চার হাত-পায়ে চিঠি লিখত পুরুলিয়ার কবি নির্মল হালদার, ছত্রে ছত্রে ছিল বুনো গন্ধ

নির্মল হালদার চিঠি লিখত চার হাত-পায়ে। ফলে তার সমস্ত চিঠি কারও পক্ষে সংরক্ষণ করা দুঃসাধ্য কাজ। আমিও পারিনি।

চিড়িয়াখানায় একবার এক সিংহর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘তুমি এত শান্ত কেন? বরাদ্দ খাবার না-দিলেও চুপ করে থাকো যে!' শান্ত সিংহটির উত্তর ছিল— ‘আমাকে যারা দেখতে আসে, তারা দেখুক, খাবার না-জুটলেও খিদেয় কেমন চুপ থাকতে হয়।’
এবং এভাবেই সে থেকে গিয়েছিল। চুপ করে।

কিন্তু এটা কোনও সিংহ-ফিংহর গল্প নয়। এটা এক পুরুল্যা-জ্যান্ত কবির প্রেম, আর্তনাদ, রিরংসা, ভালবাসা আর কাতর নিঃসঙ্গতার গল্প— যা সে চিঠিতে লিখে লিখে পাঠাত পরিচিতজনদের। সে, আর-কেউ নয়, খাঁচার ভিতর পায়চারিরত, ওই-যে— নির্মল হালদার। প্রৌঢ় বয়সেও ফন্দি আঁটছে, কীভাবে খাঁচাটা ভেঙে ফেলা যায়!

আর-সবার চিঠি লেখার শুরু আমার কলকাতা ছাড়ার পর। নির্মল হালদারের সঙ্গে চিঠির যোগসূত্র আলাপের পর থেকেই। সেটা হবে সেই গত শতকের ছিয়াত্তর সাল-টাল।

হয়তো প্রথম দেখি কলকাতার কোথাও, কোনও অস্থানে-কুস্থানে। কিন্তু, একজন মানুষকে দেখতে গেলে তার স্ব-স্থানেই যেতে হবে।
উনিশশো সাতাত্তর সালের মার্চ। চক্রধরপুর ফার্স্ট প্যাসেঞ্জারের ভোর। স্টেশন থেকে রিকশা। এস সি সিনহা রোড। চকবাজার। পুরুলিয়া। ডানহাতি পরপর তিনটে মন্দির— দুর্গা, কালী, গণেশ। পাশে গলি। গলির পর দোকান। গোটা এলাকার ওপর প্রকাণ্ড এক অশ্বত্থ গাছের ছায়ার নকশা। দোকান ফুঁড়ে সেই নকশা-গায়ে বেরিয়ে এল নির্মল হালদার। যত দূর মনে পড়ে— পাজামা, গেঞ্জি, গায়ে আলতো জড়ানো গামছা। সবই আধময়লা। সবই শীর্ণকায় শরীরে বসানো। ভাঙা গাল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। শিরা-ওঠা অপুষ্ট হাতে সে লিখেছিল—


শিকল পরা পায়ে নুপূর পরালে
নুপূর বাজবে তো?
আমি কেবল পায়ের শব্দ শুনি
শিকলের শব্দ শুনি
আজ নুপূরের ধ্বনি শুনব
শুনব তো?...


‘অস্ত্রের নীরবতা’। তখনও তিন বছর বাকি সেই ছোট্ট বইটি বেরোতে। তার আগে ৪৪/৩ মহাত্মা গান্ধী রোড, কলকাতা ৯ ঠিকানায় ১৭। ৩। ৭৭ সে লিখছে—


আপনি এখান থেকে চলে যাওয়ার পর বেশ মনখারাপ। বিশেষ করে এই আমার। আমি সত্যি সত্যি মনের দিক দিয়ে একা থাকি। তাই কেউ এলে একাকীত্বটা (য) কাটে, একঘেয়েমিটাও। আপনারা চলে যাওয়ার পর আবার সেই একলা থাকার দিন। একঘেয়েমির চূড়ান্ত। তারপর আবার এই চোতেই ঘর থেকে বেরুনো যাচ্ছে না, এতো রোদ। আজ আপনার চিঠি পেয়ে ভালো লাগলো। স্বস্তি পেলাম। আরও লম্বা, বহু খবরাখবর সহ লিখতে পাততেন। আশা কচ্ছি, পরের চিঠি লম্বা হবে, বেশ লম্বা। মাপা যায় না যা।…
অযোধ্যা থেকে বাড়ী এবং কোলকাতা ফিরে কী পদ্য লিখলেন পড়তে ভীষণ ইচ্ছে করছে।…


