এআই ক্যামেরা, বিশেষ বাহিনী দিয়েও কেন মহাকুম্ভে পদপিষ্ট হওয়া আটকানো গেল না?

Maha Kumbh Stampede 2025: কোল্ডপ্লে ব্যান্ডের ক্রিস মার্টিনও তাঁর বান্ধবী ডাকোটা জনসনকে নিয়ে মহাকুম্ভ মেলায় যান, সুপার মডেল মিলিন্দ সোমান সস্ত্রীক স্নান করেছেন। সকলের জন্যই রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা, বিশেষ নিরাপত্তা।

মহাকুম্ভে মৌনী অমাবস্যার রাতে 'অমৃত স্নানের' সময় সঙ্গমে গভীর রাতে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন ৩০ জনেরও বেশি ভক্ত। আহত বহু। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে, আর প্রশাসন স্বাভাবিকভাবেই তা কমিয়ে দেখাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রশাসন ও পুলিশ বহুদিন থেকেই দাবি করে এসেছে যে এই ব্যাপক জনসমাগম সামলানোর সমস্ত প্রস্তুতিই তারা নিয়েছেন। তাহলে কীভাবে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটল? ফাঁকি রয়ে গিয়েছিল ঠিক কোথায়? মৌনী অমাবস্যার সন্ধ্যা ৬টা অবধি ৭.৬৪ কোটি ভক্ত স্নান করেছিলেন। ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পাওয়া হিসেব বলছে, প্রায় ১৯.৯৪ কোটি মানুষ সঙ্গমে স্নান করেছেন। একটি বিশেষ দিনে যে ব্যাপক ভিড় হবে তাও জানত প্রশাসন। তাহলে আগাম সব জেনেবুঝেও এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল কীভাবে?

রাত্রি ১ টা থেকে ২টোর মধ্যে এই পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। ভিড় থেকে বাঁচতে বেশ কিছু ভক্ত ব্যারিকেড লাফিয়ে বেরোতে চেষ্টা করলে পদদলিত হন তারা। অনেকেই জানিয়েছেন, পেছন থেকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেয়েছিলেন তারা। একদিকে ব্যারিকেডের মধ্যে আটকে পড়েন তারা, অন্যদিকে চলে পুলিশের লাঠি। বেশ কয়েকজনের হাড় ভেঙে গেছে যায়। অধিকাংশই মারা যান হার্ট অ্যাটাকে।

কুম্ভ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, 'অমৃত স্নানের' কারণে বেশিরভাগ সেতু তিনদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই কারণে ঘুন্সি ও নৈনী অভিমুখে যাওয়া ভক্তদের সঙ্গম স্নান সেরে বের হতে দেওয়া হয়নি। এই কারণে সীমিত এলাকায় কয়েক কোটি মানুষের ভিড় জমে যায়।

আরও পড়ুন- পায়ের চাপে পিষ্ট শিশু-বৃদ্ধ! মহাকুম্ভে মৃতের সংখ্যা চাপতে কেন মরিয়া যোগী সরকার?

এই পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে গভীর রাতে। প্রায় দেড়টা-দুটো নাগাদ। কুম্ভমেলার আয়োজকরা জানিয়েছিলেন, এআই ক্যামেরা দিয়ে মেলার উপর প্রতিক্ষণ নজর রাখছেন তারা। এমন নিবিড় 'মনিটরিং' করার দাবি করেও তাহলে এত ভিড়ের আন্দাজ করা গেল না কেন? আয়োজকরা বলছেন, তারাও বুঝতে পারেননি যে সঙ্গমের মূল অংশের আশেপাশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। রাত হয়ে যাওয়াতে প্রশাসন তত গুরুত্ব দেয়নি নজরদারিতে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শীই বলেছেন, পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনার সময় আশেপাশে পুলিশের দেখাও পাননি তাঁরা। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কর্মকর্তাদের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স সঙ্গমের দিকে ছুটে যায়।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সঙ্গমে আসা-যাওয়ার জন্য একটি মাত্র পথ খোলা রাখা হয়েছিল। একটি মাত্র পথ থাকায় পদপিষ্ট হওয়ার পর পালানোর সুযোগ পাননি ভক্তরা। যারা আটকে পড়েছিলেন, তারা সেখানেই আটকে পড়ে থাকেন।

ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য মহাকুম্ভ এলাকায় ৮৪টি হোল্ডিং এলাকা তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু সেগুলি সম্ভবত ব্যবহার করা হয়নি। মঙ্গলবার রাতে যখন ভক্তরা কালী মার্গ পার্কিং এবং অন্যান্য জায়গায় বসেছিলেন, পুলিশ তাদের সঙ্গমের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। ফলে সকাল নয়টা থেকে সঙ্গমে জড়ো হওয়া ভিড় অমৃতস্নানের জন্য বসেইছিল। সঙ্গমে স্নানের জন্য একমুখী পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ভক্তদের কালী রোড থেকে যেতে হবে, ত্রিবেণী বাঁধ পার হতে হবে এবং উপরের পথ দিয়ে সঙ্গমের মূলে পৌঁছতে হবে। অক্ষয়বত রুট এবং ত্রিবেণী বাঁধ দিয়ে ত্রিবেণী রাস্তায় প্রস্থানের পথ ছিল। তবে, এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। খুব কম লোকই অক্ষয়বত রুট ব্যবহার করেছে। সঙ্গমের ওপরের পথেই লোকজন আসা-যাওয়া করতে থাকে।

মেলা এলাকায় ভক্তদের চলাচলের সুবিধার্থে ৩০টি পন্টুন সেতু নির্মাণ করা হলেও ১২ থেকে ১৩টি পন্টুন সেতু বন্ধ ছিল। ঘুন্সির দিক থেকে কোনও ভক্ত সঙ্গমে এলে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হবে তাঁকে। বেশিরভাগ বয়স্ক তীর্থযাত্রীরা ক্লান্ত হয়ে সঙ্গমের মূলেই দীর্ঘক্ষণ বসে থাকেন। এর ফলে সঙ্গমে ভিড় জমে যায়।

প্রশাসন ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযানের জন্য মহাকুম্ভ এলাকায় অসংখ্য বাহিনী মোতায়েন করলেও বিভিন্ন সেক্টরে বাহিনী মোতায়েন করাই হয়নি। একটি সিআইএসএফ কোম্পানি ১০ নম্বর সেক্টরে অবস্থান করছিল। গভীর রাতে যখন পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে তখন সিআইএসএফ কোম্পানিকে ডাকা হয়। পরিস্থিতি সেক্টর ১০ থেকে সেক্টর ৩-এ পৌঁছতে কোম্পানির যথেষ্ট সময়ও লেগে যায়।

আরও পড়ুন- মহাকুম্ভে মহাবিপর্যয়! ১০ কোটির পূণ্যস্নানে পদপিষ্ট মানুষ! দায় কার?

ক্রমাগত ভিআইপিদের চলাচলের কারণে বিশ্রামের সময় পাননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে ভিড় ব্যবস্থাপনায় প্রভাব পড়েছে বলেও সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন কি এই ভিড় মোকাবিলায় আদৌ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছিল? কংগ্রেস বলছে বিজেপির 'ভিআইপি সংস্কৃতি' এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এই বিপুল পরিমাণ ভিড় সামলাতে যে ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার তা ছিল না। সাধারণ তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশেষ কিছুই পরিকল্পনা ছিল না সরকারের। ভিআইপিদের চলাচলকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়েই বাতিলের খাতায় পড়ে যান সাধারণ মানুষরা। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও এই ধরনের অবস্থা ঘটেছে মহাকুম্ভে। সাধারণ ভক্তদের না আছে নিরাপত্তা, না আছে দিন কাটানোর সুব্যবস্থা।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সহ হাই-প্রোফাইল বিজেপি নেতারা পবিত্র স্নান করতে মহাকুম্ভ পরিদর্শন করেন। কোল্ডপ্লে ব্যান্ডের ক্রিস মার্টিনও তাঁর বান্ধবী ডাকোটা জনসনকে নিয়ে মহাকুম্ভ মেলায় যান, বলিউডের বহু মুখ, সুপার মডেল মিলিন্দ সোমান সস্ত্রীক স্নান করেছেন। সকলের জন্যই রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা, বিশেষ নিরাপত্তা। আর প্রায় ৮-১০ কোটি সাধারণ ভক্ত, যাঁদের ভোটে ক্ষমতায় আসে সরকার, তাঁদের জন্য কোনও বিশেষাধিকার নেই। এমনকী দুর্ঘটনার পরেও যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, কিছুজন মাত্র আহত হয়েছেন। ভক্তদের কাছে কোনো গুজবে কান না দিতে অনুরোধ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ এআই ক্যামেরা, বিশাল বাহিনী, প্রচুর ঘোষণা, বিপুল ব্যবস্থাপনার ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে গেল পদপিষ্ট হওয়া সাধারণ মানুষের কান্না। প্রশাসন যার দায় নেবে না কোনওকালেই।

More Articles