এই বিভক্ত ভারতে নজরুলের দর্শন চর্চার খুব প্রয়োজন
Kazai Nazrul Islam: বাংলা ভাষার প্রথম গজল লেখার সময় কি তিনি ভেবেছিলেন যে গজল তো উর্দু সাহিত্যের!
হঠাৎ নজরুল কেন? এই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো অনেকবার। হতে হলো তখনই যখন নজরুলের জীবন আর দর্শন নিয়ে একটা নাটক করলাম। নাটকের নাম 'ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা'। আমার উত্তর বরাবরই খুব সহজ। নজরুলকে জানতে চাইছিলাম তাই। আর হ্যাঁ, হঠাৎ করেই জানতে চাওয়া না। যদি হঠাৎ করেও হয়, তাহলেই বা কী আছে? হতেই পারে! কারণ একজন কবির সব কবিতা পড়ে তাঁকে যেমন ভালোবাসা যায়, সেই কবির শুধুমাত্র একটা কবিতা পড়েও তাঁকে তেমনই ভালোবাসা সম্ভব।
শুধু এই একটা প্রশ্ন হলে তো ঠিক ছিল কিন্তু অনেক সময় এর চেয়েও কঠিন প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। যেমন ধরুন, আমার মতো অবাঙালির কেনই বা দরকার পড়ল নজরুলের নাটক নিয়ে কাজ করার? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে কিন্তু তারপরই মনে হলো, কেন এই ধরনের প্রশ্ন? তাহলে তো ম্যাকবেথ বা হ্যামলেট বা অন্য কোনও বিদেশি নাটক করতে গেলেও এই প্রশ্ন করা উচিত, কিন্তু কই তখন তো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না! তাহলে আমার দেশ বা প্রদেশ নিয়ে, বা আমার বাঙালি হওয়া বা না হওয়া নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে? পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, হতেই পারে। নজরুল বাঙালিদের গভীর ভালোবাসার নাম। সঠিকভাবে দেখলে, শুধু আমাদের দেশে না, এই বিশ্বে যারাই সম্প্রীতির কথা বলে; যারাই ধর্ম, জাতি, ভাষার বিভেদ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়, যারাই জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে ভয় পায় না, যারাই গালাগালিতে না গলাগলিতে বিশ্বাসী; তাদের সবার কাছেই নজরুল একটা ভালোবাসার নাম। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁর নাম, তাঁর কবিতা, তাঁর গান ছিল সবার মুখে মুখে। পরবর্তীতে, স্বাধীন ভারতেও সম্প্রীতি আর বিদ্রোহে নজরুলের গান ও কবিতা তো অবাঙালিদের কাছেও অজানা ছিল না। আর সে জন্যই আমি পাঞ্জাবী হয়েও তাঁর কবিতাকে, তাঁর গানকে ভালোবাসতে পেরেছি সেই তখন থেকেই যখন বাংলা ভাষার একটা শব্দও আমি জানতে বা চিনতে শিখিনি।
আরও পড়ুন- নজরুলকে এখনও ভালো করে বুঝতে পারিনি আমরা: মারিয়া এলেনা বাররেরা-আগারওয়াল
এরপরেও যদি ওই প্রশ্নগুলো আমার কাছে আবারও ফিরে আসে তবে আমি বলব, সেসব প্রশ্নের উত্তর আমায় নজরুল নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন। আচ্ছা, নজরুল কি কবিতা লেখার সময় বাঙালি আর অবাঙালি শব্দের মধ্যে বিভেদ করেছেন? বাংলা ভাষার প্রথম গজল লেখার সময় কি তিনি ভেবেছিলেন যে গজল তো উর্দু সাহিত্যের! নিশ্চয়ই এসব তিনি গ্রাহ্য করেননি। তিনি তো জাত-ধর্ম-ভাষার সব ভেদাভেদের বিপক্ষে ছিলেন। নজরুলের এই গুণই কিন্তু আমাদের বর্তমান সময়ে মুশকিলে ফেলে দিচ্ছে বারবার। কারণ নজরুলের কথা মনে রাখলে এই সব বিভেদ থেকে দূরে যেতে হবে। অথচ আজকের দিনে, দেশের রাজনীতি বা সমাজের যা অবস্থা, সেটায় জীবনযাপন করার জন্য একটা না একটা দল বেছে নিতেই হচ্ছে সবাইকেই। কোন ধর্ম, কোন জাত, কোন ভাষা, এমনকী কোন ধরনের খাবার খাবেন বা কেমন পোশাক পরবেন, এই সকল প্রশ্নের উত্তর দিলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আপনাকে নিয়ে। এইসবের মধ্যে কোন মুখেই বা বলবেন, "আমরা একই বৃন্তে দু'টি কুসুম...." বা "জাতের নামে বজ্জাতি সব..."?