তখনও নির্মল ছিল বয়সে চার বছরের ছোট। ‘আপনি’ সম্বোধনে স্বস্তি পেত হয়তো। ক্রমে ওই চার বছরের ফারাকটা কমে-বেড়ে সমান হয়ে যায়! প্রথমে ‘একরামদা’, পরে ‘আলিসাহেব’, অবশেষে ‘একরাম’ এবং সেই সঙ্গে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’। আমি যেমন ছিলাম— ‘তুমি’ থেকে সেই ‘তুমি’-তেই।

আর কথা— আমার প্রথম পুরুলিয়া যাওয়ার, এবং অযোধ্যা যাওয়ারও, প্রসঙ্গ এই চিঠিতে এসেছে। ওই-যে অশ্বত্থ গাছের ছায়ায়…। সেবার অযোধ্যাযাত্রী ছিলাম গৌতম চৌধুরী, অশোক দত্ত, সৈকত রক্ষিত, নির্মল আর আমি। সে-প্রসঙ্গ অন্য।
এখানে বাড়ি বলতে বীরভূমের বাড়ি।

নির্মল হালদার চিঠি লিখত চার হাত-পায়ে। ফলে তার সমস্ত চিঠি কারও পক্ষে সংরক্ষণ করা দুঃসাধ্য কাজ। আমিও পারিনি। তবু গুনেগেঁথে দেখছি— মোট একশো ছ'-টি চিঠি আজও থেকে গিয়েছে। ছোট-ছোট। কিন্তু নিয়মিত। ধারাবাহিক। অধিকাংশ চিঠিতে দেখছি শিরোনাম। যেমন— ‘ধান-পাকা হাওয়া’ বা ‘চৈত্র মাস মধু মাস মহুলের মাস’, বা, ‘কুয়াতে জল নেই’। শিরোনামেই জ্বলজ্বল করত আপ্রান্তর পুরুলিয়া জেলা, যে-ভূখণ্ডটি ছিল এবং আজও আছে নির্মলের সসাগরা ধরিত্রী। কোনও কোনও চিঠিতে আঁকিবুঁকি। প্যাস্টেলে, পেনসিলে বা কলমে— যে-কলমে চিঠিটি লেখা।

তবু, একটা বার্তা যেন রটে যায়- যে পোস্টকার্ডমাত্র সম্বল করে, পরে বিএসএনএল-এর একটা খুদে সিমকার্ডের ভরসায়, গোটা বঙ্গ-দুনিয়া কী করে শাসন করত সে! তার শাসনের একটা নমুনা:
পুজোর আগে এসেছে কলকাতা। উঠেছে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। ওকে পুজোর জামাকাপড় দেওয়া হবে। আমরা বেরিয়েছি শ্যামবাজারের দিকে। যেতে যেতে প্রসূন, নন্দিনীকে— ‘দেখেশুনে দিও। ওর জামাকাপড় তো আর কম নেই। বরং চাংকি পাণ্ডের থেকে কিছু বেশিই হবে হয়তো।’

হো হো হাসির মধ্যে নির্মলের প্রবল আপত্তি। এবং ততক্ষণে আমরা একটা দোকানে।

চারপাশটা দেখে নির্মল সন্দিগ্ধ— ‘এখানে পাওয়া যাবে?’

‘কী?’ নন্দিনী-সুলভ ছোট্ট প্রশ্ন। সেইসঙ্গে উত্তরও— ‘ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় তো? সব পাবে।’

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কত মানুষের কত কিছু হল। কতজন কতভাবে পালটে গেলাম। কিন্তু নির্মল হালদারের শুধু চুল-দাড়ি পাকল। চামড়া কুঁচকে গেল দিন দিন। একটা, দুটো করে অসুখ ঢুকল শরীরে। আর, সেই শরীর নিয়ে, কমে-আসা দৃষ্টিশক্তি নিয়ে, খুঁটিয়ে দেখে গেল চারপাশের পরিবর্তনগুলো। যদিও তার আজন্মসঙ্গী আয়না তাকে প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে যাচ্ছে— "কিচ্ছু পালটায়নি। সব কিছুই সেই আগের মতো আছে। যেমন তুমি, হে আমার ডোরিয়ান গ্রে! যে-জল তুমি খাও সেই জল, যে-অন্ন মুখে দাও সেই অন্ন,… তোমার সেই হাসি, গোপন কান্না…।"

নির্মল ক্রুদ্ধ হয়। ভেতরে ভেতরে গর্জায়। তবু ভেঙে ফেলতে পারে না আয়নাটাকে। আবার একটা কিনতে হবে ভেবে। অনুচ্চারিত কণ্ঠে শুধু ধমকায়— চুপ করো!

