পায়ের চাপে পিষ্ট শিশু-বৃদ্ধ! মহাকুম্ভে মৃতের সংখ্যা চাপতে কেন মরিয়া যোগী সরকার?
2025 Prayag Maha Kumbh Mela stampede 2025: প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ বলছেন, সঙ্গমের মূল ঘাটের দিকে যাওয়ার চারটি ফটকের মধ্যে তিনটিই বন্ধ ছিল। যার ফলে ভক্তরা একটি মাত্র খোলা দরজার কাছে ভিড় করেছিলেন।
যোগী বলেছিলেন, তেমন গুরুতর নয়। কিছুজন আহত হয়েছেন মাত্র। প্রায় ১০ কোটি মানুষের সমাগমে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটলে যে কিছুজন স্রেফ 'আহত' হতে পারেন না, এ শিশুরও বোধগম্য। বেলা বাড়তেই লাশের সংখ্যা বাড়ে। পুণ্য করতে এসে চিরতরে প্রাণ গিয়েছে মানুষের। আর ঘটনার খোঁজ পেতেই ধামাচাপা দেওয়ার সমস্ত প্রয়াস করেছে সরকার। এমনটাই হয়ে থাকে। পুণ্যের খোঁজে নয়, প্রয়াগরাজের হাসপাতাল, মর্গের বাইরে আত্মীয়রা প্রিয়জনের দেহ খুঁজছেন এখন মরিয়া হয়ে। কারও সন্ধান মিলছে, কারও কোনও খোঁজই নেই। অনিশ্চয়তা এবং হতাশার অন্ধকারে কুম্ভজুড়ে অস্থির হাহাকার। এত কিছু সত্ত্বেও বুধবার সন্ধে অবধি সরকার মৃত্যুর তথ্যই চেপে যেতে চেয়েছিল। শুধু বার্তা দেওয়া হয়েছিল শান্ত থাকার, গুজবে কান না দেওয়ার। অথচ এই মহাকুম্ভে প্রতিক্ষণে সংখ্যাই কথা বলেছে, প্রতি ঘণ্টায় কতজন ডুব দিয়েছেন, কত কত বিশেষ ট্রেন, কত শৌচাগার, কত সাধু— সবকিছুর হিসেব আছে। কেবল পদপিষ্ট হয়ে কারা চলে গেলেন চিরতরে, তার হিসেব নেই!
পদদলিত হয়ে এখনও অবধি ৩০ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে যোগী প্রশাসন। যার মধ্যে পঁচিশটি মৃতদেহ শনাক্ত করা গেছে। ৬০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান এবং হাসপাতালের গোপন সূত্র জানাচ্ছে সংখ্যা এর চেয়ে ঢের বেশি। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ পদপিষ্ট হওয়ার কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিচারপতি হর্ষ কুমার, প্রাক্তন ডিজি ভি কে গুপ্ত এবং অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার ভি কে সিংকে নিয়ে তিন সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশন ঘোষণা করেছেন। মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণাও করেছেন।
আরও পড়ুন- মহাকুম্ভে মহাবিপর্যয়! ১০ কোটির পূণ্যস্নানে পদপিষ্ট মানুষ! দায় কার?
