।
কেন গেরুয়াই বেছে নেন ভারতীয় সন্ন্যাসীরা
বিষয়টি সামনে আসতেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। শুরু হয়ে যায় মিডিয়া ট্রায়ালও। বিষয়টি গড়ায় রাজনীতির ময়দান পর্যন্ত। যে কোনও ধর্মীয় তরজাই আজকাল গড়ায় রাজনীতির উঠোন পর্যন্ত। তারপর বাদানুবাদ, দোষারোপের পর ঘটে যেতে পারে হিংসার ঘটনাও। পয়গম্বর বিতর্কে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার বক্তব্য ও তাকে ঘিরে জ্বলে ওঠা দেশ, কদিন আগেই দেখেছি আমরা। অমোঘ লীলার বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করেন সিপিআইএম নেতা মহম্মদ সেলিম। পরিস্থিতি বুঝে এগিয়ে আসে তৃণমূলও। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বাণী নিয়ে ঠাট্টা করার অভিযোগে অমোঘ লীলার কড়া শাস্তির দাবি তোলে তৃণমূল। আর এত সব বিরোধিতার মাঝে স্বাভাবিক ভাবেই পদক্ষেপ করা ছাড়া পথ খোলা ছিল না ইসকন কর্তৃপক্ষের কাছে। আর তাঁরা তেমনটাই করেছেন। উঠতি প্রবচন বক্তা অমোঘ লীলাকে শাস্তিমূলক ভাবে পাঠানো হয়েছে নির্বাসনে, করা হয়েছে ব্যানও। বারসানা থেকে প্রায়শ্চিত্য সেরে ফিরেও কি ভক্তদের মনে পুরনো জায়গা ফিরে পাবেন তরুণ এই মোটেভেশনাল স্পিকার, সেটাই এখন দেখার।