খুব অবাক লাগে, যখন দেখি, আপনাকে ২/৪টে চিঠি লিখেও জবাব পাই না।
আমি মরে গেলেও খবর নেবেন না, মনে হয়।
অথচ আপনার মতো একজন সৃজনশীল মানুষের শব্দ পেলে আমি বেঁচে উঠি। এবং আপনার মতো একজন বন্ধুরও সাড়া পেলে প্রেরণা পাই।
চিঠি লেখা আমার বদভ্যাস, কিন্তু মাসে দু’মাসে আমাকে একটা লিখেও কি সু-অভ্যাস করবেন না?...

চিঠির তারিখ ৫। ৮। ৮৬, আমার গ্রামের ঠিকানায়।

দিনের থেকে দীন হয়ে চেয়ে থাকলে
সে আসবে
সে আমার রূপ আমার স্বরূপ
সে একটা ছায়া, আমার নীরবতা

আমি নীরবতাকে নিচু হয়ে তুলতে চাই

একটি সম্পূর্ণ কবিতা। ‘মৃত্যুঞ্জয়’ থেকে। একটু হাওয়া, একটা আলপথ, জবাফুল, খিদে, বিধবা দিদি, উনুন, শুকিয়ে-আসা কুয়ো— এসবই কবে থেকে রয়ে গেছে নির্মলের সঙ্গে। তার চোখের গর্তে।

মানুষ কী পায়? এর উত্তরে এঁদো পুকুরপাড়ের ধুতরো গাছটি চারদিক দেখিয়ে বলেছিল— ‘আমাকে!’

কিন্তু নির্মল হালদারের কবিতা তো পেয়েছি আমরা। সেই-যে কুকুরছানাটি! ‘মাঝপথে নেমে রান্নাবান্না’ নামের বইতে। তাতে ‘জীব’ নামের একটি কবিতা ছিল না? সেই-যে…

কুকুরছানাটি চলে যায়
এখান শোঁকে ওখান শোঁকে, চলে যায়
এঁটোকাঁটা নেই, মায়ের দুধও ছেড়ে দিয়েছে
কেবল এই গলি থেকে ওই গলি
ওই গলি থেকে ওই গলি
শুঁকে শুঁকে বেড়ায়, দাঁড়িয়ে পড়ে
এদিক ওদিক দ্যাখে আর
রাত হলেই উপর দিকে মুখ করে কেঁদে ওঠে


কী নিরাভরণ আর হাহাকারে ভরা তার জীবন! আর কী নিরাভরণ এই কবিতা! অথবা সেই-যে নির্মল লিখেছিল—

ঘরে কালিঝুলি থাকলে মনে হয়
উনুন একটা আছে, ধোঁয়া হয়
ঘরের কোণে মাকড়সা জাল বুনলে মনে হয়
প্রাণের সঙ্গে প্রাণ বাসা বাঁধছে।
রাস্তার ধুলো ঘরে ঢুকলে মনে হয়
এই ঘরে আসে মানুষজন আছে মানুষজন।

(প্রাণ, ধান ও জলের ধ্বনি)

তখন ‘কৃষ্ণপক্ষ’-পর্ব শেষ করে ‘পুনর্বসু’ নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছি তো ঘুরছিই। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে— পত্রিকাটিকে আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। সেদিন প্রসূনের বাড়িতে আমরা তিন। ঠিক হয়, আন্দোলনের নাম হবে— শতজল ঝরনার ধ্বনি। নির্মলের দেওয়া। পরে, পুরো ব্যাপারটা কি হাতফেরতা হয়ে অন্য রূপ নিয়েছিল? নির্মলের চিঠি। ১২।৬।৮৯ তারিখে:

ঘরে এসেছি।
কি কথা বলবো বলুন। কথা এখন: জলপাইগুড়ি শহরে কবিসভাকে সফল করতেই হবে।
আপনার ‘ঘনকৃষ্ণ আলো’র প্রশংসা শুনলাম বহু জনের কাছে। যেমন আলোক সরকার। কালীদা, ইত্যাদিরা। এখানের অসিত ও মুকুল বই পেয়েছে। প্রণবেন্দুদা বই পাওয়ার কথা বললেন।…
এবার কোলকাতায় মৃদুলের সঙ্গে কথা হলো, অনেক। শ্রীরামপুরেও গিসলাম ওর বাড়ি। মৃদুল আপনার কথা বলছিল। ওর সঙ্গে একটু যোগাযোগ করবেন। অমিতাভ গুপ্ত আপনার বই পাননি। আমি দিয়ে দিয়েছি।

হয়েছিল কী, শতজল ঝরনার ধ্বনি-র ব্যানারে প্রথম কবিসভা হওয়ার কথা জলপাইগুড়িতে। সেইমতো প্রসূন, নির্মল আর আমি যাই সমর রায়চৌধুরীর বাড়ি। বীরভূমে আমাদের বন্ধু স্বপনকান্তি ঘোষের বাড়ি থেকে দার্জিলিং মেল ধরি বোলপুরে। রিজার্ভেশন ছাড়াই। সারারাত ট্রেনে দাঁড়িয়ে। সেবারই প্রথম আর শেষ জলপাইগুড়িতে যাওয়া। বিকেলে শুনলাম, শামশেরদা জলপাইগুড়িতেই। ফলে, শেষ বিকেলে শামশের আনোয়ারের বাড়ি। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বিরাট কম্পাউন্ড। বড় গেট। লনে বেশ কয়েকজন বসে। খবর গেল ভেতরবাড়িতে। একজন এসে সামনের একতলা বাড়ির একটা ঘর খুলে দিল। ঠাসাঠাসি, অগোছালো, পুরনো, ভারী আসবাবে আর গন্ধে ভরা। একটু পরই দরজায় বিষণ্ণ এক ছায়ামূর্তি— শামশের আনোয়ার। পাজামা। হাওয়াই শার্ট। চা এল। কিন্তু আসবাবের গুমট চাপে আড্ডা জমল না।

পরদিন ভোরে সমরের ফ্ল্যাটে জানালা উপচে রুপোলি বিস্ময়। মেঘ সরে গেলে ছবি বিশ্বাস যেমন বিস্ময়াবিষ্ট আর্তি নিয়ে ডেকেছিলেন মেয়েকে আর স্ত্রীকে, আমিও তেমনই নির্মলদের— জানালায়-যে তিনি! কাঞ্চনজঙ্ঘা!

ফিরতি পথে যা হয়, টাকা শেষ মানে শেষ। শিলিগুড়িতে দাঁড়িয়ে, বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে, এক হোটেলের সামনে। পকেটে শুধু ফেরার টিকিট। কী হবে? তারপর, কী করে যে নির্মলকে বুঝিয়ে অশ্রুকুমার শিকদারের বাড়ি পাঠানো হলো, কী বলে সে নিয়ে এল দরকারি টাকা, আজ আর মনে নেই।

নির্মলের এই পোস্টকার্ড জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে। যদিও পরের চিঠিতে (২৭।৬।৮৯) সে জানতে চেয়েছিল—

প্রসূন উদ্বিগ্ন জলপাইগুড়ি নিয়ে চিঠিতে জানলাম। জানলাম, আপনি ও স্বপন কোলকাতা যাননি।…

শেষ পর্যন্ত অবশ্য সে-কবিসম্মেলন হয়নি জলপাইগুড়ি শহরে। হয়েছিল কৃষ্ণনগরে। সে-প্রসঙ্গ ভিন্ন।

চিঠির কালীদা— কালীকৃষ্ণ গুহ; অসিত ও মুকুল— আকরিক-সম্পাদক ও কবি অসিত সিংহ, জিরাফ-সম্পাদক ও কবি প্রয়াত মুকুল চট্টোপাধ্যায়; প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ও মৃদুল দাশগুপ্ত।
দ্বিতীয় চিঠির স্বপন— পুনর্বসু-সম্পাদক স্বপনকান্তি ঘোষ।