কেউ বোনকে খুঁজছেন, কেউ সন্তানকে, কেউ মাকে, কেউ স্বামীকে। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না স্বজনের। এই অপেক্ষমান উদ্বিগ্ন আত্মীয়দের পুলিশ জানাচ্ছেও না, কত সংখ্যক মানুষ মারা গেছেন। অথচ দুর্ঘটনাস্থলে প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে থাকা ছেঁড়া চটি, পোশাক, ব্যাগ, জলের বোতল বুঝিয়ে দিচ্ছে মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা। প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ বলছেন, সঙ্গমের মূল ঘাটের দিকে যাওয়ার চারটি ফটকের মধ্যে তিনটিই বন্ধ ছিল। যার ফলে ভক্তরা একটি মাত্র খোলা দরজার কাছে ভিড় করেছিলেন। একটি ব্যারিকেডের কিছু অংশ ভিড়ের চাপে খুলে যায় দ্বারা। ধাক্কার চোটে হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন মানুষ। একটি ব্যারিকেড ভেঙে যাওয়াতে লাগামছাড়া ভিড়ের চাপে অনেক মানুষ মারা যান, আহত হন আরও অনেকে।
এই জায়গাটি ছাড়া, কাছাকাছিই ১৪৭ নম্বর পিলারের কাছেও নাকি একই রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা গিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, হঠাৎ করেই ভিড় বেড়ে যায় রাত প্রায় ১টা - ১:৩০ টা নাগাদ। ভিড়ের মধ্যেই মানুষ এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করেন এবং সেখানে কোনও পুলিশ উপস্থিত ছিল না। লোকজন একে অন্যের উপর হুড়মুড়িয়ে পড়ে যেতে শুরু করে। আর বাকিরা তাদের উপর দিয়েই হাঁটতে থাকে।
দেবকি রাজপুত নামে এক পুণ্যার্থী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মৌনী অমাবস্যায় রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ স্নান করতে গিয়েছিলেন তাঁরা। তখন ২০জন একসঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ ভিড় বাড়তে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজের পিসিকে হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরিস্থিতি এমনই ছিল যে তাঁরা ভাবেননি যে কেউ প্রাণে বেঁচে ফিরবে। উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুর থেকে সপরিবারে এসেছিলেন বাসদেব শর্মা। ওই ভিড়ের মাঝেও, ওই ঘটমান মৃত্যুর মধ্যেও তাঁদের টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়েছে কেউ। বাসদেব বলছেন, “হঠাৎ বিশাল ভিড় হয়ে গেল। আমার পরিবারের একজন সদস্য পদপিষ্ট হয়েন। আমরা ডুব দিয়ে ফিরে আসার সময় দেখি তিনি অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন। আর তাঁর চারপাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে মানুষ। কেউ সাহায্য করছে না। বুকে ও পায়ে একাধিক আঘাত লেগেছে তাঁর।"
আরও পড়ুন- ৪৫০ মিলিয়ন মানুষের বর্জ্য! কুম্ভমেলা সামলাচ্ছেন সেই ‘অস্পৃশ্য’ সাফাইকর্মীরাই
সুলতানপুরের রাম প্রসাদ যাদব বলছেন, "আমি নদীর দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে আমি পড়ে যাচ্ছি... আমি উঠে দাঁড়ানোর আগেই ভিড় আমার উপর দিয়ে হেঁটে মাড়িয়ে চলে গেল।" রাম প্রসাদ সামান্য আঘাত পেয়েছেন। তবে তাঁর ৬৫ বছরের মা গুরুতর আহত হয়েছেন। ওম প্রকাশ যাদব বলছেন, তাঁর বোন রীনা পদপিষ্ট হন। সকাল পর্যন্ত তিনি জানতেনই না বোন আর নেই। পুলিশ অনেক রাতে জানায়, বোন রীনা এখন বডি নম্বর ২৭।"
বালিয়া থেকে এসেছিলেন বলজিৎ সিং। তাঁর স্ত্রী মীরার হাত ধরে এগোচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ বুঝতে পারেন, এই ভিড় আর সাধারণ ভিড় নয়! যেন এক দানবীয় শক্তি তাঁদের ঠেলা দিচ্ছে। স্ত্রীর হাত ছেড়ে যায়। স্ত্রীকে হারিয়েছেন তিনি, চিরতরে। জৌনপুর থেকে ২০ জনের একটি দলে এসেছিলেন জগবন্তী। ওই ভিড়ে বাঁচতে পুলিশকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন। “আমরা চিৎকার করেছি, আমরা কেঁদেছি, কিন্তু কেউ শোনেনি। আমি ভেবেছিলাম আমরা সবাই মারা যাব," বলছেন অসহায় জগবন্তী। স্ত্রীকে হারিয়েছেন ফুলচাঁদ বিশ্বকর্মাও। বিহারের ছতরপুরের লক্ষ্মী হারিয়েছেন স্বামীকে। কীভাবে বাড়ি ফিরবেন তাও জানা নেই।
যোগীর ক্ষতিপূরণ এই ক্ষত ঢাকতে পারবে? তদন্ত কমিশন গড়ে কি কোনওদিন এই ব্যাপক সমাগম, ১৪৪ বছর পর ঘটা মহাকুম্ভের কলঙ্ক মোছা সম্ভব? এই মানুষের ভিড় যেখানে সেখানে কেন পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা নেই? যদি না থাকে তাহলে কেন বিপদকে রাস্তা করে দেওয়া হলো সরকারি মদতে? তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে এসবের উল্লেখ কোনওদিনই মিলবে না হয়তো।