ব্যক্তিগত দিক থেকে বলি। আমি নজরুলকে দুইভাবে চিনেছি। আমার মনে হয়, তাঁর এই দুই দিকটাই জানা খুব দরকার। প্রথম দিকটি হলো নজরুলের সাহিত্য। তাঁর কবিতা, নাটক, সম্পাদকীয়। একজন বিদ্রোহী কবি হিসেবেই নজরুল আমাদের কাছে সবথেকে বেশি পরিচিত। নিঃসন্দেহে, বিদ্রোহী তো নজরুল ছিলেনই কিন্তু নজরুলের বিদ্রোহেরও তো অনেক রূপ আছে! যেমন ধরা যাক—
"মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত!"
এই তো বিদ্রোহীর ভাষা! কিন্তু এ পাশাপাশি এটাও তো আরেক দিক বিদ্রোহের—
"আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।"
আরও পড়ুন- বিশু পাগলের চরিত্রে কাজী নজরুল! যে ‘রক্তকরবী’-র খোঁজ জানেন না অনেকেই
দ্বিতীয় দিকটি হলো, এই মুক্ত মানুষকে আরও ভালো করে বোঝার চেষ্টা। যার জন্য তাঁর জীবনকে কাছে থেকে দেখতে হবে, অর্থাৎ তাঁর জীবনযাপনের ধারাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। চায়ের দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে এই মানুষ কত ভিন্ন রকমের কাজ করে জীবনযাপন করতেন! তাও আবার শুধু নিজের জন্য নয়। নজরুলের শিল্প একটা বদ্ধ ঘরে বসে লেখা শিল্প নয়, দেশের জন্য জেল খাটতে খাটতে নজরুল নাটক লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। নজরুলের কবিতা মন দিয়ে পড়তে সাহস লাগে, তার চেয়েও বেশি সাহস লাগে বুঝতে যে, কবি নিজের কবিতার দাম জানার পরেও সেই কবিতা নিয়ে কোনও ব্যবসা না করে খালি পকেটে দিন কাটানোর সিদ্ধান্তে কীভাবে অটল ছিলেন তিনি! সাহস লাগে বুঝতে যে, গান থেকে শুরু করে নাটক, কবিতা, সম্পাদকীয়, সঙ্গীত রচনা থেকে সিনেমার কাজ পর্যন্ত সব কিছু তিনি একই আবেগ দিয়ে করে গেছেন। কাজের প্রতি এই আবেগ আসে ভালোবাসা থেকেই। শিল্পের প্রতি ভালোবাসা, মানবতার প্রতি ভালোবাসা। চে গেভারা বলতেন, "একজন সত্যিকারের বিপ্লবী প্রেমের মহান অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হয়।" নজরুলের সম্পূর্ণ জীবন এই প্রেমের মহান অনুভূতির দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল। স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মানুষ তিনি ছিলেন না। তাই তাঁর প্রেমও ছিল জলের ধারার মতো, যার রং রোজ বদলে বদলে যেত। আর এই নতুন রং, এই নতুন রাস্তা তাঁর শিল্পকেও প্রত্যেকবার নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল।
তবে শিল্পের এই বিচিত্র রঙ চিনতে গেলে তো আগে সেই রঙে নিজের মর্মকে রাঙাতে হবে। নতুন প্রজন্ম কি তৈরি হতে পারছে? তৈরি হওয়ার জায়গা কি পাচ্ছে? চারদিকেই তো যুদ্ধের আওয়াজ আর রক্তপাতের ছবি! টিভি, ফিল্ম, ভিডিও গেম, এমনকী বইগুলো থেকেও ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে হিংসার যত ভয়াল ছবি আর শব্দই ভেসে আসছে। তাঁদের মধ্যে মানবিকতা বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে নজরুলের শিল্প-সাহিত্য তো আছেই কিন্তু পাশাপাশি এই মানুষের জীবনযাপন সম্পর্কেও পরিচিত করানো খুব প্রয়োজন। নিজের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জীবনে সবধরনের কষ্ট সইতে হয়, এই কথা তিনি সুন্দর করে বুঝিয়েছেন আমাদের। প্রেমকে, সত্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজের মনের মধ্যে বিদ্রোহের আগুনকে কীভাবে পুষে রাখতে হয় তিনিই আমাদের জানিয়েছেন। আজ ধর্মের নামে, দলের নামে, দেশের নামে যুদ্ধ করতে করতে সমাজ যে জায়গায় নেমে এসেছে সেইখানে মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নজরুলের দর্শন চর্চার খুব প্রয়োজন। কিন্তু আমার চিন্তা এইখানেই! যেভাবে আমি বাংলাভাষা জানবার আগেই নজরুলের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলাম, বর্তমান প্রজন্ম কী করে তা পারবে! এই দায়িত্ব আমরা কেউই এড়িয়ে যেতে পারি না। আমাদের সবাইকেই এই দায়ভার নিতে হবে। আর তার আগে দায় নিতে হবে নিজেদের চোখদুটো খুলে রাখার, যে চোখ পুঁজিবাদের চাকচিক্যের মধ্যেও যেন দেখতে পারে প্রতিমুহূর্তে অবাক করে দেওয়ার মতো শিল্প আর জীবনযাপনকে।