এত-যে চিঠি, নতুন করে খুঁজে আরও ছাব্বিশটা, মোট একশোবত্তিরিশটা, তাতে পুরুলিয়া যাওয়ার ঘন ঘন আমন্ত্রণ। আজ মনে হয়, শুধু বেড়াতে যাওয়ার জন্য বা হইহুল্লোড় করতে নয়। নির্মলের ডাক ছিল তাকে এবং তার ভূখণ্ডকে দেখাতে। পুরুলিয়া। টাঁড়। রুক্ষতা। খিদে। ছৌ। নৃত্যের পৌরুষ। তারই মাঝে আশ্চর্য প্রকৃতি। পলাশ। শিমুল। শান্ত ড্যামের জলে গরিব পাহাড়ের নীল ছায়া। হাজার হাজার বছরের ক্ষয়ে-যাওয়া শিলার ফিসফিসানি আমরা তাই শুনতে পাই নির্মলের কবিতায়।

৪ঠা পুরুলিয়া আসছেন, এ সংবাদে নেচে উঠেছি।… উঃ ভাবা যায় না, কী মজা হবে। (২৯।১।৭৭)

চলুন, দলে-বলে একবার চাইবাসা যাই। ঠিক করে ফেলুন কবে যাবো।… (৪।৩।৭৭)

আমার বয়স বাড়ছে, এ কথাটা ভাবলেই গায়ের রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে। এখনও কিছু হলো না। কোনও অন্নসংস্থানই হলো না। দিন দিন শুধু ক্ষয়ে যাওয়া।… লক্ষ্মীপুজোর পরদিন চাইবাসা যাবো। সব ঠিকঠাক, থাকার জায়গা ঠিক করেছি। আসুন না কোনো একজনকে সঙ্গে নিয়ে। বেশ মজা করা যাবে। এখানে লক্ষ্মীপুজোর দিন এসে পরের দিন আমাদের সঙ্গে যাওয়া। শুধু যাওয়া। (২৪।৯।৭৭)

লিখেছিলাম: থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধে হবে না। কিন্তু আপনাকে পেলাম না। (২৮।২।৮৩)

এমন নয় যে, চিঠিগুলো বেছে নিয়েছি। পাঁচটা টানলে দুটো চিঠি এমনই।

একবার হলো কী, জয়পুরের দিকে যাওয়া হবে। জিপ-জাতীয় গাড়িও ঠিক হল একটা। পাকা সড়ক থেকে বাঁদিকে ঘুরে বেশ খানিকটা গেলে দেওলঘাটা। অয্যোধ্যার পিছনদিক। আহ! কাঁসাই সেখানে স্বচ্ছ, খরস্রোতা, প্রস্তরাকীর্ণ। যেমনটা চাই। ওপারে শাল-মহুয়া। তাদের ছায়ায় তিনটি প্রাচীন জৈন মন্দির। হাজার বছর? হ্যাঁ, শরীর ভেঙে-ভেঙে গেলেও বয়সের শীতলতা-সহ আজও দাঁড়িয়ে।

এক ভদ্রলোক শিক্ষকতা ছেড়ে আশ্রম করেছেন সেই নির্জন নদীতীরবর্তী ছায়ায়। সঙ্গে ভৈরবী। সেদিন নবমী। দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ। কাঁসাইয়ে খর স্নান। ভোগ সেখানে মূলত চ্যাংমাছ পোড়া। সঙ্গে অন্যান্য কিছুর সঙ্গে ভাত। ক্ষয়িষ্ণু অরণ্যের ছায়ায় পাত পেড়ে খাওয়া।

কিন্তু পুরুলিয়ার সেই বুনো চেহারা আর নেই। ভূখণ্ডটির শুভাকাঙ্ক্ষী দিন দিন বেড়েছে। ফলে অযোধ্যার ধ্বংসসাধন এখন সম্পূর্ণ। প্রায় প্রতিটি গাছতলায় ট্যুরিস্টের দল। হাতে পানীয়। এরই মাঝে বাংলাহীন, তারিখহীন, ভয়ংকর, একটা পোস্টকার্ড:


PLEASE DON’T COME 12TH OCTOBER. YOU FELL IN FRICTION OF ASHOK DUTTA AND MUKUL CHATTERJEE’S GROUP.
-WELLWISHER


হায় রে ‘ছাতিমতলা’, ‘সৃজন উৎসব’, ‘আকরিক’, ‘অরন্ধন’, ‘অহিরা’!

আমাদের সবার আয়ু কমে-কমে আসছে। এমনকী, নির্মল হালদারেরও। তবু, অবশিষ্ট নির্জনতা হয়তো এখনও রয়ে গেছে কোথাও। সেখান থেকে অল্প কিছু হাওয়া কি আসবে না চকবাজারের দিকে? নির্মলের সেই ছোট্ট জানালাটির দিকে?

More Articles